Views Bangladesh

Views Bangladesh Logo

তীব্র শব্দদূষণে চিড়েচ্যাপ্টা তিলোত্তমা ঢাকা

Hira  Talukder

হিরা তালুকদার

বৃহস্পতিবার, ১২ ডিসেম্বর ২০২৪

সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত প্রচণ্ড শব্দের মাঝে কাটাতে হচ্ছে রাজধানীবাসীকে। প্রধান সড়ক থেকে অলিগলি, সব জায়গায়ই অসহ্য শব্দ। রাস্তার শব্দে থাকা দায় ঘরের মধ্যেও। দিন-রাত দরজা-জানালা বন্ধ করে শব্দদূষণ থেকে বাঁচার আপ্রাণ চেষ্টা চলে ঘরে থাকা ঢাকাবাসীর।

গ্রহণযোগ্য মাত্রার (ডেসিবেল) চেয়ে দ্বিগুণ বেশি শব্দের অত্যাচারে কানে কম শোনার সমস্যায় ভুগছেন ঢাকা মহানগরীর চারভাগের একভাগেরও বেশি নাগরিক। তীব্র এই শব্দদূষণে ক্ষতিগ্রস্ত ট্রাফিক পুলিশ এবং যানচালকরাও।

স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটির পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) গবেষণা বলছে, ২০২০ সাল পর্যন্ত ঢাকায় গড়ে ১২ ঘণ্টা সহনীয় মাত্রার চেয়ে বেশি শব্দদূষণ হলেও এখন তা ১৪ ঘণ্টা ছাড়িয়ে গেছে। গত মাসে জাতিসংঘ পরিবেশ কর্মসূচি ইউএনইপির বৈশ্বিক প্রতিবেদনে শব্দদূষণে বিশ্বের শীর্ষস্থান দখল করেছে ঢাকা।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) গাইডলাইন অনুসারে, মানুষের ক্ষেত্রে ঘরের ভেতরে শব্দের গ্রহণযোগ্য মাত্রা ৫৫ ডেসিবেল। আর ঘরের বাইরে বাণিজ্যিক এলাকার জন্য ৭০ ডেসিবেল। অথচ ঢাকার রাস্তার শব্দের এই মাত্রা ১২২ ডেসিবেল বা কোনো কোনো ক্ষেত্রে এরও বেশি।

অন্যদিকে, দেশে ৮০ থেকে ১০০ ডেসিবেলের হর্ন আমদানির অনুমতি দেয়া আছে আমদানি নীতিতে। অথচ ‘শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা ২০০৬’ অনুসারে, সর্বোচ্চ অনুমোদিত মাত্রা ৬০ ডেসিবেল আর শিল্প অঞ্চলের জন্য ৭০ ডেসিবেল প্রযোজ্য।

বিশেষজ্ঞরা তাই বলছেন, ‘হর্ন আমদানি নীতি’ ও ‘শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা ২০০৬’ পারস্পরিক সাংঘর্ষিক। আমদানি নীতিতে ১০০ ডেসিবেলের বদলে ৫০ থেকে ৬০ ডেসিবেলের হর্ন আমদানির অনুমোদন দিলে শব্দদূষণ সমস্যার অর্ধেক নিরসন হবেও মনে করেন তারা।

তবে তাদের মতে, শুধু আইন করেই শব্দদূষণ পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। এজন্য প্রয়োজন রাষ্ট্রের সংশ্লিষ্টদের কঠোর অবস্থান ও জনসচেতনতা।

গত বছরের ১৭ জানুয়ারি ‘শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা ২০০৬’-এর বিধি ৭ ও ৮ অনুসারে শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে ব্যবস্থা নিতে সংশ্লিষ্টদের নিষ্ক্রিয়তা প্রশ্নে রুল জারি করেন হাইকোর্ট। এতে শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে এবং শব্দদূষণে ক্ষতিগ্রস্ত ট্রাফিক পুলিশ ও রিকশাচালকদের ক্ষতিপূরণ দিতে কেন নির্দেশ দেয়া হবে না, তা জানতে চেয়েছেন হাইকোর্ট।

বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব হেলথ সায়েন্সেসের গত বছরের গবেষণা প্রতিবেদন বলছে, ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের রাজপথে শব্দের মাত্রা ৮৪ থেকে ৯৯ ডেসিবল, যা অনুমোদিত মাত্রা ৬০ ডেসিবলের চেয়ে অনেক বেশি। এতে আরও বলা হয়, ঢাকার প্রতি চারজনে একজন বা প্রায় ২৫ দশমিক ৪ শতাংশ মানুষের কানে কম শোনার সমস্যায় ভুগছেন।

কারওয়ান বাজার মোড়ে বিহঙ্গ পরিবহনের চালক কবির হোসেন ভিউজ বাংলাদেশকে বলেন, ‘সকালে গাড়ি নিয়ে বের হই মিরপুর থেকে, যাই সদরঘাট। গভীর রাত পর্যন্ত চলাচল করি। সারা দিন রাস্তায় প্রচণ্ড শব্দে কান ঝালাপালা হয়ে যায়। কানেও এখন কম শুনি। রাতে বাসায় গেলে সবার সঙ্গে জোরে (উচ্চ স্বরে) কথা বলি। আর সবার কথা আমি আস্তে শুনি’।

শাহবাগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষর্থী নওরিন তৃপ্তি বলেন, ‘মোহাম্মদপুর থেকে ক্যাম্পাসে আসা-যাওয়া পথে যানবাহনের হর্নের শব্দে মাথা ধরে যায়। ক্লাসে ঢুকে অসুস্থ লাগে, আবার বাসায় ফিরলেও তাই। গাড়ির হর্ন থেকে বাঁচতে রাস্তায় কানে হেডফোন দিয়ে গান শুনি। তাতেও দেখি কানে সমস্যা হচ্ছে। আসলে বুঝতে পারছি না, শব্দদূষণ থেকে কীভাবে মুক্তি পাবো’।

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) মিরপুর ট্রাফিক জোনের এডিসি ইয়াসিনা ফেরদৌস ভিউজ বাংলাদেশকে বলেন, ‘আমরা সাধারণত হাইড্রোলিক হর্ন ব্যবহারকারীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিয়ে থাকি। ট্রাফিক পুলিশ ইচ্ছে করলেই সাধারণ যানবাহনের অযথা হর্ন বাজানোর ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে পারে না। হর্নের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। তবে এই আদালত প্রতিদিন নগরীর সব পয়েন্টে বসেন না। তারা নির্দিষ্ট কয়েকটি পয়েন্টে মনিটর করেন। তাই এর প্রভাবটাও খুব একটা দেখা যায় না’।

তিনি জানান, ‘সড়ক আইন ২০১৮’-এর ৪৫ ধারায় জরিমানার বিধান আছে। ১৮ ধারায় সাজা হিসেবে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা করা গেলেও মামলা দেয়ার বিধান নেই। জরিমানা করতেও হয় ভ্রাম্যমাণ আদালতকে।

পরিবেশবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. কামরুজ্জামান মজুমদার ভিউজ বাংলাদেশকে বলেন, ‘বায়ুদূষণের মতো ঢাকার শব্দদূষণও মারাত্মক পর্যায়ে পৌঁছেছে। চলতি বছর শব্দদূষণে বিশ্বের শীর্ষ স্থান দখল করেছে আমাদের রাজধানী। এতেই বোঝা যায়, আমরা কতটা কষ্ট আর ঝুঁকির মধ্যে আছি।

তিনি জানান, আইনি জটিলতায় ট্রাফিক পুলিশ সরাসরি হর্নের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে না। সড়ক আইনে হাইড্রোলিক হর্ন নিষিদ্ধ। ট্রাফিক পুলিশ শুধু হাইড্রোলিক হর্নের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে। ঢাকার রাস্তায় হাইড্রোলিক হর্ন খুব একটা বাজে না। চালকরা সাধারণ হর্ন বাজালে পুলিশ ব্যবস্থা নিতে পারে না। এ দায়িত্ব দেয়া আছে ভ্রাম্যমাণ আদালতের কাছে। তারা তো ঢাকার সব রাস্তায় সব সময় থাকেন না। তাই হর্ন বেজেই চলছে এই নগরীতে।

ড. কামরুজ্জামানের মতে, আমদানি নীতিতে ১০০ ডেসিবেলের বদলে ৫০ থেকে ৬০ ডেসিবেলের হর্ন আমদানির অনুমোদন দিলে শব্দদূষণ সমস্যার অর্ধেক নিরসন হয়ে যেত। বর্তমান ‘হর্ন আমদানি নীতি’ ও ‘শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা ২০০৬’ পারস্পরিক সাংঘর্ষিক বলে মন্তব্য করেন এই পরিবেশবিজ্ঞানীও।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সাধারণ সম্পাদক শরীফ জামিল বলেন, ‘ঢাকার রাস্তায় প্রয়োজন নেই তারপরও প্রতিনিয়ত হর্ন বাজান চালকরা। অনেকেই জানাচ্ছেন, মনের অজান্তেই নাকি অনেক সময় হর্ন বাজান তারা। এটা নাকি তাদের অভ্যাস হয়ে গেছে। ঢাকার শব্দদূষণের অন্যতম কারণ এই বদভ্যাস। আসলে মানুষ সচেতন না হলে আইন, ভ্রাম্যমাণ আদালত কিংবা ট্রাফিক পুলিশ- কোনোকিছু দিয়েই শব্দদূষণ থেকে মুক্তি মিলবে না’।

পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান ভিউজ বাংলাদেশকে বলেন, ‘ঢাকার রাস্তায় বেশিরভাগ হর্নই বাজানো হয় অপ্রয়োজনে। সিগন্যাল ছাড়লেই অযথা হর্ন বাজানো শুরু করেন বাস, প্রাইভেটকার, সিএনজিচালিত অটোরিকশা কিংবা মোটরসাইকেল চালক, সবাই। ট্রাফিক পুলিশের তখন কিছুই করার থাকে না। আসলে শুধু আইন করে এই সমস্যার সমাধান হবে না। সাধারণ মানুষকে আগে সচেতন হতে হবে’।

হর্ন আমদানি নীতি ও শব্দদূষণ নীতি পারস্পরিক সাংঘর্ষিক কি-না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘শব্দদূষণ নীতি ও হর্ন আমদানি নীতির কিছু পরিবর্তন দরকার। হাইকোর্ট তো মহাসড়ক ছাড়া যে কোনো শহরে হাইড্রোলিক হর্ন সম্পূর্ণ নিষিদ্ধই করেছেন। সেটা মানলেও শব্দদূষণ অনেকটাই কমে আসত’।

শিগগিরই শব্দদূষণ রোধে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কঠোর ব্যবস্থা নেবে বলেও আশ্বাস উপদেষ্টা রিজওয়ানার।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ