খেলাপি ঋণ ব্যাংক খাতে কতটা প্রভাব বিস্তার করে
বাংলাদেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থায় খেলাপি ঋণ বহুল আলোচিত একটি প্রসঙ্গ। খেলাপি ঋণ শুধু ব্যাংকিং খাতের জন্যই সমস্যা সৃষ্টি করছে তা নয়, এটি আসলে আমাদের জাতীয় অর্থনীতির জন্যই একটি জটিল সমস্যায় পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশের আর্থিক লেনদেনের ৮৬ শতাংশই ব্যাংকের মাধ্যমে হয়ে থাকে। কাজেই ব্যাংকিং খাত যদি কোনো সমস্যায় পড়ে, তাহলে এই সমস্যা পুরো অর্থনীতির ওপরই সঞ্চারিত হয়। ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ যদি বর্তমান অবস্থায় পৌঁছাতো, তাহলে ব্যাংকগুলো আরও দক্ষতার সঙ্গে জাতীয় অর্থনীতিতে অবদান রাখতে পারতো। এই খেলাপি ঋণ দিয়ে (১ লাখ ৫৬ হাজার ০৩৯ কোটি টাকা) যেসব মেগা প্রকল্প আমরা বাস্তবায়ন করছি, তার অনেকই সম্পন্ন করা যেত।
বিশ্বের কোনো দেশের ব্যাংকিং খাতই সম্পূর্ণরূপে খেলাপি ঋণ মুক্ত নয়। তবে খেলাপি ঋণের একটি সহনীয় মাত্রা আছে, যা ২-৩ শতাংশ। আমাদের দেশের ব্যাংকিং খাতের খেলাপি ঋণের পরিমাণ অনেক আগেই এই মাত্রা অতিক্রম করে গেছে। খেলাপি ঋণ যেহেতু হয়ে গেছে, তাই অর্থনীতিতে তার প্রভাব নিয়ে কিছু আলোচনা করা যেতে পারে। খেলাপি ঋণ দেশের অর্থনীতির ওপর যতটা না প্রভাব ফেলে, তার চেয়ে অনেক বেশি প্রভাব সৃষ্টি করে ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ পরিচালনার ক্ষেত্রে। ব্যাংকের কর্মদক্ষতা খারাপ হয়ে যায় এই খেলাপি ঋণের কারণে। যদিও খেলাপি ঋণের একটি বড় অংশ গুটি কয়েক ঋণ গ্রহীতার কাছে আটকে থাকে, এর প্রভাব পড়ে পুরো ব্যাংকিং ব্যবস্থার ওপর।
ঋণখেলাপির নিকট যখন টাকা আটকে থাকে, সেই টাকা আর নতুন ঋণ হিসেবে বিতরণ করা যায় না। সেখান থেকে মুনাফাও ফেরত আসে না। ফলে খেলাপি ঋণ ব্যাংকের কর্মদক্ষতা কমানোর পাশাপাশি ঋণ দানের ক্ষমতাও কমিয়ে দেয়। ব্যাংক নিজস্ব অর্থ দিয়ে ব্যবসা করে না। একজনের কাছ থেকে আমানত এনে অন্যজনকে তা দেয়। ব্যাংক সাধারণত আমানতের মাধ্যমে ঋণ সৃষ্টি করে। এই প্রক্রিয়ায় একজন গ্রাহক ব্যাংকে টাকা জমা দেওয়ার পরে সেখান থেকে ব্যাংক ঋণ সৃষ্টি করে। এই ঋণ পরিশোধের মাধ্যমে আবার ব্যাংকে টাকা জমা হয়। এভাবে টাকা বিভিন্ন হাতে ঘুরতে থাকে। এই ঘূর্ণন যত বেশি হবে, ব্যাংকের লাভও তত বেশি হবে। এতে করে বেশিসংখ্যক গ্রাহক ঋণ পায় এবং অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ত্বরান্বিত হয়। এভাবেই ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালিত হয়; কিন্তু কোনো একজন গ্রাহকের নিকট যদি ব্যাংকের দেয়া ঋণ আটকে থাকে, তাহলে ব্যাংক নির্ধারিত হারে মুনাফা অর্জন থেকে বঞ্চিত হয়।
ব্যাংক ঋণ গ্রহীতার কাছ থেকে সুদসহ কিস্তি আদায় করতে না পারলে আমানতকারীকে নির্ধারিত হারে সুদ প্রদান করতে ব্যর্থ হয়। খেলাপি ঋণ সৃষ্টি হলে সংশ্লিষ্ট হিসাব থেকে লাভ তো পাওয়া যায়ই না, উপরন্ত মূলধনই নষ্ট হয়ে যায়। মূলধন যদি কারও কাছে আটকে থাকে, তাহলে সেই ব্যাংকের ঋণদান ক্ষমতা কমে যায়। নতুন ঋণ দানের ক্ষেত্রে উচ্চ হারে সুদ নির্ধারণ করতে হয়। এভাবে খেলাপি ঋণ পুরো অর্থনীতির ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। শ্রেণিকৃত ঋণের বিপরীতে ব্যাংককে নির্ধারিত হারে প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হয়। এই প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হয় ব্যাংকের মুনাফা থেকে। খেলাপি ঋণের পরিমাণ বৃদ্ধি পেলে ব্যাংকের লাভজনকতা কমে যায়। ব্যাংক নতুন উদ্যোক্তা বা ব্যক্তিকে ঋণ দানের ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। একদিকে খেলাপি ঋণের কারণে ব্যাংকগুলো টাকা ফেরত পাচ্ছে না। আবার সেই খেলাপি ঋণের বিপরীতে যে প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হয়, তা রাখতে হয় ব্যাংকের মুনাফা থেকে।
ফলে মুনাফার পরিমাণও কমে যায়। যারা ঋণখেলাপি তাদের অপকর্মের দায় বহন করতে হয় নিয়মিত ঋণের কিস্তি পরিশোধকারীদের। ব্যাংকগুলো তাদের মুনাফা বাড়ানোর জন্য যারা নিয়মিত ঋণ পরিশোধকারী, তাদের সুদের হার বাড়িয়ে দেয়। ফলে যারা নিয়মিত ঋণের কিস্তি পরিশোধ করেন তাদের জন্য এটা এক ধরনের শাস্তি। প্রচলিত ব্যাংকিং আইন কার্যত ঋণখেলাপিদের স্বার্থের অনুকূলে। প্রচলিত আইনে ঋণখেলাপিদের নানা সুবিধা দেয়া হলেও নিয়মিত ঋণের কিস্তি পরিশোধকারীদের তেমন কোনো সুবিধা দেয়া হয় না। এতে যারা নিয়মিত ঋণ পরিশোধ করেন তারা হতাশ হতে পারেন। দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশই কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে খেলাপি ঋণের মাত্রা সহনীয় পর্যায়ে নামিয়ে আনতে সমর্থ হয়েছে। খেলাপি ঋণের মাত্রা সহনীয় পর্যায়ে নামিয়ে আনার জন্য সবার আগে প্রয়োজন রাজনৈতিক সদিচ্ছা। সরকার যদি রাজনৈতিকভাবে খেলাপি ঋণের বিপক্ষে অবস্থান নেয়, তাহলে খেলাপি ঋণের পরিমাণ সহনীয় পর্যায়ে নামিয়ে আনা খুব একটা কঠিন ব্যাপার নয়।
এক্ষেত্রে মালয়েশিয়া এবং আরও কয়েকটি দেশের উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। এক সময় মালয়েশিয়ার ব্যাংকগুলোতেও খেলাপি ঋণ অনেক বেশি ছিল। মহাথির মোহাম্মদ মালয়েশিয়ার রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে খেলাপি ঋণ কমানোর জন্য কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। তিনি গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে খোঁজ নিলেন দেশের শীর্ষ ঋণখেলাপি কে? তিনি আরও খোঁজ নিলেন যে পরবর্তী দিন ওই ঋণখেলাপি কোন পথ দিয়ে যাবেন। তিনি শীর্ষ ঋণখেলাপির যাত্রা পথে একটি পাম গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে থাকেন। ঋণখেলাপির গাড়ি ওই পথ দিয়ে যাবার সময় তিনি তার গাড়ির সামনে গিয়ে পথ আটকে দাঁড়ান। তিনি শীর্ষ ঋণখেলাপিকে গাড়ি থেকে নামতে বলেন। এরপর মহাথির মোহাম্মদ তাকে বলেন, আমি জানতে পেরেছি আপনি দেশের শীর্ষ ঋণখেলাপি। আপনার তো ঋণ পরিশোধের ক্ষমতা নেই। সে হিসেবে আপনার এত দামি গাড়িতে চড়ার কথা নয়। আমি আপনার খেলাপি ঋণের কিস্তি হিসেবে এই গাড়িটি জব্দ করলাম।
এই সংবাদ যখন ছড়িয়ে পড়ে, দেশব্যাপী তখন ঋণখেলাপিদের মাঝে প্রচণ্ড ভীতির সৃষ্টি হয়। বড় বড় ঋণখেলাপির তালিকা সীমান্তে পাঠিয়ে দিয়ে নির্দেশ দেয়া হলো, এরা যাতে সীমান্ত পেরিয়ে অন্য কোনো দেশে যেতে না পারে। বিমনাবন্দরেও এই তালিকা দিয়ে বলা হলো, তারা যেন দেশত্যাগ করতে না পারে। এই ব্যবস্থা গ্রহণের কয়েক বছরের মধ্যে মালয়েশিয়ার ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ কমে আসে এবং এ খাতে শৃঙ্খলা ফিরে আসে। খেলাপি ঋণের পরিমাণ কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে চীন যে ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিল, তা আরও মজার ব্যাপার। চীন তাদের দেশের ব্যাংকিং খাতের বৃহৎ ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে কিছু ব্যবস্থা গ্রহণ করে, যা তাদের মধ্যে আতঙ্কের সৃষ্টি করে। চীনের সরকার ঋণখেলাপিদের কিছু সেবাদান থেকে বঞ্চিত করে। যেমন ঋণখেলাপিদের জন্য দেশের বড় হাসপাতালে ভর্তি হবার বিধান বন্ধ করে দেয়া হয়।
তাদের জন্য বিদেশ ভ্রমণ নিষিদ্ধ করা হয়। তাদের সন্তানদের অভিজাত স্কুলে ভর্তি করানো বন্ধ করে দেওয়া হয়। বুলেট ট্রেনে ভ্রমণ ঋণখেলাপিদের জন্য নিষিদ্ধ করা হয়। এমনকি কোনো কোনো ঋণখেলাপিকে বড় বড় শহরেও বসবাসের অনুমতি দেয়া হয়নি কিংবা ওইসব শহর থেকে গ্রাম অঞ্চলে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। একজন ঋণখেলাপি যেহেতু আর্থিকভাবে সামর্থ্যহীন, কাজেই তার এসব সেবা গ্রহণ করার প্রশ্নই আসে না। কেউ আর্থিকভাবে সামর্থ্যবান আবার ঋণখেলাপি এটা হতে পারে না। চীনের যারা শীর্ষ ঋণখেলাপি, তাদের মোবাইলে ভয়েস টিউন দিয়ে দেয়া হলো যে, আপনি যাকে ফোন করেছেন, তিনি আমাদের দেশের একজন শীর্ষ ঋণখেলাপি। তার একজন শুভাকাঙ্ক্ষি হিসেবে তাকে ঋণের কিস্তি ফেরত দিয়ে আদালতের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করার পরামর্শ দিন। চীনের গৃহীত এসব ব্যবস্থা ঋণখেলাপিদের ওপর প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করে এবং খেলাপি ঋণ কমে আসে।
এখন প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশের ক্ষেত্রে খেলাপি ঋণের পরিমাণ গ্রহণযোগ্য মাত্রায় কমিয়ে আনার জন্য কি ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে। আমাদের দেশে খেলাপি ঋণ সৃষ্টির পেছনে সবচেয়ে বড় কারণ রাজনীতি এবং ব্যবসায়ের মধ্যে সৃষ্ট আঁতাত। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর থেকেই ব্যবসায়ী ও রাজনীতিবিদদের সঙ্গে এক ধরনের আঁতাত সৃষ্টি হয়। এটা ক্রমেই বাড়ছে। ব্যবসায়ীরা এখন সংসদ সদস্য হচ্ছে। বর্তমান জাতীয় সংসদের সদস্যদের মধ্যে ৬২ শতাংশই ব্যবসায়ী। যারা খেলাপি ঋণ কমানোর জন্য আইন করবেন, তারাই যদি ঋণখেলাপি হোন, তাহলে কীভাবে আমরা প্রত্যাশা করব যে, ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে কঠোর আইন প্রণয়ন করা হবে?
আর একটি সমস্যা হচ্ছে প্রতিটি ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ সুশাসনের অভাব। এক শ্রেণির প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ অথবা রাজনীতি আশ্রয়ী ব্যক্তিরা ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে ফেরত দিচ্ছেন না। এর সঙ্গে যুক্ত হয়ে কিছু ব্যাংকারও সুযোগ নিচ্ছেন। খেলাপি ঋণ আদায়ের ক্ষেত্রে আইন প্রণয়নের বেলায় বাংলাদেশ ব্যাংকের যেখানে কঠোর হওয়া প্রয়োজন ছিল, সেখানে তারা নানাভাবে ঋণখেলাপিদের ছাড় দেয়ার ব্যবস্থা করেছেন। ঋণের কিস্তি আদায় করার পরিবর্তে নানা প্রক্রিয়ায় ঋণখেলাপিদের কৃত্রিমভাবে খেলাপিমুক্ত দেখানোর চেষ্টা করেছেন। ক্ষমতাবান ঋণখেলাপিদের সুবিধা দেয়ার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক প্রচলিত ব্যাংকিং আইন পরিবর্তন করছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের এই উদ্যোগকে একজন অর্থনীতিবিদ কার্পেটের নিচে ময়লা রেখে ঘর পরিষ্কার দেখানোর প্রচেষ্টা বলে অভিহিত করেছেন।
বাংলাদেশ ব্যাংক ঋণখেলাপিদের বিভিন্ন আইনি সুবিধা দেবার ফলে বিদ্যমান ভালো ঋণ গ্রহীতারাও খেলাপি হওয়ার উৎসাহ বোধ করতে পারেন। বিদ্যমান বিচার প্রক্রিয়াও খেলাপি ঋণ আদায়ের জন্য প্রতিবন্ধকতাস্বরূপ। দেশে পর্যাপ্তসংখ্যক অর্থঋণ আদালত নেই। অর্থঋণ আদালতের অপ্রতুলনার পাশাপাশি যারা অর্থঋণ আদালতের বিচারক হিসেবে আছেন তাদের অনেকেই আর্থিক বিষয়গুলো ঠিক মতো বুঝেন না। অর্থঋণ আদালতে মামলা করা হলে তা বছরের পর বছর ঝুলে থাকে। ঋণ গ্রহীতাদের অনেকেই আছেন, যারা চান যে তার বিরুদ্ধে অর্থঋণ আদালতে মামলা করা হোক এবং সেক্ষেত্রে তারা নিশ্চিন্তে থাকতে পারবেন।
লেখক: অধ্যাপক, ব্যাংকিং অ্যান্ড ইন্স্যুরেন্স ডিপার্টমেন্ট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
অনুলিখন: এম এ খালেক
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে