আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত না হলে গণতন্ত্র আসবে না
আইন শুধু রাষ্ট্র চালনার নীতি-প্রক্রিয়া না, রাষ্ট্রীয় আইন আধুনিক বিশ্বে একটা রাষ্ট্রের মনস্তাত্ত্বিক আচরণের মূল ভিত্তি। আইন শুধু যে সরকারকে বৈধতা দেয় তা না, আইন ব্যক্তি মানুষকেও অধিকার দেয়। রোমানরা যখন প্রথম গ্রিক আইন ও নিজেদের আইনগুলো সংরক্ষণ করল, তারা ব্যক্তি মানুষের কিছু অধিকারও দিল, তারা বোঝালো জনগণকে, তোমাকে রক্ষা করার জন্যই তো এ আইন!
আইনের বিবর্তনের সঙ্গে জড়িত কমপক্ষে ৩ হাজার বছরের ইতিহাস। আইন-প্রতিষ্ঠা ও প্রয়োগের মনস্তত্ত্ব বোঝা অত্যন্ত জটিল একটি বিষয়। হাজার বছরের রাজনৈতিক ইতিহাসে অন্তত এটুকু কথা জনগণ আদায় করতে পেরেছে যে রাষ্ট্রটা জনগণেরই, সরকার সেখানে জনগণের সেবক; কিন্তু আমরা দেখছি আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সরকার জনগণের শাসক হয়ে উঠছে কেবল, সেবক হচ্ছে না। বিশেষ করে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এটা খুব বড় করে সত্য।
গত ৪৩ বছরেও বাংলাদেশে আইনি শাসক প্রতিষ্ঠা হয়নি। এবং তা হওয়ার কারণে আমরা বারবার খারাপ পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে গেছি। দিন দিন আইন আরও ভয়াবহ হয়ে উঠছে যেন। বিগত আওয়ামী ফ্যাসিস্ট শাসন অবসানের পর আমরা আশা করেছিলাম সুষ্ঠু সুন্দর আইনি শাসন ফিরে আসবে বাংলাদেশে। কিন্তু স্রোত ও সময় উল্টো দিকেই বইতে শুরু করেছে। জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানের পর থেকেই বাংলাদেশে চলছে ঢালাও হত্যা মামলা, গ্রেপ্তার৷
আজ বুধবার (২১ মে) সংবাদমাধ্যমে প্রাপ্ত খবরে জানা যায়, পুলিশ সদর দপ্তরের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, ৫ আগস্টের পর থেকে সারাদেশে এ পর্যন্ত ১ হাজার ৪৯৯টি মামলা দায়ের হয়েছে। এসব মামলায় হত্যা, হত্যাচেষ্টা, হামলা ভাঙচুর, মারধর, অগ্নিসংযোগ, ভয়-ভীতি প্রদর্শন, লুটপাট, চাঁদাবাজি ও দখলবাজির অভিযোগ করা হয়েছে। এর মধ্যে হত্যা মামলা হয়েছে ৫৯৯টি আর অন্যান্য মামলা হয়েছে ৯০০টি। এর মধ্যে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ঢাকাসহ সারা দেশের থানা ও নিম্ন আদালত মিলিয়ে মামলা দায়ের হয়েছে মোট ৩২৪টি।
অনেক মামলার ‘ভিত্তি’ নিয়ে যেমন প্রশ্ন উঠেছে, প্রশ্ন উঠেছে গ্রেপ্তার ও জামিনের অধিকার নিয়েও৷ প্রশ্নগুলো আবার সামনে এনেছে অভিনেত্রী নুসরাত ফারিয়ার সোমবার গ্রেপ্তার ও মঙ্গলবার জামিন প্রাপ্তির ঘটনা৷ সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী সাইদ আহমেদ রাজা সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন, "গ্রেপ্তার বা জামিনের ক্ষেত্রে পিক অ্যান্ড চুজ করা হচ্ছে।’ অর্থাৎ, যাকে ইচ্ছে তাকেই তুলে আনা হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে প্রকৃত ও বড় অপরাধী ছাড় পেয়ে যাচ্ছে, কিন্তু নামমাত্র অপরাধের সাথে হয়তো কেউ জড়িত তাকে ধরে এনে এক প্রকার নাটকীয় পরিবেশ সৃষ্টি করা হচ্ছে।
জানা গেছে, ঢালাও মামলায় এমনও ব্যক্তির নাম দেয়া হয়েছে যে বাদীও জানেন না যে বিবাদী আসলে কে! আসামি করে, আসামি করার ভয় দেখিয়ে টাকা দাবি, কিংবা মামলা থেকে নাম বাদ দেওয়ার নামে বাণিজ্যের অভিযোগ দিন দিন বাড়ছে। পুলিশের বিরুদ্ধেও এমন ‘বাণিজ্যে’ যুক্ত হওয়ার অভিযোগ উঠেছে। এমনকি শুধু সাধারণ মানুষ নয়, গণহত্যা মামলায় ফাঁসিয়ে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে খোদ সহকর্মীর কাছ থেকেও ঘুস দাবির অভিযোগ উঠেছে পুলিশের বিরুদ্ধে।
তার মানে দেশে এক চরম বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি চলছে। এবং সরকারের পক্ষ থেকেও একেক কথা বলা হচ্ছে। সরকারই গ্রেফতার করে বা করায়, আবার তাদের পক্ষ থেকেই আরেকজন এটাকে সমালোচনা করে। তার মানে সরকারের মধ্যেও আসলে কেন্দ্রীয় কোনো সমন্বয় নেই। তাহলে কে গ্রেফতার হবে, কেন হবে তা সরকার জানবে না কে? অনেক গ্রেফতারের ঘটনা না কি সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষও জানে না। এবং আমরা দেখেছি গ্রেপ্তার করা হয়েছে মব-জাস্টিসে এবং জামিনও দেয়া হয়েছে মব-জাস্টিসে।
দেশের বর্তমানে পরিস্থিতি দেখে, গণ-অভ্যুত্থানের সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত ছিলেন এমন অনেকেও উদ্বিগ্নতা জানিয়েছেন। অনেকের প্রশ্ন, এই জন্যই কি গণঅভ্যুত্থান হয়েছিল? সাধারণ জনগণের দাবি, প্রকৃত আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা হোক। রাজনীতিবিদ ও আইনবিদরাও বলছেন, প্রকৃত আইনি শাসন প্রতিষ্ঠা না হলে গণতান্ত্রিক পরিবেশ ফিরে আসবে না। আর গণতান্ত্রিক পরিবেশ ফিরে না আসলে এরকম অরাজকতা বাড়তেই থাকবে, যা কোনোভাবেই কাম্য নয়।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে