Views Bangladesh Logo

বাণিজ্য ঘাটতি এবং শুল্ক: ট্রাম্পের বিভ্রান্তি ও শ্রীলংকার করণীয়

শ্রীলংকার সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য ঘাটতি অব্যাহত রয়েছে। দুটি দেশের মধ্যে বাণিজ্য ঘাটতি তেমন বড় কোনো ব্যাপার নয় এ কথা অর্থনীতিবিদদের মধ্যে প্রায় সর্বজনীনভাবে স্বীকৃত হলেও ট্রাম্পের বিশ্বাস ভিন্ন। দায়িত্ব গ্রহণের সময়, তিনি তার কর্মকর্তাদের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্রমবর্ধমান বাণিজ্য ঘাটতি “তদন্ত এবং প্রতিকার” করতে বলেছিলেন। ২০২৪ সালে ৬.৩ শতাংশ বাণিজ্য বৃদ্ধির পর শ্রীলংকা-যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে বাণিজ্য ঘাটতি ছিল ২.৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার যা মোট মার্কিন বাণিজ্য ঘাটতির ০.২৮ শতাংশ। সুতরাং শ্রীলংকার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের কোনোরকম বাণিজ্য ঘাটতি যদি নাও থাকত, মার্কিন অর্থনীতিতে এর কোনো প্রভাবই পড়ত না।

এ অবস্থায় প্রতিকারের বিষয়ে প্রতিবেদনের জন্য অপেক্ষা না করেই, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ঘাটতি কমানোর উপায় হিসেবে পারস্পরিক শুল্কের প্রস্তাব করেছেন। এর অর্থ হলো, আমেরিকা যেসব পণ্য রপ্তানি করে বা রপ্তানি করতে চায়, তার ওপর শ্রীলংকার বিদ্যমান শুল্ক শ্রীলংকারই প্রধান রপ্তানি পণ্যগুলোর ওপর প্রযোজ্য হবে। পণ্যগুলো হচ্ছে- পুরুষ ও মহিলাদের অন্তর্বাস, মহিলাদের বাইরের পোশাক, পুরুষদের বাইরের পোশাক, বায়ুসংক্রান্ত এবং রিট্রিটেড রাবার টায়ার এবং টিউব, টি-শার্ট, গ্লাভস, টেক্সটাইলের মিট এবং মিটেন, উষ্ণ কাপড় (জার্সি, পুলওভার ইত্যাদি), মোটরযান এবং যন্ত্রাংশ, সক্রিয় পোশাক/স্পোর্টসওয়্যার এবং শিশুদের পোশাক।

যেহেতু শ্রীলংকার শুল্ক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আরোপিত শুল্কের চেয়ে বেশি, তাই এটি ফলপ্রসূ হবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে ৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের রপ্তানি আয় হ্রাস পাবে। পারস্পরিক শুল্ক কার্যকর করা অত্যন্ত কঠিন এবং এটি বাস্তবায়নের সম্ভাবনা রয়েছে এরকম অনুমানও স্থূল।

দ্বিপক্ষীয় ঘাটতি কমাতে বা দূর করতে (সামগ্রিক ঘাটতির দিক থেকে সামান্য; কিন্তু ২০২৪ সালে যুক্তরাষ্ট্র থেকে শ্রীলংকায় আমদানি করা ৩৬৮.২ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের পণ্যের তুলনায় বড়) মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি বৃদ্ধি বিবেচনা করা যেতে পারে। প্রকৃতপক্ষে, একটি মার্কিন পরামর্শক সংস্থার একজন বাণিজ্য বিশেষজ্ঞ সম্প্রতি একটি ওয়েবিনারে পরামর্শ দিয়েছেন যে শ্রীলংকার উচিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে আরও কৃষি পণ্য আমদানি করা।

পণ্য ও পরিষেবা

যে কোনো পণ্যের আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের নির্ভরযোগ্য উপাত্ত সহজেই পাওয়া যায় কারণ পণ্যগুলো শুল্ক বিভাগের মাধ্যম দিয়ে যায়। অন্যদিকে পরিষেবার ক্ষেত্রে অর্থ প্রদানের পরিমাণ বের করা কঠিন কারণ তা শুল্ক বিভাগের মাধ্যমে হয় না। অতএব, পরিষেবার ক্ষেত্রে বাণিজ্যের উপাত্ত অসম্পূর্ণ এবং অবিশ্বস্ত। ফলস্বরূপ, যারা আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের কথা বলেন তারা কেবল পণ্যের বাণিজ্য সম্পর্কে কথা বলেন। এর ফলে পুরা ধারণাটির বিকৃতি ঘটে।

আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বিশ্লেষণের জন্য সাধারণত ব্যবহৃত মাধ্যাকর্ষণ মডেলগুলোর অন্তর্নিহিত ভিত্তি হলো: যেহেতু দূরবর্তী ক্রেতাদের সঙ্গে বাণিজ্য করতে বেশি খরচ হয়, তাই বেশিরভাগ বাণিজ্য নিকটবর্তী দেশগুলোর সঙ্গেই হয়। বিশ্ব মানচিত্রে শ্রীলংকা আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান প্রায় দুই প্রান্তে। আশা করা যায় যে শ্রীলংকায় মার্কিন পণ্য রপ্তানি কম হবে। তবে, অস্বাভাবিক বিষয় হলো শ্রীলংকা এই দূরবর্তী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অনেক বেশি পণ্য রপ্তানি করে। এটি কম শুল্কের প্রভাবের পরিবর্তে শ্রীলংকার রপ্তানির মূল্য প্রস্তাবের ইঙ্গিত দেয়।

এখন ২.৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের ঘাটতি পূরণ করতে মার্কিন রপ্তানিকারকরা শ্রীলংকায় তাদের বিক্রীত পণ্যের পরিমাণ চারগুণ করতে পারবে এমনটা ভাবা কঠিন। তাই এক্ষেত্রে ভিন্ন ভিন্ন পথ বের করতে হবে।

বেশিরভাগ ধরনের পরিষেবা রপ্তানির ক্ষেত্রে দূরত্ব গুরুত্বপূর্ণ নয়। ফেসবুক এবং উবারের মতো বিশ্বব্যাপী প্ল্যাটফর্ম কোম্পানিগুলোর শক্তিশালী অবস্থান, AWS এবং Microsoft Azure-এর মতো ক্লাউড প্রদানকারীদের প্রাধান্য এবং প্রদত্ত পরিষেবার জন্য মার্কিন সংস্থাগুলো দ্বারা নিয়মিতভাবে সংগৃহীত রয়্যালটি পরিপ্রেক্ষিতে এর প্রমাণ পাওয়া যায়।

এক্ষেত্রে তাই প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সমস্যা সূত্রকে বাস্তবতার নিরিখে পুনর্বিন্যাস করা উচিত যা বাণিজ্যকে পণ্য এবং পরিষেবা উভয় ক্ষেত্রেই অন্তর্ভুক্ত করে। তারপর দেখা যাবে যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ক্ষুদ্র অর্থনীতির শ্রীলংকা থেকেও প্রচুর পরিমাণে আয় করে। এমনকি গালগল্প ফাঁদা পরামর্শক সংস্থার কর্মকর্তার এই বক্তব্য যে আমাদের মতো দেশগুলো সর্বদা “খাই, খাই করে”, সেটিও ভুল প্রমাণিত হবে। দেখা যাবে, তিনি তার নেতার বিভ্রান্তিকর চিন্তাভাবনা এবং সেগুলোকে অপ্রচলিতভাবে শ্রেণিবদ্ধ করার বিষয়টি পাইকারিভাবে গ্রহণ করে বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছিলেন।

দক্ষতার দারিদ্র্য

আমার মনে আছে চার দশক আগে পরিষেবা বাণিজ্যের ওপর আরও ভালো উপাত্ত তৈরি করার এবং বাণিজ্য চুক্তির মধ্যে পরিষেবাতে বাণিজ্য অন্তর্ভুক্ত করার জন্য মার্কিন চাপ সম্পর্কে সেদেশের বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলেছিলাম। প্রথম এই ধরনের চুক্তি ছিল ১৯৮৮ সালে স্বাক্ষরিত কানাডা-মার্কিন মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি। তাদের প্রচেষ্টার ফলে ১৯৯৮ সালে পরিষেবা বাণিজ্যের ওপর বহুপক্ষীয় সাধারণ চুক্তি কার্যকর হয়।

এই বিশেষজ্ঞদের কাজটি এই সম্ভাবনার ওপর ভিত্তি করে নির্ধারিত হয়েছিল যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র উৎপাদনে ক্রমশ অপ্রতিযোগিতামূলক হয়ে উঠবে। তারা বিশ্বাস করত যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থে একটি আন্তর্জাতিক আইনি কাঠামো গঠন করার ফলে পরিষেবাগুলোর ক্ষেত্রে তুলনামূলক সুবিধা পাওয়া সম্ভব। ভারতের মতো দেশে পরিষেবার তুলনামূলক বৃদ্ধি, সব ক্ষেত্রে নয়, স্থানান্তরিত করার বিষয়টা তারা ধরতে পারেনি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় স্বার্থকে এগিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করার ফলে তারা অন্যান্য দেশের জন্যও দরজা খুলে দিয়েছে।

মার্কিন সরকারের পক্ষের বর্তমান বিশেষজ্ঞরা বহুপক্ষীয় বাণিজ্য রূপরেখা তৈরিকারীদের তুলনায় কম দক্ষতার বলে মনে হচ্ছে। তাদের নেতা “শুল্ক অভিধানে সবচেয়ে সুন্দর শব্দ” বলার ফলে তারা শুল্কের বিপরীত-উৎপাদনশীল প্রকৃতি সম্পর্কে যা জানত তা ভুলে গেছে। তারা আশা করে যে বিশ্বের অন্য প্রান্তের একটি দরিদ্র দেশ নিজেদের অর্থনৈতিক কাঠামো, দুর্বল রপ্তানি কর্মক্ষমতা এবং ঋণের বোঝার প্রতি কোনো মনোযোগ না দিয়েই আরও কম মূল্যের, উচ্চ-ভলিউম পণ্য, যেমন কৃষি পণ্য আমদানি করবে।

একই ওয়েবিনারে আরেকজন বিশেষজ্ঞ বায়ু এবং সৌরশক্তির বিরুদ্ধে কথা বলেছেন কারণ চীন ফটোভোলটাইক কোষের মতো প্রয়োজনীয় উপকরণ তৈরিতে একটি প্রভাবশালী অবস্থান প্রতিষ্ঠা করেছে। তার মতে, জলবায়ু পরিবর্তন ভবিষ্যতের ঝুঁকি ছিল যখন আমেরিকান দারিদ্র্য একটি বর্তমান সমস্যা সেটিকে অগ্রাধিকার দেয়া উচিত। জলবায়ু পরিবর্তন ইস্যু বাদ দিলেও বায়ু এবং সৌরশক্তির বিষয়টি অগ্রাধিকার দেয়া শ্রীলংকার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ছিল কারণ এটি ব্যয়বহুল এবং অস্থিতিশীল মূল্যের জীবাশ্ম জ্বালানি আমদানির জন্য শ্রীলংকা তার মোট আমদানি বিলের এক-চতুর্থাংশ প্রতিশ্রুতিবদ্ধ করতে পারেনি। শুধুমাত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অপছন্দ করে বলেই শক্তি উৎপাদনের জন্য সস্তা উপকরণগুলোকে অস্বীকার করা শ্রীলংকার জাতীয় স্বার্থের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।

এই ধরনের উপদেষ্টাদের কারণেই প্রধানমন্ত্রী মোদি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ভারতের সঙ্গে মার্কিন পণ্য-বাণিজ্য ঘাটতির কারণে অতিরিক্ত জরিমানা দেয়ার ব্যাপারে একটি সহজ চুক্তি করলেন (ভারত শীর্ষ দশের মধ্যে রয়েছে)। মার্কিন অপরিশোধিত তেল ভারতের জন্য সাশ্রয়ী না হওয়া এবং জলবায়ুর ক্ষতি সত্ত্বেও তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে আরও তেল এবং গ্যাস, সেইসঙ্গে F-35 কিনতে সম্মত হন।

কী করা যেতে পারে?

ক্ষুদ্র অর্থনীতির শ্রীলংকার পক্ষে বিভ্রান্ত মার্কিন নীতিনির্ধারকদের শিক্ষিত করা সম্ভব নয়। আরও বেশি অপরিশোধিত তেল বা ভুট্টা কিনে তাদের শান্ত করার ক্ষমতা না থাকায়, শ্রীলংকা তাৎক্ষণিকভাবে সমস্ত শুল্ক কমাতে পারে। এটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানিকে শাস্তিমূলক শুল্ক থেকে রক্ষা করবে। তার চেয়েও বড়, এটি শ্রীলংকার ব্যবসায়ীদের বিশ্বব্যাপী উৎপাদন নেটওয়ার্কের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের ক্ষেত্রে অন্যতম প্রধান বাধা দূর করবে। এনপিপি ইশতেহারে প্রতিশ্রুতি দেয়া যে কোনো কিছুর চেয়ে এটি একটি উৎপাদনভিত্তিক কার্যকরী অর্থনীতি গড়ে তুলতে সাহায্য করবে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বহুপক্ষীয় বাণিজ্য শাসন কাঠামো ভেঙে ফেলার জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ বলে মনে হচ্ছে। এই জিনিসগুলো পরিবর্তন করা একটি ছোট দেশের ক্ষমতার মধ্যে নেই। শ্রীলংকার উচিত প্রথমে ভারত এবং চীনের সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তির মাধ্যমে এবং তারপর বৃহৎ এশিয়ান বাণিজ্য ব্লক আরসিইপিতে যোগদানের মাধ্যমে এশিয়ার দ্রুত বর্ধনশীল বাজারগুলোতে ঝুঁকে পড়া। আন্তর্জাতিক আইন এবং চুক্তির প্রতি অসম্মান এবং অহংকারের কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আর শ্রীলংকার নির্ভরযোগ্য অর্থনৈতিক অংশীদার নয়।

রোহান সামারাজিবা: প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, লার্ন এশিয়া (LIRNEasia) ও এশিয়ার আইসিটি নীতি ও নিয়ন্ত্রণ থিঙ্ক ট্যাঙ্ক বিশেষজ্ঞ।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ