Views Bangladesh Logo

হাতিরঝিল প্রকল্প

শুনানির অপেক্ষায় ধুঁকছে ‘ব্যাধিতে আক্রান্ত’ ঢাকার ফুসফুস

রাজধানী ঢাকার সৌন্দর্যপ্রেমীর কাছে অন্যতম আকর্ষণীয় একটি স্থান হাতিরঝিল- বেগুনবাড়ী প্রকল্প। পরিকল্পনা ছিল দূষণের নগরী ঢাকার এই স্থানটিতে মানুষ নির্মল বাতাসে প্রাণভরে একটু শ্বাস নেবে; কিন্তু যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ঢাকার ফুসফুসখ্যাত এই প্রকল্পটি এখন যেন মরণ ব্যাধিতে আক্রান্ত। নান্দনিক স্থাপনা আর নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকে ছাপিয়ে ঝিলের কালচে পানি ছড়াচ্ছে মারাত্মক দুর্গন্ধ।

অথচ হাতিরঝিলের পানি ও এর নান্দনিক সৌন্দর্য মহামূল্যবান জাতীয় সম্পত্তি উল্লেখ করে তার সংরক্ষণ-উন্নয়নে কয়েক দফা নির্দেশনার পাশাপাশি ৯ দফা পরামর্শ দেন হাইকোর্ট। সেই রায়ের কার্যক্রমের ওপর স্থিতাবস্থা এখনো বহাল রয়েছে। সর্বোচ্চ আদালতে এ-সংক্রান্ত আপিল আছে শুনানির অপেক্ষায়। হাতিরঝিল-বেগুনবাড়ী প্রকল্পের লেআউট প্ল্যানের বাইরে অবৈধ স্থাপনা ও ব্যবসায়িক কার্যক্রম পরিচালনার বৈধতা প্রশ্নে ও ঝিলের পানি বিশুদ্ধ রাখতে ২০১৮ সালে পরিবেশবাদী সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ রিট করে।

রিটটির চূড়ান্ত শুনানি নিয়ে ২০২৩ সালের ৩০ জুন হাইকোর্ট কয়েক দফা নির্দেশনা ও পরামর্শসহ রায় দেন। যাতে বলা হয়-


১. হাতিরঝিল এলাকায় হোটেল, রেস্টুরেন্টসহ সব বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান বরাদ্দ-নির্মাণ সংবিধান, পরিবেশ আইন, পানি আইন ও তুরাগ নদের রায় অনুযায়ী বেআইনি ও অবৈধ।


২. হাতিরঝিল প্রকল্প এলাকায় বরাদ্দকৃত সব হোটেল, রেস্টুরেন্ট ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান অবৈধ ও এখতিয়ারবহির্ভূত মর্মে তার বরাদ্দ বাতিল ঘোষণা করা হলো। রায়ের অনুলিপি পাওয়ার পরবর্তী ৬০ দিনের মধ্যে সব হোটেল, রেস্টুরেন্ট ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান উচ্ছেদের জন্য নির্দেশ দেয়া হলো।

৩. হাতিরঝিল-বেগুনবাড়ী সম্পূর্ণ প্রকল্পটি সংরক্ষণ, উন্নয়ন ও পরিচালনার জন্য একটি আলাদা কর্তৃপক্ষ তথা ‘হাতিরঝিল লেক সংরক্ষণ, উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ’ প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের সরাসরি অধীনে গঠন করার পরামর্শ দিয়েছেন হাইকোর্ট।


৪. বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) প্রকৌশল বিভাগ ও বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ২৪তম ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন ব্রিগেডকে যৌথভাবে হাতিরঝিল প্রকল্প এলাকার স্থায়ী পরামর্শক নিয়োগ দেয়ার পরামর্শ দেয়া হয় হাইকোর্টের রায়ে।

৫. হাইকোর্টের অপর পরামর্শে জনসাধারণের ব্যবহারের জন্য মাটির নিচে আন্তর্জাতিক মানের শৌচাগার স্থাপন করতে বলা হয়।


৬. আদালতের দেয়া পরামর্শের মধ্যে রয়েছে নির্ধারিত দূরত্বে বিনামূল্যে জনসাধারণের জন্য সুপেয় পানির ব্যবস্থা করা।


৭. হেঁটে চলার রাস্তা, বাইসাইকেল লেন ও বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন ব্যক্তিদের জন্য আলাদা লেন তৈরি করা।

৮. পানির জন্য ক্ষতিকর—এমন যান্ত্রিক যান তথা ওয়াটার ট্যাক্সি সার্ভিস ব্যবহার নিষিদ্ধ করা। লেকে মাছের অভয়ারণ্য করা। এবং


৯. হাতিরঝিল-বেগুনবাড়ী প্রকল্পটি বাংলাদেশের প্রথম বাঙালি বিজ্ঞানী স্যার জগদীশ চন্দ্র বসুর নামে নামকরণ করা।

এ ছাড়া. হাইকোর্টের রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, ‘প্রতিটি ফোঁটা পানি অতি মূল্যবান। পানির চেয়ে তথা সুপেয় পানির চেয়ে মূল্যবান আর কোনো সম্পদ এ পৃথিবীতে নেই। সুতরাং হাতিরঝিলের প্রতি ফোঁটা পানির দূষণ প্রতিরোধ একান্ত আবশ্যক।’

হাইকোর্টের ওই রায়ের বিরুদ্ধে রাজউক লিভ টু আপিলের পাশাপাশি স্থগিতাদেশ চেয়ে আবেদন করে, যা গত বছরের ১৯ জুন আপিল বিভাগের চেম্বার আদালতে শুনানির জন্য ওঠে। সেদিন চেম্বার আদালত রায়ের কার্যক্রমের ওপর স্থিতাবস্থা দিয়ে আবেদনটি আপিল বিভাগের নিয়মিত বেঞ্চে শুনানির জন্য পাঠান। এখন আবেদনটি আপিল বিভাগে শুনানির অপেক্ষায় আছে।

এ ব্যাপারে রাজউকের আইনজীবী ইমাম হাছান ভিউজ বাংলাদেশকে বলেন, ‘হাইকোর্টের রায়ে আপিল বিভাগের চেম্বার জজ আদালত স্থিতাবস্থা দেয়ায় হাতিরঝিলে থাকা বাণিজ্যিক স্থাপনা আপাতত সরাতে হচ্ছে না। স্থাপনাগুলো যেভাবে আছে, সেভাবেই থাকবে। অর্থাৎ আপাতত বাণিজ্যিক স্থাপনাগুলো উচ্ছেদ করতে হচ্ছে না। তবে পানি দূষণের বিষয়টি দেখবে রাজউক।’

ব্যবসায়ীদের পক্ষের আইনজীবী আহসানুল করিম বলেন, ‘হাতিরঝিল নিয়ে হাইকোর্টের দেয়া রায়ের কার্যক্রমের ওপর স্থিতাবস্থা এখনো আছে। আপিল বিভাগে এটি শুনানির জন্য কার্যতালিকায় আছে। বলা যেতে পারে শুনানির অপেক্ষায় আছে। আশা করি, সর্বোচ্চ আদালতে হাতিরঝিলের বিষয়ে কমপ্লিট সিদ্ধান্ত আসবে।’

রিটকারী আইনজীবী মনজিল মোরসেদ বলেন, ‘হাইকোর্টের রায়ে স্থিতাবস্থা বজায় রাখতে বলা হয়েছে চেম্বার জজ আদালতের আদেশে। এ বিষয়ে হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে রাজউকের করা লিভ টু আপিল শুনবেন আপিল বিভাগ। আশা করছি, সর্বোচ্চ আদালতে হাইকোর্টের রায় বহাল থাকবে।’

সরেজমিন হাতিরঝিল এলাকায় দেখা গেছে, হাতিরঝিলের ময়লা-আবর্জনা যুক্ত নোংরা পানি এতটা দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে যে, নাক চেপে অতিক্রম করতে হয় পথ। এ কালো পানিটা আশপাশের বিভিন্ন স্যুয়ারেজের লাইন দিয়ে এসে হাতিরঝিলে পড়ছে বলে জানা গেছে। পানির বোতল, কোমল পানীয়ের বোতল, চিপসের প্যাকেট সবই ফেলে দিচ্ছেন রাস্তার নিচে। অবশেষে বৃষ্টিতে অথবা প্রাকৃতিক নিয়মে গড়িয়ে গড়িয়ে তা পানিতে গিয়ে পড়ছে অথচ কিছু দূর পরপরই রাজউকের বসানো অনেক আবর্জনা রাখার পাত্র রয়েছে।

হাতিরঝিল ছিল একটি দুর্গন্ধময় ডোবা। সেই ডোবা ও এর আশপাশের এলাকাকে সুন্দর ও পরিবেশবান্ধব করার কার্যকর উদ্যোগ নেয়া হয় ২০০৭ সালে। উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ শেষ হয় ২০১৯ সালে। এ পর্যন্ত ৩১১ একর জমির ওপরে গড়ে তোলা প্রকল্পটি বাস্তবায়নে ব্যয় হয়েছে ২ হাজার ২৩৬ কোটি টাকা। এখানে চওড়া রাস্তাসহ গাড়ি পারাপারের জন্য নান্দনিক সেতুর পাশাপাশি করা হয়েছে বনায়ন।

কিন্তু প্রকল্প বাস্তবায়নের কয়েক বছরের মধ্যেই এর মূল নকশাবহির্ভূত নানা রকম বাণিজ্যিক স্থাপনা গড়ে ওঠে। এসব স্থাপনা উচ্ছেদের বিষয়ে সর্বোচ্চ আদালতের স্থিতাবস্থা থাকায় তা উচ্ছেদও করতে পারছে না আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারি বাহিনীর সদস্যরা।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ