সমাজ-রাষ্ট্রের জন্য অশনি সংকেত
শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর সম্পর্কের অবনতি
মহাবীর আলেকজান্ডার বলেছিলেন, আমার জীবনের জন্য হয়তো আমি আমার জন্মদাতা পিতার কাছে ঋণী; কিন্তু পৃথিবীতে বেঁচে থাকার জন্য আমাকে সত্যিকার মানুষ করে গড়ে তুলেছেন আমার শিক্ষাগুরু অ্যারিস্টটল।
প্রাচীনকাল থেকেই শিক্ষকের প্রতি শিক্ষার্থীরা প্রদর্শন করেছেন সর্বোচ্চ সম্মান। শিক্ষক মানেই গুরু, পিতা-মাতার সমপর্যায়ে তার স্থান। তদ্রুপ, শিক্ষার্থীদের প্রতিও শিক্ষকেরা প্রকাশ করেন সন্তানতুল্য স্নেহ-মমতা-ভালোবাসা। শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সম্পর্ক কেবল দায়িত্ব-কর্তব্য-দেনা-পাওনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, এটি এমনই এক মহৎ-সম্পর্ক, যা অনেক সময় বয়স ও সম্পর্কের ব্যবধান ঘুচিয়ে অনেক সময় বন্ধুত্বে পর্যন্ত গড়ায়।
কিন্তু দিন দিন এই সুন্দর সম্পর্কটি কেমন যেন অবনতির দিকে যাচ্ছে। অবক্ষয়ের দিকে যাচ্ছে। প্রায়ই পত্রিকার শিরোনাম হয় ‘ছাত্র শিক্ষককে হুমকি দিচ্ছে’; ‘শিক্ষক ছাত্রকে হুমকি দিচ্ছে’।
গতকাল (৫ মার্চ) এমন এক খবর প্রকাশিত হলো যা আমাদের একেবারে স্তম্ভিত করে দিয়েছে। ‘শিক্ষার্থীকে শিক্ষকের গুলি’! সিরাজগঞ্জের শহীদ এম মনসুর আলী মেডিকেল কলেজে শিক্ষার্থী আরাফাত আমিনকে গুলি করেছেন কমিউনিটি মেডিসিনের শিক্ষক রায়হান শরীফ। ওই শিক্ষকের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি ছিলেন রাজশাহী মেডিকেল কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একদল ছাত্রছাত্রী বলেছেন, শিক্ষক রায়হান শরীফ মাঝেমধ্যে ছাত্রীদের ডিভিও কল দিতেন। প্রায়ই তিনি পিস্তল নিয়ে চলাফেলা করতেন। এই অভিযোগের সত্যতা স্বীকার করেছেন সিরাজগঞ্জের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন ও অর্থ) আবদুল হান্নান।
প্রশ্ন হচ্ছে, একজন শিক্ষক কেন পিস্তল নিয়ে চলাফেরা করবেন? ঘটনার দিন তুচ্ছ বিষয় নিয়ে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর কথা-কাটাকাটি হয়। এক পর্যায়ে ওই শিক্ষক রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে গুলি ছোড়েন। ওই গুলিতে আরাফাত আমিন উরুতে গুলিবিদ্ধ হন। খবরটা কতটা ভয়াবহ কল্পনা করা যায়! এক সময় শিক্ষক হয়তো বড়জোর ক্লাসে বেত নিয়ে আসতেন, এখন পিস্তল নিয়ে আসেন! এটা অশনি সংকেত ছাড়া আর কী!
বিপরীতে ২০২৩ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি এমন অভিযোগও জানা গেছে, নকলে বাধা দেয়ায় কলেজ শিক্ষককে পিটিয়ে বদলির হুমকি দিয়েছিল চট্টগ্রামের এক শিক্ষার্থী। গত বছর ময়মনসিংহের একজন শিক্ষক তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছেন, ‘ক্লাসরুম কন্ট্রোল করা যুদ্ধক্ষেত্রে যুদ্ধ করার মতো অবস্থা হয়ে দাঁড়িয়েছে। শিক্ষার্থীরা নিয়মিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আসতে চায় না, এলেও ক্লাসরুমে যেতে চায় না, ক্লাসরুমে যারা যায় তারাও ক্লাস লেকচার শোনার প্রতি মনোযোগী হয় না। লেকচার শোনার পরিবর্তে স্মার্টফোন ও ফেসবুকে চ্যাটিংয়ে অনেক বেশি মনোযোগী।’
সমাজের অসংগতি ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তার প্রভাব সবই উঠে এসেছে উল্লিখিত শিক্ষকের লেখায়। শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সম্পর্কের এই অবনতি দেখে এটাই মনে হচ্ছে যে জাতির জীবনে এক অমানিশার অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছে। অথচ, একটি ঘটনা স্মরণ হলে আজও আমাদের মাথা শ্রদ্ধায় নত হয়ে আসে। ১৯৬৯-এর ১৮ ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে যখন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নেমে পড়েছিল, তখন ক্ষিপ্ত হয়ে পুলিশ সদস্যরা ছাত্রদের ওপর গুলি করার প্রস্তুতি গ্রহণ করে। তখন এগিয়ে আসেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন প্রক্টর ড. শামসুজ্জোহা স্যার। তিনি ছাত্রদের গুলি না করার জন্য অনুরোধ করেন। ‘আজ আমি ছাত্রদের রক্তে রঞ্জিত, এর পর কোনো গুলি ছাত্রের গায়ে না লেগে যেন আমার গায়ে লাগে’। এক পর্যায়ে ড. শামসুজ্জোহা স্যারকেই গুলি করে পুলিশ। আর এভাবেই নিজের জীবন দিয়ে ছাত্রদের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসার নজির স্হাপন করে গেছেন তিনি। শিক্ষার্থীদের প্রতি ড. শামসুজ্জোহা স্যারের এই অকৃত্রিম ভালোবাসা শুধু ছাত্র সমাজ নয়, আপামর জনতার হৃদয়ে চির অম্লান হয়ে আছে। প্রতি বছর ১৮ ফেব্রুয়ারি শামসুজ্জোহা দিবস হিসেবে এই দিনটি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পালন করা হয়।
কলুষিত অধ্যায় নয়, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর এমন মহান ঘটনাগুলোই জাতির জীবনে অক্ষয় হয়ে থাকুক। তাহলেই কেবল সুন্দর একটি শিক্ষায়তন গড়ে উঠবে। আর শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানের সুবাতাসই জাতির জীবনে ছড়িয়ে দিবে মঙ্গলময় বার্তা।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে