Views Bangladesh Logo

উত্তপ্ত ঢাকার ক্রিকেট: খেলা বয়কট ও আলটিমেটাম, ফাহিমের পদত্যাগ দাবি

বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) গঠনতন্ত্র সংশোধনীর খসড়া প্রস্তাব ইস্যুতে উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে ঢাকা মহানগর ক্রিকেট অঙ্গন। ঢাকার ক্রিকেটকে বলা হয় বাংলাদেশ ক্রিকেট প্রশাসনের ‘পাওয়ার হাউস’। আর ঢাকার এই শক্তি কমিয়ে আনার পাশাপাশি বিসিবির গঠনতন্ত্রে আরও বেশকিছু সংশোধনীর একটি খসড়া করা হয়েছে। চূড়ান্তভাবে উত্থাপনের আগেই এই সংশোধনী খসড়া ফাঁস হয়ে গেছে। ফলে সংশোধনীর খসড়া দেখে রীতিমতো ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছে ঢাকার ক্রিকেট ক্লাব সংগঠকরা। সোমবার রাজধানীর একটি হোটেলে এ নিয়ে এক মতবিনিময় সভার আয়োজন করে সংশোধনী খসড়া বাতিলের জন্য তিন দিনের আলটিমেটামও দিয়েছে ঢাকা মহানগরের ৭৬টি ক্লাব। বুধবার, বৃহস্পতিবার ও শুক্রবারের (১৫ থেকে ১৭ জানুয়ারি) মধ্যে এই বিষয়ে কোনো সুরাহা না হলে সব ধরনের লিগ বয়কট করা হবে।

প্রিমিয়ার ক্রিকেট লিগের দলবদলে অংশ নেবে না কোনো ক্লাব। কঠোর আন্দোলনে যাওয়ারও হুমকি দিয়েছে ক্রিকেট কমিটি অব ঢাকা মেট্রোপলিসের (সিসিডিএম) আওতাধীন এই ক্লাবগুলো। একই সঙ্গে বিসিবির গঠনতন্ত্র সংশোধনী কমিটির প্রধান নাজমুল আবেদীন ফাহিমের পদত্যাগ চেয়েছেন ঢাকার ক্লাব কর্মকর্তারা। এই পরিচালককে আর ক্রিকেট বোর্ডে দেখতে চান না তারা। তাদের দাবিগুলো না মানা পর্যন্ত ঢাকার ক্রিকেট অচল থাকবে। এ ব্যাপারে ১৮ জানুয়ারি শনিবার বিসিবির সভাপতির ফারুক আহমেদের সঙ্গে ঢাকার ক্লাবগুলোর পক্ষে একটি প্রতিনিধি দলের সাক্ষাৎ করার কথা রয়েছে।

সরকারের পটপরিবর্তনের পর ক্রিকেট বোর্ডে নতুন নেতৃত্ব এসেছে। জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের কোটায় বিসিবির পরিচালক হয়েছেন ফারুক আহমেদ ও নাজমুল আবেদীন ফাহিম। নতুন সভাপতি হিসেবে ক্রিকেট বোর্ডের দায়িত্ব নিয়েই বিসিবির গঠনতন্ত্রে সংশোধন আনার কথা বলেছিলেন ফারুক আহমেদ। এ জন্য নাজমুল আবেদীন ফাহিমকে আহ্বায়ক করে পাঁচ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়। কিন্তু এ কমিটি গঠনের পরই বিতর্কের মুখে পড়ে বিসিবি। কেননা কমিটিতে একমাত্র ফাহিম ছাড়া বাকি চার সদস্যের কেউই ক্রিকেট সংশ্লিষ্ট নন। বিসিবির গঠনতন্ত্র সংশোধনী খসড়া ফাঁস হওয়ার পর আরো বিতর্কের মুখে পড়েছে এই কমিটি। বর্তমানে বিসিবি পরিচালনা পর্ষদে আছেন ২৫ জন পরিচালক। এর মধ্যে ঢাকা মহানগরের ক্রিকেট ক্লাব থেকে নির্বাচিত হন ১২ জন পরিচালক। বিভাগ থেকে ১০ জন, জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের কোটায় ২ জন এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সংস্থা ও সাবেক ক্রিকেটার ক্যাটাগরিতে একজন পরিচালক নির্বাচিত হয়ে আসেন।

সংশোধনী খসড়া অনুযায়ী বিসিবির পরিচালক পর্ষদ ২১ সদস্যের প্রস্তাব করা হয়েছে। ঢাকার ক্লাবগুলোর পরিচালকের সংখ্যা ৪ জনে কমিয়ে আনার সুপারিশ করা হয়। বিসিবির একটি অঙ্গ সংগঠন সিসিডিএমকে ভেঙে আঞ্চলিক ক্রিকেট সংস্থা করার প্রস্তাবও দেয়া হয়েছে। এ ছাড়া ঢাকার কাউন্সিল ৭৬ থেকে কমিয়ে ৩০ এ আনার প্রস্তাব করা হয়। এই সংশোধনীগুলোতেই ক্ষোভে ফুঁসে উঠেছে ঢাকার ক্রিকেট ক্লাবগুলো। সকল ক্লাব একজোট হয়ে প্রতিবাদে সোচ্চা হয়ে উঠেছে। ৭৬টি ক্লাবের মধ্যে মত বিনিময় সভায় ৬৭টি ক্লাবের প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন। বাকি ৯টি ক্লাবের প্রতিনিধি উপস্থিত হতে না পারলেও সবার সঙ্গে একাত্মা প্রকাশ করেছেন। এই ৭৬টি ক্লাব মিলে ঢাকা ক্রিকেট ক্লাব অর্গানাইজার্স অ্যাসোসিয়েশন গঠনের জন্য একমত হয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে।

বিভিন্ন লিগে মিলে ঢাকার ক্রিকেট ক্লাবগুলোতে প্রায় দুই হাজার ক্রিকেটার খেলছেন। শত কোটি টাকা খরচ করে দল চালায় ক্লাবগুলো। ঢাকার ক্লাবগুলোতে খেলতে খেলতেই এক পর্যায়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্ব করেন ক্রিকেটাররা। ঢাকার ক্লাবগুলোর মাধ্যমেই মূলত লাইমলাইটে আসেন খেলোয়াড়রা। দেশের ক্রিকেট উন্নয়নের খেলোয়াড় তৈরির কারখানা ঢাকার ক্লাবগুলো। বছরের পর বছর সংগঠকদের অক্লান্ত পরিশ্রম, অনেক ত্যাগ ও নিবেদনের কারণেই ক্লাবগুলো চলছে; কিন্তু তাদের সঠিকভাবে মূল্যায়ন করা হয় না। উল্টো অপমান ও উপেক্ষার শিকার হতে হয় তাদের। এমন দাবি বিসিবির সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক রফিকুল ইসলাম বাবুর। তিনি বলেন, ‘যে জিনিসটা করা হয়েছে গঠনতন্ত্রে, আমাদের ক্লাবগুলোকে অপমান করা হয়েছে। বিশেষ করে ঢাকা লিগের ক্লাবগুলোর যে অবদান ক্রিকেট খেলোয়াড় তৈরিতে, এটা স্বাধীনতার পর থেকে অদ্যাবধি সবাইকে এই প্রস্তাবিত গঠনতন্ত্র সংশোধনীর মাধ্যমে অপমান করা হয়েছে।

১২ জন বোর্ড পরিচালক থেকে ৪ জনে নিয়ে আসা হয়েছে এবং কাউন্সিলর সংখ্যা ৭৬ থেকে ৩০ জনে নিয়ে আসা হয়েছে। এটা মানা যায় না। তারা (বিসিবি) যদি কোনো সদূত্তর না দেয় তাহলে সব ক্লাব খেলা থেকে বিরত থাকবে।’ লালমাটিয়া ক্লাবের আদনান রহমান দীপন বলেছেন, অবৈধভাবে বোর্ড পরিচালক হয়েছেন বিসিবির গঠনতন্ত্র সংশোধনী কমিটির প্রধান নাজমুল আবেদীন ফাহিম। তাকে বোর্ডে আর দেখতে চান না। তাকে ক্রিকেট ছেড়ে দিতে হবে। পদত্যাগ করতে হবে। দীপনের সঙ্গে একমত রফিকুল ইসলাম বাবু। তিনি বলেন, ‘উনি যে কাজটা করেছেন, এটা সবাইকে বিতর্কের মধ্যে ফেলে দিয়েছে। আমাদের সংগঠক এটা বলতেই পারেন (ফাহিমের পদত্যাগ)। উনি যে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তাতে ঢাকার ক্লাবগুলো যদি না চায় তাহলে তো বোর্ড চালানোর ক্ষমতা কারো নাই। সেটা যৌক্তিক কারণে।’ তিনি আরও বলেন, ‘গঠনতন্ত্র যদি সংশোধন করতে হয়, সেখানে জেলা থেকে যে সব পরিচালকরা আসেন, তাদের জেলাতে খেলা হয় নাকি, যেসব কাউন্সিলর আসেন, সেসব জেলায় খেলা হয় নাকি, এসব দেখে সিদ্ধান্ত নিলে ঢাকার ক্লাবগুলোর পরিচালক বাড়ানোর প্রস্তাব আসতে পারে।

সেক্ষেত্রে আমরা ১৫ জন পরিচালক দাবি করছি।’ খসড়া সংশোধনী বাতিলের দাবিতে তিন দিনের আলটিমেটাম ঘোষণা করেন রফিকুল ইসলাম বাবু। তিনি বলেন, ‘আগামী তিন দিনের মধ্যে সংশোধন করে আমাদের জানাতে হবে। অন্যথায় আমরা আরও কঠোর আন্দোলনে যাব। আমরা আগামী শনিবার ক্রিকেট বোর্ডে যাব। স্মারকলিপি দেব। ক্রীড়া উপদেষ্টা আছেন, উনাকেও জানাব। এই ধরনের গঠনতন্ত্রের সংশোধন আমরা মানি না।’ অন্যদিকে, তেজগাঁও ক্রিকেট একাডেমির সভাপতি ও উত্তরা স্পোর্টিং ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক বুরহানুল হোসেন পাপ্পু বলেন, ‘যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে, সেটি ক্রিকেটের জন্য অশনি সংকেত। ক্রিকেটকে আরও এগিয়ে নিতে হলে ঢাকার ক্লাবগুলোর প্রতি বেশি গুরুত্ব দিতে হবে।’ ২০ বছর ধরে ক্রীড়া জগতের সঙ্গে থাকা এম নাজমুল ইসলাম বলেন, ‘ক্লাবের কেউই এখন আর সম্মান পায় না।

ঢাকার ক্রিকেটের এত অবদান ভুল গেল তারা।’ সিসিডিএমের ভাইস-চেয়ারম্যান ও বিসিবির কাউন্সিলর মাসুদুজ্জামান বলেন, ‘আগে যখন ১২ জন করা হয়েছিল, তখন কাউন্সিলর ছিল ৪০ জন। এখন ৭৬ জন থেকে বোর্ড পরিচালক ১৫ জন করা দরকার।’ লিজেন্ড অব রূপগঞ্জের স্বত্বাধিকারী লুৎফুর রহমান বাদল বলেন, ‘আমরা কোটি টাকা খরচ করে ক্লাব চালাই। ক্লাব চালানো অত সহজ নয়; কিন্তু এই ক্লাবগুলোকে বোর্ড অসম্মান করে।’ এ ছাড়া সাবেক সিসিডিএমের চেয়ারম্যান জি এস হাসান তামিম, বারিধারা ড্যাজলারের আলী আহসান বাবু, রংপুর রাইডার্সের প্রতিনিধি সানিয়ান, বাংলাদেশ পুলিশ ক্রিকেট দলের প্রতিনিধি মো. শাহ আমিন, শেখ রাসেল ক্রীড়া চক্রের সভাপতি রাশেদুল হক শাহীন, প্রগতি সেবা সংঘের সভাপতি সাব্বির আহমেদ রুবেল খসড়া সংশোধনীর ব্যাপারে তীব্র প্রতিবাদ করেছেন। অবশ্য সংশোধনী খসড়াটি পর্যালোচনার জন্য বিসিবির কার্যনির্বাহী কমিটির সামনে এখনো উত্থাপন করা হয়নি। উত্থাপন হওয়ার পর কার্যনির্বাহী কমিটি পর্যালোনার করে খসড়া অনুমোদন দেবে এবং বিসিবির এজিএমে সেটি চূড়ান্ত ভাবে পাস হবে। এদিকে, নাজমুল আবেদীন ফাহিম দাবি করছেন, বিসিবির গঠনতন্ত্রের খসড়া সংশোধনী এখনো চূড়ান্ত হয়নি। ক্রিকেট বোর্ডেও জমা দেয়া হয়নি। বিসিবির গঠনতন্ত্র সংশোধনীর বিষয়টি একেবারে প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ