অনুমোদনহীন ভবন নির্মাণ
ঢাকা পরিণত হচ্ছে এক মৃত্যুকূপে
অপরিকল্পিত নগরায়ণের ফলে দিন দিন ঢাকা পরিণত হচ্ছে মৃত্যুকূপে। একে তো বিপুল জনসংখ্যার চাপ সামলাতে ঢাকার বাতাস, পানি সবই দূষিত হয়ে উঠছে, দ্বিতীয়ত, ঢাকার আবাসন ভবনগুলোও অত্যধিক ঝুঁকিপূর্ণ। এর কারণ ঢাকার আশপাশের বেশির ভাগ ভবনই নির্মাণ হচ্ছে রাজউক বা কোনো সংস্থার অনুমোদন ছাড়া। ফলে যে কোনো সময় যে কোনো ধরনের দুর্ঘটনা তো ঘটতে পারে।
আজ শনিবার (১১ মে) সংবাদমাধ্যমের একটি বিশেষ প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, রাজধানীর বছিলায় ১৪ তলা ভবন তৈরি হয়েছে নির্মাণবিষয়ক বৈধ কোনো কাগজপত্র ছাড়াই। বছিলা অঞ্চলে অনেক বহুতল ভবনই রাজউকের তদারকির বাইরে গড়ে উঠছে। শুধু বছিলা নয়, গাবতলী-হাজারীবাগ বেড়িবাঁধের পশ্চিম পাশের আশপাশের এলাকায় নামসর্বস্ব অনেক আবাসন কোম্পানি সারি সারি বহুতল ভবন করছে। সিটি করপোরেশনের আওতাধীন, মূল শহরের সঙ্গে যোগাযোগ সহজ এবং দাম তুলনামূলক কম হওয়ায় এখানকার প্লট-ফ্ল্যাট কেনার হিড়িক পড়েছে।
এ খবর নতুন নয়। প্রায়ই এ নিয়ে বিভিন্ন পত্রিকায় খবর আসে, ঢাকার আশপাশে গড়ে উঠছে অপরিকল্পিত ভবন; কিন্তু এসব নিয়ে কারোই যেন মাথাব্যথা নেই। একটা জায়গা পেলে যে যেভাবে খুশি বহুতল ভবন নির্মাণ করে ফেলছেন। অনেকে পুকুর, খাল, জলাভূমি ভরে, সরু গলির ভেতরেই বহুতল ভবন নির্মাণ করছেন। আর এসব ভবন নির্মাণের বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই মানা হচ্ছে না কোনো ধরনের নিয়মনীতি। ফলে অনেক ধরনের ঝুঁকির সঙ্গে বাড়ছে অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকি।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এসব ঝুঁকিপূর্ণ ও অতিঝুঁকিপূর্ণ ভবন যে কোনো অগ্নিদুর্ঘটনার কবলে পড়তে পারে। বিকল্প সিঁড়ি ও নির্গমনপথ, ফায়ার লিফট, ফায়ার ডোর, ফায়ার ডিটেক্টর, ফায়ার স্প্রিংকলার, ফায়ার সাপ্রেশন সিস্টেমের মতো ব্যবস্থা না রেখেই নির্মাণ করা হচ্ছে অসংখ্য বহুতল ভবন। নতুন ভবন ব্যবহারের আগে রাজউকের অকুপেন্সি সনদ নেয়ার কথা থাকলেও তা ছাড়াই ব্যবহার করা হচ্ছে এসব ভবন।
আমরা জানি, ভূমিকম্পসহ নানা ধরনের ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে রাজধানী ঢাকা। ঢাকা শহরে এখন আর নতুন গ্যাস লাইনের অনুমতিও দেয়া হচ্ছে না। এসব আবাসিক ভবনে ব্যবহার করা হয় সিলিন্ডার গ্যাস। সিলিন্ডার গ্যাস থেকে যে কোনো সময় অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত হতে পারে। এরকম কোনো অগ্নিকাণ্ড হলে এসব এলাকায় উদ্ধার কাজও ঠিক মতো চালানো সম্ভব হবে না।
কোনো দুর্ঘটনার কথা বাদ দিলেও আবাসিক এলাকায় কিছু নাগরিক সুবিধা থাকা প্রয়োজন। সরেজমিন দেখা গেছে, এসব হাউজিংয়ের কার্যক্রম শুরু এবং ভবন তৈরির সময় রাজউক বাধা দেয়নি। ফলে খেলার মাঠ, পার্ক, উদ্যান, উন্মুক্ত স্থান, কাঁচাবাজার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, প্রশস্ত রাস্তা, স্যুয়ারেজ, ড্রেন, পানির সংযোগসহ নাগরিক সুযোগ-সুবিধার কিছুই রাখেনি সংশ্লিষ্টরা। আছে শুধু প্লট আর প্লট, সেখানে উঠছে সারি সারি বহুতল ভবন। বৃক্ষ-গাছপালা তো নেই-ই। ওপর থেকে ঢাকা শহরকে অনেক সময় মনে হয় কংক্রিটের বস্তি। এ কেমন জীবনযাপনে, ইটের খুঁপড়িতে আটকে পড়ছে ঢাকার মানুষ!
দোষ কাকে দেব? ভবন মালিকদের, ভাড়াটিয়াদের না কি নগর পরিকল্পনাবিদদের? ঢাকায় জনসংখ্যার স্রোত ঠেকাতে নগর কর্তৃপক্ষও হিমশিম খাচ্ছে; কিন্তু বড় ধরনের কোনো দুর্ঘটনা ঘটে গেলে তার দায় কে নেবে? শেষ পর্যন্ত সব দায় অবশ্যই রাজউকের ঘাড়েই বর্তাবে। তা ছাড়া শুধু বড় কোনো দুর্ঘটনা ঘটার পরপরই সরকার ও বিভিন্ন সংস্থা সক্রিয় হয়ে ওঠে কেন? তখন তাদের পরিদর্শন, প্রতিশ্রুতি কিংবা আশ্বাস দুর্ঘটনা ঠেকাতে কতটা ভূমিকা রাখে, সেটাও এখন খতিয়ে দেখার সময় এসেছে।
বিশেষ করে রাজউক বা সিটি করপোরেশন, যাদের এসব ভবন নজরদারি করার দায়িত্ব, তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে যে, ভবনমালিকদের কাছ থেকে নানা রকম সুবিধা নিয়ে তারাই এসব অনিয়মের প্রশ্রয় দেন। আরও অভিযোগ আছে, অবৈধভাবে নির্মিত ভবনের অনেকগুলোরই মালিক আর্থিক বা রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী। সে ক্ষেত্রে এই প্রভাবশালী ব্যক্তিদের আইনের আওতায় আনা কতটা সম্ভব হবে! মনে রাখতে হবে, প্রয়োজনের চেয়ে জীবন অনেক মূল্যবান। শুধু মাথা গোঁজার ঠাঁই পেলেই হবে না, নিজের জীবনের নিরাপত্তা নিয়ে সবাইকে ভাবতে হবে।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে