অমর একুশে বিশেষ সংখ্যা ২০২৪
মাতৃভাষা উন্নতির জন্য রাষ্ট্রভাষা বাংলার উন্নতিকে স্থগিত রাখা ঠিক হবে না
দুনিয়াতে প্রায় দুইশ ভাষায় দৈনিক পত্রিকা প্রকাশিত হয়। এসব ভাষা বিকাশমান। এগুলোর মধ্যে জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিল্প-সাহিত্যের দিক দিয়ে বাংলা ভাষার স্থান এখনো ওপরের দিকেই আছে। এগুলো ছাড়া বিভিন্ন মহাদেশে কয়েক হাজার ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠী আছে; তাদেরও আলাদা আলাদা ভাষা আছে; তাদের ভাষাও বিলীয়মান।
বাংলাদেশে ৪৫ ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর ৪৫টি বিলীয়মান মাতৃভাষা আছে। এই ৪৫টি জনগোষ্ঠীর মোট জনসংখ্যা বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার এক-শতাংশের সামান্য বেশি। এরা জন্মের পর থেকেই নিজেদের ভাষার মতো বাংলা ভাষাও শেখে। এদের বলা যায় দ্বিভাষিক (bilingual)। বাংলা ভাষাকেই তারা উন্নতির অবলম্বন মনে করে। বিভিন্ন রাষ্ট্রের এবং বাংলাদেশেরও বিলীয়মান মাতৃভাষাগুলোকে রক্ষা করার চেষ্টা বাস্তবসম্মত নয়। এক্ষেত্রে ইউনেস্কোর প্রচার ও কাজ বাস্তবতা-বিরোধী। ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীসমূহের লোকজন জীবনযাত্রার ও উন্নতির প্রয়োজনে নিজেদের ভাষার চেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়ে রাষ্ট্রভাষা শিখছে। এর মধ্যে রয়েছে তাদের উন্নতির সম্ভাবনা। বিভিন্ন রাষ্ট্রে ছড়িয়ে থাকা ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীসমূহের উন্নতির ও মানবজাতির মূল ধারায় আসার সুযোগ সর্বত্র বাড়াতে হবে। তাদের চিরকাল আদিবাসী করে রাখার নীতি বর্জনীয়।
আমাদের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের মূল চেতনা ও উদ্দেশ্য থেকে ইউনেস্কোর আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের উদ্দেশ্য ও কার্যক্রম সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রকৃতির। এর দ্বারা রাষ্ট্রভাষা রূপে বাংলা ভাষার প্রতিষ্ঠা ব্যাহত হচ্ছে এবং রাষ্ট্ররূপে বাংলাদেশের গড়ে ওঠার সম্ভাবনাও নষ্ট হচ্ছে। বিলীয়মান মাতৃভাষাগুলোর উন্নতির জন্য রাষ্ট্রভাষা বাংলার উন্নতিকে স্থগিত রাখা ঠিক হবে না। নতুন ভবিষ্যৎ সৃষ্টিতে আমাদের এগোতে হবে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের ধারা ধরে।
সাম্রাজ্যবাদী শক্তি, সিভিল সোসাইটি অর্গানাইজেশন, এনজিও ও ইউনেস্কো ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীসমূহের উন্নয়নের জন্য যে পথ প্রদর্শন করে, যেসব পরিকল্পনা ও কার্যক্রম চালায়, অনেক সময় সেগুলো ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীসমূহের উন্নতির অন্তরায় হয়। ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীসমূহকে নিজেদের উন্নতির জন্য পার্শ্ববর্তী বৃহৎ জনগোষ্ঠীর সঙ্গে মিলে রাষ্ট্র গঠন করতে হয় এবং রাষ্ট্রভাষা শিখতে হয়। তারা যদি বাইর থেকে কিছুই গ্রহণ না করে এবং কেবল নিজেদের বিলীয়মান মাতৃভাষা ও নিজেদের অভ্যন্ত জীবনযাত্রা নিয়ে চলে, তাহলে তারা কোনো কালেই উন্নতি করতে পারবে না। যে কোনো জনগোষ্ঠীর জন্যই না-নিয়ে, না-দিয়ে নিজেদের মধ্যে গুটিয়ে রাখার ফল খারাপ হয়। আত্মবিকাশের ও উন্নতির জন্য ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীসমূহকে বাইর থেকে ভালো জিনিস গ্রহণ করতে হবে। নিজেদের উন্নতির প্রয়োজনে রাষ্ট্রভাষাকে নিজেদের মাতৃভাষার চেয়েও বেশি গুরুত্ব দিয়ে তাদের জীবনব্যাপী আয়ত্ত করা ও বিকশিত করে চলা সমীচীন।
মনে রাখতে হবে রাষ্ট্রভাষা (state language) দ্বারা কেবল অফিসের ভাষা (official language) বোঝায় না, বোঝায় তার সঙ্গে আরও অনেক কিছু। রাষ্ট্রভাষার মধ্যে অফিস চালানোর ভাষা আছে, সেইসঙ্গে আছে জাতীয় জীবনে জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিল্প-সাহিত্য সৃষ্টির ভাষা আছে, কোনো জাতির আর্থ-সামাজিক-রাষ্ট্রিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের ভাষা। রাষ্ট্রভাষার উন্নতি হলে রাষ্ট্রের অন্তর্গত জাতির সভ্যতা উন্নত হয়।
কোনো ভাষার অর্থনৈতিক ভিত্তি বিকাশশীল থাকলে সে ভাষা বিকাশশীল থাকে। কোনো ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীই তার বিলীয়মান মাতৃভাষা নিয়ে জীবিকার ব্যবস্থা করতে পারে না। সাম্রাজ্যবাদীরা সাম্রাজ্যবাদী উদ্দেশ্যে বাংলাদেশে বিলীয়মান মাতৃভাষাগুলোকে রক্ষা করার প্রচার চালিয়ে বাংলা ভাষার আর্থ-সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও রাষ্ট্রিক ভিত্তিকে দুর্বল করার চেষ্টা করছে।
আমাদের উপলব্ধি করা দরকার, রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অস্তিত্ব ও উন্নতির জন্য রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলাভাষার অস্তিত্ব ও উন্নতি অপরিহার্য। চলমান বহু ঘটনা আছে যেগুলো দেখে বলা যায়, রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলা ভাষা না টিকলে রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ টিকবে না। দেশ থাকবে, মাটি মানুষ গাছপালা পশু-পাখি নদীনালা ও আকাশ-বাতাস থাকবে; কিন্তু রাষ্ট্র থাকবে না। যারা বাংলাদেশে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলার বদলে ইংরেজি চান তারা রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে রক্ষা করবেন?
দেশ এবং রাষ্ট্র এক নয়। দেশ প্রকৃতির সৃষ্টি, রাষ্ট্র মানুষের। আমাদের রাষ্ট্র না থাকলে, কেবল দেশ থাকলে, আমরা কি ভালো থাকব? নিজেদের রাষ্ট্র না থাকলে আমরা কি স্বাধীন থাকব? ১৯৭১ সালে কেন আমরা স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করেছিলাম? ছয় দফা আন্দোলনে কেন আমরা যোগ দিয়েছিলাম? কেন আমরা রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন করেছিলাম? কেন আমরা ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্ত হতে চেয়েছিলাম? বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্র রূপে গড়ে তোলার লক্ষ্য বাদ দিয়ে চললে এসব চাওয়া অর্থহীন হয়ে যায়।
ভৌগোলিক বাস্তবতা ও বাঙালি-চরিত্র লক্ষ্য করে, ১৯৭৩ সাল থেকেই কোনো কোনো চিন্তাশীল ব্যক্তি বলে আসছেন, বাংলাদেশ রাষ্ট্র হিসেবে টিকে থাকার মতো (viable) নয়। তারা জোর দিয়েছেন বাঙালি-চরিত্রের নিকৃষ্টতায়। তাদের যুক্তি ও মত কখনো আমার কাছে গ্রহণযোগ্য মনে হয়নি। তারা অনেকে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়ায় নাগরিকত্ব নিয়েছেন এবং প্রায় সবাই তাদের সন্তানদের ওইসব রাষ্ট্রে নাগরিক করেছেন। আমি সব সময় বাঙালি-চরিত্রের উন্নতি সম্ভব বলে মনে করেছি। আমি সব সময় মনে করেছি এবং এখনো মনে করি, বাংলাদেশকে অবশ্যই বাংলাদেশের জনগণের প্রগতিশীল রাষ্ট্ররূপে গড়ে তোলা যাবে। সে লক্ষ্যেই আমাদের চিন্তা ও কাজ। জাতীয় হীনতাবোধ বাংলাদেশের ধনী-গরিব, শিক্ষিত-শিক্ষাবঞ্চিত, ক্ষমতাবান-ক্ষমতাবঞ্চিত সব মানুষকে ভেতর থেকে কুরে কুরে খাচ্ছে। জনসাধারণ ঘুমন্ত। জাতীয় হীনতাবোধ থেকে জাতিকে মুক্ত করতে হবে। ঘুমন্ত জনসাধারণকে জাগাতে হবে। অবস্থার উন্নতির জন্য যা কিছু করা দরকার সবই আমাদের করতে হবে।
সিভিল সোসাইটি অরগানাইজেশনগুলো বাংলাদেশের রাজনীতিকে বৃহৎ শক্তিবর্গের স্থানীয় দূতাবাস-অভিমুখী করেছে। বড় দুই রাজনৈতিক দল জাতি ও রাষ্ট্র গঠনের কথা না ভেবে দূতাবাসমুখী রাজনীতি নিয়ে চলছে। বাংলাদেশের সব প্রচারমাধ্যম ১৯৮০ সালে ও ৯০-এর দশকে বিবিসি রেডিওর অন্ধ অনুসারী হয়ে কাজ করেছে। বিরোধী দলগুলোও তাই করেছে। ক্ষমতার বাইরে থাকা কালে বড় দুই রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিরা সুষ্ঠু, অবাধ, নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানে সাহায্যের আবেদন নিয়ে ক্রমাগত যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়ার, এবং ভারতেরও, স্থানীয় দূতাবাসগুলোতে সাহায্য চাইতে যান। তারা চলে যান যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের স্টেট ডিপার্টমেন্টের নির্দিষ্ট ডেস্কে। জাতিসঙ্ঘের তত্ত্বাবধানে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্যও কোনো কোনো নেতা নিউইয়র্কে জাতিসংঘের হেড অফিসে গিয়ে তদবির করেন।
সাম্রাজ্যবাদী অর্থসংস্থাগুলো ‘দাতা-সংস্থা’ ও ‘উন্নয়ন-সহযোগী’ নাম নিয়ে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় নীতি নির্ধারণে যুক্ত হয়। উচ্চ ও উচ্চমধ্য শ্রেণির লোকেরা সরকারি ও সরকারবিরোধী উভয় মহল- তাদের ছেলেমেয়েদের যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া প্রভৃতি রাষ্ট্রের নাগরিক করে চলছেন। মন্ত্রিপরিষদ, জাতীয় সংসদ, প্রশাসনব্যবস্থার উচ্চপর্যায়, বিচারব্যবস্থার উচ্চপর্যায়, শিক্ষাব্যবস্থার উচ্চপর্যায় লক্ষ্য করলেই এটা দেখা যায়। এই ব্যক্তিরাই বাংলাদেশে রাষ্ট্র- ব্যবস্থার ও ব্যবসা-বাণিজ্যের কর্তৃত্বে আছেন। বাংলাদেশে একদিকে আছে ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক ব্রিটিশ কাউন্সিল ও কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের মাধ্যমে পরিচালিত ও-লেভেল, এ-লেভেল, এবং অপরদিকে আছে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক নব-প্রবর্তিত ইংলিশ ভার্সন। এ-সবই বাংলাদেশের ভূভাগে জাতি ও রাষ্ট্র গঠনের সম্পূর্ণ পরিপন্থি।
ভাষা ও মানুষের জীবন এবং মানুষের জীবন ও ভাষা নিয়ে যতই চিন্তা করা যায়, তথ্যসন্ধান ও বিচার-বিশ্লেষণ করা যায়, ততই দুয়ের অবিচ্ছেদ্যতা ও উন্নতি সম্পর্কে ধারণা গভীর থেকে গভীরতর হয়। এসব লক্ষ করে বলা যায়, ভাষাকে নতুনভাবে জানা এবং ভাষায় আমরা যতটা গুরুত্ব দিই তার চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্ব দেয়া আমাদের কর্তব্য।
লেখক: ভাষাবিদ ও সাবেক অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে