হাইকোর্টের রায় উপেক্ষিত: পর্ব ৫
ঢাকার খালের পানি আর নদীতে গড়ায় না
চতুর্থ পর্বের পর
ঢাকা এক সময় ছিল প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত। যার মূলে ছিল শহরের অভ্যন্তরে বয়ে চলা শতাধিক খাল। যেগুলো সংযুক্ত ছিল নগরীর চারপাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, তুরাগ ও বালু নদীর সঙ্গে। সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে প্রচলিত উন্নয়নের নামে এই শহরের অধিকাংশ খালের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে গেছে। যে কয়েকটি অবশিষ্ট আছে তাও চরম সংকটাপন্ন। শীতলক্ষ্যা, তুরাগ, বালু ও বুড়িগঙ্গা এই চারটি নদনদী রক্ষায় ২০০৯ সালে হাইকোর্ট থেকে ১২ দফা নির্দেশনা দেয়া হয়েছিল। নির্দেশনায় ঢাকা শহরের মধ্যে থাকা খালগুলো দখলমুক্ত করে পানি প্রবাহের ব্যবস্থা করার জন্য বলা হয়। যাতে করে খালের পানি নদীতে গড়ায়। রাজধানীর জলাবদ্ধতা নিরসনে দ্রুত এ নির্দেশনা পালন করতে বলেন হাইকোর্ট। অথচ গত ১৫ বছরেও হাইকোর্টের ওই নির্দেশনা বাস্তবায়ন হয়নি।
ঢাকার খালের ইতিহাস অনুসন্ধানে ৪৭টি খালের কথা বলা হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে কল্যাণপুর প্রধান খাল, ইব্রাহিমপুর, আগারগাঁও, শ্যাওড়াপাড়া, মহাখালী, বেগুনবাড়ি, গুলশান, বনানী, কাটাসুর, আব্দুল্লাহপুর, বাউনিয়াবাদ, রূপনগর, দিয়াবাড়ি, শাহজাহানপুর, কাঁটাসুর, রামচন্দ্রপুর, বাইস ডেকি, হাতিরপুল, পরীবাগ, রাজাবাজার, রায়েরবাজার, মোহাম্মদপুর, হাজারীবাগ, কামরাঙ্গীরচর, গোপীবাগ, সেগুনবাগিচা, ধোলাইখাল, খিলগাঁও, বাসাবো, ধলপুর, মান্ডা, পান্থপথ, গজারিয়া, দক্ষিণগাঁও, নন্দিপাড়া, সুতিখাল, বাড্ডা, গুলশান, মহাখালী, ধানমন্ডি, মেরাদিয়া ও গজারিয়া খাল অন্যতম। এর মধ্যে অধিকাংশ খালের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে গেছে।
ওয়াটার কিপার্স বাংলাদেশের প্রধান সমন্বয়ক ও বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সাধারণ সম্পাদক শরিফ জামিল ভিউজ বাংলাদেশকে বলেন, ‘শাহবাগ থেকে মগবাজার পর্যন্ত খাল ছিল, ঢাকা ওয়াসার মানচিত্রে এর নাম পরীবাগ খাল। তবে সেখানে এখন খালের চিহ্ন নেই। ঠিক একইভাবে ধোলাইখাল, রায়েরবাজার, আরামবাগ, গোপীবাগ, সেগুনবাগিচা, কাঁঠালবাগান, নারিন্দা, ধানমন্ডি খালের (বর্তমানে সেখানে পান্থপথ রোড) কোনো অস্তিত্বই এখন নেই। রাজধানীর অন্যতম পুরোনো খাল আদি বুড়িগঙ্গা। মূলত এটি বুড়িগঙ্গার একটি অংশ, যা বুড়িগঙ্গাকে সংযুক্ত করেছে ধলেশ্বরী ও তুরাগের সঙ্গে। সেই আদি বুড়িগঙ্গা দখল-দূষণে হারিয়ে গেছে। এমন অবস্থা মোহাম্মদপুরের বছিলা এলাকার কাঁটাসুর ও রামচন্দ্রপুর খালেরও। শুধু এসব এলাকা নয়, রাজধানী ঢাকার সব খালের চিত্র একই রকম। অনেক খাল এখন বিলুপ্ত। যেগুলো রয়েছে তার বেশিরভাগই সংকুচিত হয়ে পড়ছে। আগে খালের প্রস্থ ছিল ১৫০ ফুটের বেশি। খালের সঙ্গে নদীর যে যোগাযোগ ছিল তা এখন বিচ্ছিন্ন। খালের পানি এখন আর নদীতে গড়ায় না। খালগুলো হারানোর সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে জলাবদ্ধতা।
রাজধানীতে কতটি খাল ছিল বা আছে তার সুনির্দিষ্ট সংখ্যা পাওয়া যায়নি। ঢাকা জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের প্রতিবেদন অনুযায়ী খালের সংখ্যা ৪৭টি। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান রিভার অ্যান্ড ডেল্টা রিসার্চ সেন্টারের হিসাব অনুযায়ী ঢাকা শহরে ৫৬টি খালের অস্তিত্ব থাকলেও তার সবই মৃতপ্রায়। ঢাকা ডিটেইল্ড এরিয়া প্লানে (ড্যাপ) ঢাকায় মোট খালের সংখ্যা ৪৩টি বলে উল্লেখ করা হয়েছে। জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন রাজধানী ঢাকার খাল সম্পর্কে ৫৭ পৃষ্ঠার এক বিশদ প্রতিবেদন তৈরি করেছে। খাল হারিয়ে যাওয়ার সব তথ্য রয়েছে ওই প্রতিবেদনে। নদী রক্ষা কমিশন ঢাকাসহ আশপাশের এলাকা মিলিয়ে মোট ৭৭টি খালের অস্তিত্ব চিহ্নিত করেছে।
রিভার অ্যান্ড ডেল্টা রিসার্চ সেন্টার (আরডিআরসি) সম্প্রতি রাজধানীর জলাবদ্ধতা নিরসনে বেশ কয়েকটি খাল খননের পরামর্শ দিয়েছে। এর মধ্যে করেছে- রূপনগর মেইন খাল, বাউনিয়া খাল, বাইশতেকি খাল, সাংবাদিক কলোনি খাল, কল্যাণপুর খাল, ইব্রাহিমপুর খাল, পান্থপথ বক্স কালভার্ট খাল, রায়েরবাজার খাল, জিরানী খাল, রামপুরা খালের দক্ষিণ প্রান্ত, দোলাই খাল, কদমতলী খাল ও মান্দা খাল। গবেষণায় যে ৯টি জলাবদ্ধতার ‘হটস্পট’ চিহ্নিত করা হয়েছে: পল্লবী শিয়ালবাড়ি, রূপনগর ও ইস্টার্ন হাউজিং; কালশী ও মিরপুর ১১; টোলারবাগ, আহমেদনগর ও পাইকপাড়া; শেওড়াপাড়া, কাজীপাড়া ও কাফরুল; কলাবাগান, ধানমন্ডি ২৭, কাঁঠালবাগান, গ্রিনরোড ও হাতিরপুল; হাজারীবাগ, নবাবগঞ্জ, রায়েরবাজার, পশ্চিম ধানমন্ডি ও ঢাকা নিউমার্কেট; রামপুরা ও বাড্ডা; সূত্রাপুর, ওয়ারী, নবাবপুর, কাজী আলাউদ্দিন রোড, সিদ্দিকবাজার, নারিন্দা ও তাঁতীবাজার এবং জুরাইন, সিদ্ধিরগঞ্জ, জাকের মঞ্জিল, শ্যামপুর, পূর্ব জুরাইন, সাদ্দাম মার্কেট ও রায়েরবাগ। আরডিআরসির চেয়ারম্যান মোহাম্মদ এজাজ ভিউজ বাংলাদেশকে বলেন, ‘একসময় ঢাকা থেকে বৃষ্টির পানি সরতে পারে এমন ৭৭টি খাল ও লেক ছিল। এখন এগুলোর বেশিরভাগই আংশিক বা সম্পূর্ণভাবে দখল করা হয়েছে, যার জন্য জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হচ্ছে।’ তিনি বলেন, ‘চিহ্নিত ১৫টি খাল খনন করতে পারলে নগরীর জলাবদ্ধতা সমস্যার ৮০ শতাংশ সমাধান হবে।’
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও পরিবেশবাদী সয়ংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট মনজিল মোরসেদ ভিউজ বাংলাদেশকে বলেন, ‘ঢাকার খালগুলো দিয়ে শহরের অভ্যন্তরে বিভিন্ন স্থানে যাতায়াত করা যেত। স্বাভাবিক কারণেই পরবর্তী সময়ে এই এলাকায় নৌপথের মাধ্যমেই মালামাল পরিবহন ও বাণিজ্যিক প্রসার ঘটতে থাকে। অথচ যেসব খাল দিয়ে এক সময় স্টিমার চলত এখন সেসব খালের অস্তিত্বই নেই। খালের সঙ্গে নদীর যে যোগাযোগ ছিল সেটি একদম বিচ্ছিন্ন। খালের পানি এখন আর নদীতে গড়ায় না। খালগুলো হারানোর সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে জলাবদ্ধতা, পানি সংকট, তাপমাত্রা এবং হ্রাস পাচ্ছে মৎস্যসম্পদ, নষ্ট হচ্ছে জীববৈচিত্র্য। আমাদের নানা অদূরদর্শী কর্মকাণ্ড এই পরিস্থিতির জন্য দায়ী। খালগুলো ভরাট করে ভবন, রাস্তা-ঘাট, ব্রিজ, কালভার্ট, বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ও ড্রেন বানানো হয়েছে। ঢাকার কোন কোন খাল সবার চোখের সামনেই সরাসরি আবার কোনটি আবর্জনা ফেলার মাধ্যমে ধীরে ধীরে ভরাট হয়ে গেছে।’ তিনি বলেন, ‘১৯৮৮ সালে রাষ্ট্রপতির আদেশে ঢাকার খাল রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব পালন করে আসছে ঢাকা ওয়াসা। অথচ ঢাকা ওয়াসার যোগসাজশেই দখল হয়েছে অধিকাংশ খাল।’
পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান ভিউজ বাংলাদেশকে বলেন, “ঢাকার খালগুলো দিয়ে ‘ব্লু নেটওয়ার্ক’করার পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের।” যে খালগুলো এখনো উদ্ধার করা সম্ভব, সেগুলো দিয়ে এ নেটওয়ার্ক করা হবে। অবৈধভাবে দখল হওয়া ঢাকার খাল উদ্ধারে রাজউককে প্রতি সপ্তাহে অভিযান পরিচালনা করতে হবে বলে জানিয়েছেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন এবং পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। ড্যাপের প্রস্তাবনা অনুযায়ী এই ব্লু নেটওয়ার্ক তৈরির বিষয়টি নিয়ে আগানো হচ্ছে। জলাশয় ও নৌপথের সমন্বয়ে এই নেটওয়ার্ক প্রতিষ্ঠা করা হবে। তিনি বলেন, ‘অবৈধভাবে দখল হওয়া খাল উদ্ধারে রাজউককে প্রতি সপ্তাহে অভিযান পরিচালনা করতে হবে। কোনো অন্যায়কে বৈধতা দেয়া যাবে না। অবৈধ খাল উদ্ধারে প্রয়োজনে অভিযান বাড়াতে হবে।’
আরও পড়ুন
পর্ব ১
নিষিদ্ধ পলিথিনে সয়লাব সারা দেশ
পর্ব ২
নিয়মের তোয়াক্কা না করে দূষণ ছড়িয়ে চলছে ইটভাটা
পর্ব ৩
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে