শত সমালোচনার মুখেও মূল সড়কে ‘উড়ছে’ ব্যাটারিচালিত রিকশা
রাজধানীর অলিগলি ছাপিয়ে মূল সড়কে এখনো দাপিয়ে বেড়াচ্ছে ব্যাটারিচালিত ও অটোরিকশা বা ইজিবাইক। ‘বিপজ্জনক’ বলে বহুল সমালোচিত এসব যান মূল সড়কে উঠতে পারবে না- উচ্চ আদালতের সাম্প্রতিক এমন আদেশও উপেক্ষা করে চলেছেন চালকরা। মানছেন না তাদের সঙ্গে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) বৈঠকে হওয়া একই সিদ্ধান্তও।
কেউ কেউ যদিও বলছেন, পায়েচালিত রিকশার চেয়ে এগুলো ভালো, ছোটা যায় দূরের গন্তব্যে, সময়ও লাগে কম। তবে এসব রিকশা, ইজিবাইকের কারণে ঢাকার রাস্তা অনিরাপদ হয়ে উঠেছে বলে মনে করছেন বিভিন্ন যানবাহনের চালক ও যাত্রীসহ অধিকাংশ ঢাকাবাসী। তাদের মতে, গতি বাড়লেও এসব রিকশার ব্রেক বা নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটেনি। লক্কড়-ঝক্কড় কাঠামো আর নড়বড়ে ব্রেকের এ বাহনগুলো তাই প্রায়ই পড়ছে দুর্ঘটনায়। আবার চলাচল নিষিদ্ধ সড়কগুলোতেও সোজা কিংবা উল্টোপথে চলছে এগুলো।
এদিকে, শিশু-কিশোরদেরও অনেক সময় এই উড়ান যান (ব্যাটারিচালিত রিকশা) চালাতে দেখা যায়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আনাড়ি জনবল এই খাতে সবচেয়ে বেশি। ব্যাটারিচালিত রিকশা-ইজিবাইকের দৌরাত্ম্য কমাতে পানি অনেক দূর গড়িয়েছে। প্যাডেলচালিত রিকশা মালিকদের ঐক্যজোটের রিটের পরিপ্রেক্ষিতে ১৯ নভেম্বর সড়ক দুর্ঘটনা কমাতে তিন দিনের মধ্যে ঢাকার রাস্তায় ব্যাটারিচালিত রিকশা ও অটোরিকশা চলাচল বন্ধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। একই সঙ্গে এসব যানবাহনের কার্যক্রম বন্ধে তাদের ব্যর্থতা কেন বেআইনি ঘোষণা করা হবে না তা ব্যাখ্যা করতে রুলও জারি করেন।
এ আদেশের পর থেকে রাজধানীজুড়ে আন্দোলনে নামেন ব্যাটারিচালিত রিকশা ও অটোরিকশা চালকরা। যাত্রাবাড়ী, প্রেস ক্লাব, শাহবাগ এবং আগারগাঁওয়ে রাস্তা অবরোধও করেন তারা। সেনা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে তাদের সংঘর্ষে বিশৃঙ্খলা চলে কয়েকদিন। এ পরিস্থিতিতে হাইকোর্টের আদেশের বিরুদ্ধে আপিল করেন রাষ্ট্রপক্ষ। এর শুনানি করে আপিল বিভাগের চেম্বার বিচারপতি মো. রেজাউল হক ২৪ নভেম্বর হাইকোর্টের আদেশে একমাসের স্থিতাবস্থা জারি করেন। ব্যাটারিচালিত রিকশা নিয়ে হাইকোর্টের রুল নিষ্পত্তিও করতে বলেন, এক মাসের মধ্যেই।
এতে ঢাকার অলিগলিতে আপাতত ব্যাটারিচালিত রিকশা চলাচলের পথ খোলে। রিকশাচালকদের আন্দোলনেরও আপাত অবসান হয়। এরপর ২৭ নভেম্বর ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) সদর দপ্তরে ব্যাটারিচালিত রিকশাচালক, মালিক, গ্যারেজ মালিক ও রিকশা-ভ্যান-ইজিবাইক শ্রমিক ইউনিয়নের প্রতিনিধিদলের সঙ্গে বৈঠকে প্রধান সড়কে এখন থেকে কোনো অটোরিকশা চলবে না বলে জানান পুলিশ কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী।
ডিএমপি কমিশনার বলেন, প্রধান সড়কে অটোরিকশা না চললেও ভেতরের সড়কগুলোতে আগের মতো এসব যান চলবে। এ ছাড়া নতুন কোনো অটোরিকশা যেন রাজধানীর রাস্তায় না নামে, সে বিষয়ে সবাইকে সতর্ক থাকার তাগিদ দেন তিনি। রিকশা ইজিবাইক শ্রমিক ইউনিয়নের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আরিফুল ইসলাম নাদিম বলেন, ‘যেসব প্রধান সড়কে বাস চলে, সেগুলোতে যেন ব্যাটারিচালিত রিকশা না চলে, পুলিশের পক্ষ থেকে সে আহ্বান জানানো হলে আমরা একমত হয়েছি’।
তিনি বলেন, ‘নতুন করে আর কোনো রিকশা যেন রাস্তায় না নামে, সে আহ্বানও জানানো হয় বৈঠকে। ঢাকার বাইরে থেকে এসব বাহন না ঢোকার বিষয়েও একমত হয়েছি।’ বৈঠকে ছিলেন অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশনস) মো. ইসরাইল হাওলাদার, অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ট্রাফিক) খোন্দকার নজমুল হাসানসহ ডিএমপি ও ঢাকার বিভিন্ন থানার পুলিশ কর্মকর্তা, ব্যাটারিচালিত রিকশাচালক, মালিক, গ্যারেজ মালিক ও রিকশা-ভ্যান-ইজিবাইক শ্রমিক ইউনিয়নের প্রতিনিধিরা।
গত সরকারের আমলেও গত ১৫ মে ঢাকার সড়কে ব্যাটারিচালিত কোনো রিকশা চলাচল করতে পারবে না বলে ঘোষণা আসে। সেদিন বিআরটিএ ভবনে সড়ক পরিবহন উপদেষ্টা পরিষদের প্রথম সভায় সে সময়ের সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘ব্যাটারিচালিত কোনো গাড়ি যেন ঢাকা সিটিতে না চলে। আমরা ২২টি মহাসড়কে নিষিদ্ধ করেছি। শুধু নিষেধাজ্ঞা নয়, চলতে যেন না পারে সে ব্যবস্থা নিতে হবে।’
এমন সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে ঢাকায় রাস্তা অবরোধ করেন চালক ও গ্যারেজ মালিকরা। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে সংক্ষুব্ধ চালকদের সংঘর্ষে বেশ কয়েকজনের আহত হওয়ার ঘটনাও ঘটে। এরপর ২০ মে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের তৎকালীন সচিব মাহবুব হোসেন বলেছিলেন, (সাবেক) প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে না জানিয়েই সড়কে ব্যাটারিচালিত রিকশা বন্ধের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। সেদিন তিনি বলেন, রাজধানীতে এসব রিকশা চলতে পারবে, কিন্তু প্রধান সড়কগুলোয় আসতে পারবে না।
এর আড়াই মাসের মাথায় ছাত্র-জনতার তুমুল আন্দোলনে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পরই পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায় এসব রিকশা-ইজিবাইক। শিথিল আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির সুযোগেই মূলত অলি-গলি থেকে বের হয়ে মূল সড়কে উড়ে বেড়াচ্ছে ব্যাটারিচালিত রিকশা ও ইজিবাইক। ৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের পর ভেঙে পড়া পুলিশি ব্যবস্থার সময়ে কিছুদিন ছাত্র-জনতা নিজেদের উদ্যোগে রাস্তায় যান চলাচল নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেছেন। সেসময় অননুমোদিত এসব রিকশার মূল সড়কে চলাচলে বাধা দিতে তাদের আপ্রাণ চেষ্টা করতে দেখা গেছে; কিন্তু এরপর ধীরে ধীরে রাস্তায় ট্রাফিক পুলিশ নামলেও ব্যাটারিচালিত রিকশা চলছে অনেকটাই বাধাহীনভাবে।
এসব অদক্ষ চালকের এলোমেলো চলাচল, আইন না মানার প্রবণতা, উল্টোপথে চলা, যেখানে-সেখানে হুটহাট রিকশা ঘোরানো-সব মিলিয়ে রাজধানীতে রাস্তায় প্রতিদিনই তৈরি হচ্ছে বিশৃঙ্খলা। রাজধানীর মূল রাস্তায় ব্যাটারিচালিত রিকশা-ইজিবাইকের দাপট এতোটাই বেড়েছে যে, এসবের চলাচল বন্ধে কিছুদিন আগে বিক্ষোভে নেমেছিলেন পায়েচালিত রিকশার চালকরা। তবে সুবিধা করতে পারেননি তারাও।
মিরপুর ১২ নম্বর থেকে যাত্রী নিয়ে আগারগাঁওয়ে আসা ব্যাটারিচালিত রিকশাচালক জানান, আগে শুধু রাতে মূল রাস্তায় উঠতেন তারা। এখন পুলিশ কিছু বলে না, তাই সব রাস্তাতেই চালাচ্ছেন। তিনি বলেন, ‘এখন আগের মতো পুলিশ আর ধরে না। এজন্যই সব রাস্তায় চালাইতে পারি। এজন্য বড় রাস্তায়ও এখন ট্রিপ মারি। বড় রাস্তায় আসলে বড় গাড়ির সমানে যাওয়া লাগে। এইটা নিরাপদ না, আমরাও মানি; কিন্তু মেইন রাস্তায় আইলে দূরের ট্রিপ পাওয়া যায়। ইনকাম কিছুটা বেশি হয়।’
ব্যাটারিচালিত রিকশাকে ‘ইঞ্জিনের গাড়ি’ দাবি করে বাড্ডার ব্যাটারিচালিত রিকশাচালক আশিকুর রহমান বলেন, ‘সিএনজিওয়ালারা (অটোরিকশা) মেইন রাস্তায় চালাইতে পারলে আমরাও পারমু। হেরা ইঞ্জিনের গাড়ি চালায়। আমরাও ইঞ্জিনের গাড়ি চালাই’।
এ অবস্থার জন্য ট্রাফিক পুলিশের নিষ্ক্রিয়তাকে দায়ী করেন সিএনজিচালিত অটোরিকশার চালক নাজমুল হোসেন। তিনি বলেন, ‘পুলিশ এখন ডিউটি দেয় না বলে তারা এখন স্বাধীনতা পাইয়া গেছে। তারা এখন যে কোনো রাস্তায় উইঠা যাইতাছে, ত্যাড়া-ব্যাকা (এলোমেলো) কইরা আহে, যেমনে খুশি তেমনে ওভারটেক করে। অটো যদি চলে তাইলে শহরের যানজট কমতো না।’
মিরপুরের বাসিন্দা মিরাজ আলী বলেন, ‘একটা সময় মেইন রোডে চলার কারণে ব্যাটারিচালিত রিকশাকে জরিমানা বা ডাম্পিং করা হতো। এখন এসব বন্ধ আছে। রাস্তায় ট্রাফিক পুলিশও কম। এদের চলাচল নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না।’
মূল রাস্তায় ব্যাটারিচালিত রিকশার চলাচল করা ‘খুবই মারাত্মক’ বলছেন মোহাম্মদপুরের বাসিন্দা রহমত শেখও। তিনি বলেন, ‘এসব রিকশায় দিক-নির্দেশনার লাইট নেই। এতে পেছনের যানবাহনের চালকরা রিকশার গতিবিধি বুঝে উঠতে পারেন না। আবার এসব রিকশার সর্বোচ্চ গতি ঘণ্টায় ৩০ থেকে ৩৫ কিলোমিটার। ফলে পেছনের গাড়িরও গতি কমিয়ে দিতে হয়। এতে সড়কে যানজট তৈরি হয়।’
শ্যামলীতে দায়িত্বরত এক ট্রাফিক সার্জেন্ট বলেন, ‘এখন সময়টাই এমন, কেউ কারও কথা শুনছে না, চারদিকেই বিশৃঙ্খল অবস্থা। সড়কে অটোরিকশা চলে আসছে। তারা স্বাধীনতা পেয়ে গেছে, উল্টা-পাল্টা চালায়।’ ‘আর এখন আমাদের ফোর্সও কম। প্রসিকিউশন দেয়া যাচ্ছে না। এ কারণে তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থাও নেয়া যাচ্ছে না। এমন কোনো সড়ক নেই, যেখানে এখন এসব রিকশা চলছে না’- বলেন তিনি।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে