পৃথিবীর গভীর অসুখের সময় বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের চলে যাওয়া দুঃখের
বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সঙ্গে আমার সামনাসামনি কথা হয়েছে মোটে দুবার। প্রথমবার, ২০০৬ সালে। তখন বিধানসভা নির্বাচনের দিনক্ষণ ঘোষণা হয়ে গেছে। সেই প্রথম বামফ্রন্ট লড়ছে একদা প্রমদ দাশগুপ্তের ভাবশিষ্য, কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের ভাইপো বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির (মার্কসবাদী) অবিসংবাদিত নেতা জ্যোতি বসু একটানা মুখ্যমন্ত্রী থাকার পর, বয়সের কারণে পদ থেকে সরে দাঁড়ানোর পরে মুখ্যমন্ত্রিত্বের ব্যাটন, পার্টির নির্দেশে হাতে তুলে নিতে বাধ্য হয়েছেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। এটা পশ্চিমবঙ্গের এক নতুন অধ্যায়ের সূচনাকাল। বলা যেতে পারে এক রাজনৈতিক সন্ধিক্ষণে বাম মহলের বড় রর অংশ ঈষৎ দোলাচলে তাদের নতুন ক্যাপ্টেনের পারফরম্যান্স নিয়ে।
পার্টির অনেক তাত্ত্বিকদের আড়ালে আবডালে বলতে শুনেছি যে, বুদ্ধ দা পারবেন তো। ততদিনে তৎকালীন বিরোধী নেতা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কোমর বেঁধে আসরে নেমেছেন, জ্যোতি বসুর মতো হেভিওয়েট প্রতিদ্বন্দ্বী সরে যাওয়ায়। তুলনায় দুর্বল প্রতিদ্বন্দ্বীকে সহজেই হারাবেন ভেবে আওয়াজ তুলেছেন, হয় এবার, নয় নেভার। ততদিনে দলের কর্মী সমর্থকদের মধ্যে যে কিছুটা হলেও আদর্শের খামতি দেখা যাচ্ছে সে খবর বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য রাখতেন। একদিকে জ্যোতি বসুর মতো প্রবল ইমেজ, অন্যদিকে দলের মধ্যে মেধার সংখ্যা বৃদ্ধি ও বিরোধী দলের ক্রমবর্ধমান বিক্রম নিশ্চিত মনে মনে চাপে রেখেছিল বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে। এমন এক কঠিন সময়ে প্রথম সরাসরি বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সঙ্গে দেখা। শিলিগুড়ি তে আছেন শুনে আমার প্রিয়জন বিশিষ্ট ফিল্ম মেকার রাজা সেন বললেন যে, চল আমরা যাই দেখা করে আসি। এক শহরে ঘটনাচক্রে যখন আমরাও আছি, চল।
রাজাদার সঙ্গে আগে থেকেই ভালো সম্পর্ক বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের। ফলে গেলাম। তখন রাত ৮টা-সোয়া ৮টা হবে। সার্কিট হাউসে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন তিনি। এখন ভাবলে অবাক লাগছে যে, সেরকম কোনো সিকিউরিটি নেই। দুই-একজন পুলিশ। মনে রাখতে হবে তখনো কিন্তু রাজ্যের প্রভাবশালী মন্ত্রী ও পার্টির গুরুত্বপূর্ণ নেতা তিনি। অথচ কোথাও সেভাবে কোনো নিরাপত্তা বলয় নেই। রাজাদা স্বভাবসিদ্ধ ভাবে ডোন্ট পরোয়া মেজাজে গটগট করে দোতলায় উঠে কাকে যেন বললেন, দেখা করতে চাই। নাম ধাম জেনে সে ভেতরে ঢুকে গিয়েই দ্রুত ফিরে এসে গদগদ মুখে জানিয়ে দিল যে, আপনারা ভেতরে যান। দরজা খুলে ভেতরে গিয়ে দেখি, বুদ্ধদেব বাবু আধশোয়া হয়ে বিশ্রাম করতে করতে উঠে পড়লেন আমাদের দেখে। হাসিমুখে বললেন, কী খবর রাজা, শিলিগুড়িতে কোনো কাজে, শুটিং আছে! তারপর আড্ডা চলতে লাগল।
আমার সঙ্গে রাজা দা আলাপ করাতেই, বললেন, তুমি তো জোছন দার ভাইপো। গুজরাট দাঙ্গা নিয়ে ছবি করেছ। তোমার ছবি নন্দনে দেখেছি আমি। আমার কাকা, বিশিষ্ট নাট্যব্যক্তিত্ব জোছন দস্তিদারের সঙ্গে গভীর সম্পর্ক জানতাম; কিন্তু আমাকে চিনতেন ভাবিনি। তবে এটা জানতাম যে সংস্কৃতি নিয়ে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের আগ্রহ যথেষ্ট। আড্ডা মারতে মারতে এক বিষয়ে আমি যেটা মুগ্ধ হয়ে লক্ষ্য করছিলাম, দুদিন বাদে নির্বাচন। কঠিন পরীক্ষা। দলের তো বটেই, নিজের রাজনৈতিক কেরিয়ারেরও। অথচ অদ্ভুত শান্ত তিনি। রাজনীতির বাইরে কথা হচ্ছে। মূল বক্তা তিনি। আমরা নীরব শ্রোতা। রিলাক্স মুড। কথায় কথায়, থাকতে না পেরে বলেই ফেললাম। ততক্ষণে তিনি বুদ্ধ দা হয়ে গেছেন।
হো হো হো করে হাসলেন তিনি। ও রকম প্রাণখোলা হাসি তারপর আমি অন্তত আর দেখিনি বুদ্ধ দার মুখে। বললেন, আমি তো ক্রিকেটার। খারাপ পিচেও ব্যাট করতে জানি। সেবারের নির্বাচনে বোঝা গেল সত্যিই তিনি খারাপ পিচেও ব্যাট করতে জানেন। বিরোধী দলের লম্ফঝম্প ফুৎকারে উড়িয়ে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে বামফ্রন্ট দুই-তৃতীয়াংশ মেজরিটি নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের মসনদে বসল। রাজ্যের নতুন মুখ্যমন্ত্রী হলেন আপাদমস্তক ভদ্রলোক বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য।
মুখ্যমন্ত্রী হবার পর দ্বিতীয়বার ও শেষবারের মতো তার সঙ্গে যখন কথা হচ্ছিল, তখন তিনি করপোরেট পুঁজির ভাষাতে, ব্র্যান্ড বুদ্ধ। রাজ্যের শিল্পায়ন নিয়ে স্বপ্ন দেখছেন ও দেখাচ্ছেন। নিও লিবারেল ইকোনমির হাতছানি তখন বামেদের সাবেক রাজনৈতিক ঘরানার বাইরে নিয়ে আসছে। পুরোনো কৃষক মজুর বাদ দিয়ে নতুন উত্থিত মধ্যবিত্ত বামেদের শ্রেণি মিত্র। উন্নয়নের সংজ্ঞা তখন যে কোনো বুর্জোয়া দলের মতোই স্কাইস্ক্যাপার, এক্সপ্রেসওয়ে, শপিং মল ইত্যাদি ইত্যাদি। অনেক কমিউনিস্টদের কাছে তিনি গর্বাচেভ। এই পশ্চিমবঙ্গের গ্লস্তনস্তের আচরণে তখন সাবেক বামপন্থিরা অনেকেই ক্ষুব্ধ। তবুও তিনি অবিচল রাজ্যের শিল্পায়নের পক্ষে।
নন্দীগ্রাম, সিঙ্গুর নিয়ে রাজ্যের উত্তাল সময়ে ওর সঙ্গে শেষ সাক্ষাৎ। তখনো শান্ত, স্থির। আগের মতোই হাসিমুখ। আত্মবিশ্বাসী। স্বপ্নদ্রষ্টা। সেই ইন্টারভিউ নেবার সময় সঙ্গে আমার স্ত্রী ছিলেন। বাংলা সাহিত্যের অধ্যাপক তিনি, বুদ্ধ দাকে জিজ্ঞেস করলেন পশ্চিমবঙ্গে বাংলা ভাষা সাহিত্যের ভবিষ্যৎ নিয়ে। বুদ্ধ দা বলেছিলেন মনে আছে যে, আশঙ্কা করার কারণ নেই। যতই আশঙ্কা থাক, বাংলা ভাষা সাহিত্য থাকবেই। রাজনৈতিক বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য নিয়ে যত বিতর্ক থাক; কিন্তু প্রেসিডেন্সি কলেজের প্রাক্তনীর বাংলা শিল্প-সাহিত্য নিয়ে অনুরাগ নিয়ে ছিল নিখাদ। তা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। পৃথিবীর গভীর অসুখের সময় বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের চলে যাওয়া দুঃখের। যন্ত্রনার।
সৌমিত্র দস্তিদার: ভারতীয় চলচ্চিত্র নির্মাতা ও লেখক।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে