নির্বাচনোত্তর বাংলাদেশের বৈদেশিক সম্পর্ক
ঢাকার কূটনীতি আরও গভীর নৈপুণ্য দাবি করে
নির্বাচন শেষ হয়েছে। ফল হয়েছে প্রত্যাশিত অনুসারেই। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা টানা চতুর্থবারের মতো বাংলাদেশের নেতৃত্ব দেবেন। নির্বাচন কেমন হবে, তা নিয়ে সব জল্পনা-কল্পনা এখন কিছুটা অপ্রাসঙ্গিক। বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় সাড়া দিতে শুরু করেছে। রাশিয়া, ভারত, পাকিস্তান, চীন, নেপাল, ভুটান, ব্রাজিল, শ্রীলঙ্কা, ফিলিপাইন, সিঙ্গাপুর, মরক্কোর রাষ্ট্রদূত, ওআইসি, এবং এমনকি আগা খান ডেভেলপমেন্ট নেটওয়ার্কের কূটনৈতিক প্রতিনিধি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে চতুর্থ মেয়াদে নির্বাচিত হওয়ার জন্য তাকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। এই অভিনন্দনের ধারা ইঙ্গিতবহ। নির্বাচন, বা বলা যায়, নির্বাচনের ফলাফল নিকটবর্তী অঞ্চলে কীভাবে গ্রহণ করা হচ্ছে, তার প্রকৃত প্রতিফলন। আরও বড় কথা, বাংলাদেশকে চীন, রাশিয়া ও ভারতের অভিনন্দন জানানো বেশ তাৎপর্যপূর্ণ।
এটি ব্যাপকভাবে মনে করা হয় যে, বাংলাদেশে যে কোনো শাসনের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য ভারতের সমর্থন গুরুত্বপূর্ণ। এ মনোভাব ২০১৪ সালের নির্বাচনে ভারতের সরাসরি হস্তক্ষেপ থেকে উদ্ভূত হয়ে থাকতে পারে, যার যথেষ্ট নথিপত্র রয়েছে। ভারতের রাজনৈতিক সমর্থন এতটাই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে যে, এমনকি বিরোধী দলগুলো, যাদের রাজনৈতিক ভিত্তি ভারত-বিরোধিতায় নিহিত, ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে ভারতের অনুগ্রহ লাভের প্রয়াসে ধরনা দিতে হয়েছিল; কিন্তু শেষ পর্যন্ত কোনো সাফল্য আসেনি৷ ভারতের ক্রমবর্ধমান প্রভাব আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে শক্তিশালী দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক গড়ে তুলেছে। আওয়ামী লীগ সরকার ভারতের নিরাপত্তাবিষয়ক উদ্বেগ, বিশেষ করে উত্তর-পূর্ব ভারতে প্রবেশাধিকার, সংযোগ প্রকল্প এবং ভারতবিরোধী বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর বিরুদ্ধে পদক্ষেপের মাধ্যমে সমাধান করেছে। ভারত ও বাংলাদেশ দুই দেশের বহু বিশেষজ্ঞ এবং এমনকি ভারতীয় মিডিয়া ও থিংক ট্যাংকগুলোর মতে, ভারত এর বিনিময়ে বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক বিপর্যয় উপেক্ষা করে অকুণ্ঠভাবে আওয়ামী লীগ সরকারের পাশে থেকেছে।
ভারতীয় মিডিয়া এবং থিঙ্ক ট্যাংকগুলোর একটি উল্লেখযোগ্য অংশ ২০২৪ সালের নির্বাচনের জন্য বর্তমান শাসনের পক্ষে সমর্থন জানিয়েছিল। যদিও সমর্থনটি আগের মতো স্পষ্ট ছিল না বলে, কোনো কোনো বিশেষজ্ঞ মনে করেন যে ভারত ২০২৪ সালের নির্বাচনের প্রতি একটি ভিন্ন অবস্থান গ্রহণ করেছে। তাদের মনে হয়েছে, ভারত এবার আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় ফিরিয়ে আনতে চায় ঠিকই; কিন্তু একটি অপেক্ষাকৃত দুর্বল আওয়ামী লীগকে চায়, যাতে নির্বাচনটি কম বিতর্র্কিত এবং বাংলাদেশের নির্বাচন ও রাজনীতিতে আগের মতো প্রকাশ্যে হস্তক্ষেপ করতে না হয়। বাংলাদেশের নেতৃত্বে ভারত যে ধরনের আওয়ামী লীগই চেয়ে থাক না কেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের বৃদ্ধি এবং উন্নতির প্রশ্নে অপরিহার্য ভূমিকা পালন করে চলেছেন। ভারতের জন্য এ মুহূর্তে বাংলাদেশে আরেকটি প্রধান অগ্রাধিকার হলো বাংলাদেশের স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা। আওয়ামী লীগ সরকার গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রতি আনুগত্য ও মানবাধিকার মেনে চলার সময় কীভাবে বাংলাদেশে স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা যায়, তা নিয়ে তারা দ্বিধাদ্বন্দ্বে রয়েছে। এটি মূলত গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ এবং মানবাধিকারের মান সমুন্নত রাখার পশ্চিম, তথা মার্কিন চাপ থেকে উদ্ভূত হয়েছে।
ভারতের আরেকটি চ্যালেঞ্জ হচ্ছে মিয়ানমার ইতিমধ্যেই অস্থিতিশীল। দিল্লি দুই রাষ্ট্রের সঙ্গে সুসম্পর্ককে বিপদের মধ্যে ফেলতে পারে না; এই দুই রাষ্ট্র চীনের সঙ্গে কেবল ঘনিষ্ঠই নয়, ভারতের যেসব রাজ্যে অভ্যন্তরীণ, ধর্মীয় ও জাতিগত সমস্যা থেকে অস্থিতিশীলতা রয়েছে, তাদের পড়শি। আপাতত, রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করার জন্য আওয়ামী লীগ তাদের সেরা বাজি, যা ভারতকে কাম্য স্বস্তি বোধ করার সুযোগ দেয়। এইভাবে, ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক বাড়তে থাকবে, যদিও বৈশ্বিক/পশ্চিমা দৃষ্টিকোণ থেকে ক্রমবর্ধমান অস্বস্তির মধ্যে। এ প্রসঙ্গে ৭ জানুয়ারির নির্বাচন এবং তার ফলাফলে যুক্তরাষ্ট্র, ইইউ ও যুক্তরাজ্য কীভাবে সাড়া দিচ্ছে তা দেখার জন্য অধীর অপেক্ষারও অবসান হয়েছে। যদিও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যুক্তরাষ্ট্রের যেকোনো বিরূপ পদক্ষেপের আশঙ্কা উদ্বেগ উড়িয়ে দিয়েছেন। তবে, মার্কিন প্রতিক্রিয়া অবশ্যই বাংলাদেশের বৈশ্বিক সম্পর্কের ওপর প্রভাব ফেলবে। অন্যান্য পশ্চিমা দেশের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও মানবাধিকার সংস্থাগুলো বাংলাদেশে মানবাধিকার সংক্রান্ত উদ্বেগ প্রকাশ করেছে, যার মধ্যে রয়েছে নাগরিক পরিসরের ক্রমবর্ধমান সংকোচন, বর্ধিত নজরদারি, ভীতি প্রদর্শন এবং প্রতিশোধমূলক আচরণ যা প্রায়ই স্ব-সেন্সরশিপের দিকে পরিচালিত করে।
মার্কিন ভিসা নিষেধাজ্ঞা বাংলাদেশে গণতন্ত্র ও শাসনব্যবস্থা নিয়ে মার্কিন উদ্বেগের প্রত্যক্ষ প্রতিক্রিয়া। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বহুবার বাংলাদেশে মানবাধিকার নিয়ে তার উদ্বেগ প্রকাশ করেছে এবং র্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞাগুলো বছরের পর বছর ধরে জমে থাকা উদ্বেগের প্রত্যক্ষ ফল। এমন খবর রয়েছে যে বাংলাদেশ শ্রম সমস্যাগুলোর জন্যও নিষেধাজ্ঞা পেতে পারে, এবং অনেকে এই উদ্বেগজনক ভয়কে বাংলাদেশের গণতন্ত্রের অবস্থা এবং ২০২৪ সালের বাংলাদেশের নির্বাচনের বিষয়ে মার্কিন উদ্বেগের সঙ্গে যুক্ত করে থাকেন। সেই আশঙ্কা এখনো বাস্তবে প্রকাশ পায়নি। উদ্বেগজনক আশঙ্কাগুলো মূলত প্রয়োজনীয় উন্নয়ন এবং উন্নতির অভাব থেকে উদ্ভূত যার সমাধান করা হবে বলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিমারা আশা করেছিল। যাই হোক, এটিও একটি সত্য যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের উন্নয়নে এবং বিগত দশকগুলোতে একইভাবে মার্কিন সহায়তা প্রদানের ওপর জোর দিয়ে চলেছে। ইউএসএআইডি কান্ট্রি ডেভেলপমেন্ট স্ট্র্যাটেজিতে জোর দিয়ে বলা হয়েছে যে ইউএসএআইডির মাধ্যমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, জ্বালানি, পরিবেশ, খাদ্য নিরাপত্তা, দুর্যোগ প্রস্তুতি, গণতন্ত্র ও সুশাসনে তার সহযোগিতা আরও বৃদ্ধি করবে।
বাংলাদেশে সবচেয়ে বড় বিনিয়োগকারী যুক্তরাষ্ট্র। বাংলাদেশের জ্বালানি খাতে শেভরনের বিনিয়োগ অব্যাহত থাকার পাশাপাশি অন্যান্য মার্কিন কোম্পানিও বাংলাদেশের অর্থনীতিতে নিয়মিত সংশ্লিষ্ট হতে চায়। বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম তেল এবং গ্যাস কোম্পানি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক এক্সনমোবিল করপোরেশন প্রয়োজনীয় দ্বি ও ত্রিমাত্রিক সিসমিক জরিপ ব্যবহার করে আন্তর্জাতিক জলসীমায় গভীর সমুদ্রের সব ব্লক ও কিছু উপকূলীয় ব্লকে গ্যাস অনুসন্ধানে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। বাংলাদেশ সরকার বেসরকারি খাতে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) সরবরাহের জন্য আমেরিকান কোম্পানি এক্সেলরেট এনার্জি বাংলাদেশ লিমিটেডের সঙ্গে চুক্তি করার পরিকল্পনা করছে। এ ব্যবস্থার অধীনে কোম্পানিটি ২০২৬ থেকে শুরু করে ১৫ বছরের জন্য এলএনজি সরবরাহ করবে। যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে এফ-১৬ কেনার বিষয়ে ঢাকার গুজব রয়েছে, যদিও স্টেট ডিপার্টমেন্ট ১৯৯৯ সালে এসব যুদ্ধবিমান বাংলাদেশের জন্য উপযোগী নয় এ কথা বলে বাংলাদেশের কাছে এগুলো বিক্রি করতে রাজি হয়নি। বাংলাদেশের সামরিক বাহিনী বিকশিত হয়েছে এবং এর সক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে। কেনাকাটার উদ্যোগ নিলে এবার পরিস্থিতি ভিন্ন হতে পারে। একাধিক মতবিনিময়ে, মার্কিন কর্মকর্তারা বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক ‘দৃঢ় ও গভীর’ করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন। এ ছাড়া, বাংলাদেশে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মূল ভূ-কৌশলগত অগ্রাধিকারের মধ্যে রয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলে যোগদানের জন্য বাংলাদেশকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করছে, যা তার এশিয়া-সংক্রান্ত প্রধান অবস্থান ও চীনের উত্থান মোকাবিলার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মূল কৌশলগত দৃষ্টিভঙ্গি।
এটি আমাদের বাংলাদেশে চীনের সংশ্লিষ্টতা এবং ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের ফলাফলে বেইজিং যে ইতিবাচক সাড়া দিয়েছে তার প্রতি মনোযোগ ফেরায়। চীনা রাষ্ট্রদূতের মতে, ‘চীন ও বাংলাদেশ যৌথভাবে এ বছর আমাদের সহযোগিতার কৌশলগত অংশীদারত্বকে এগিয়ে নিয়ে গেছে। চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং এবং বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চার বছর পর আবার মুখোমুখি আলোচনায় বসে চীন-বাংলাদেশ সম্পর্কের উন্নয়নে নতুন এবং শক্তিশালী অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন। বাংলাদেশের নির্বাচনি বছরজুড়ে, জাতীয় সার্বভৌমত্ব, স্বাধীনতা এবং আঞ্চলিক অখণ্ডতা রক্ষায় এবং বহিরাগত হস্তক্ষেপের বিরোধিতা করার জন্য চীন সর্বদা বাংলাদেশকে তার দৃঢ় সমর্থন দিয়েছে। ‘এটা আমাদের সত্যিকারের বিশ্বাস যে, আসন্ন নির্বাচন বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় এবং বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ ও ভাগ্যের সিদ্ধান্ত তার নিজের জনগণেরই হবে। একটি সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের পথপরিক্রমায় চীন সবসময় বাংলাদেশি জনগণের পাশে থাকবে।’ সুতরাং, বাংলাদেশের নির্বাচনের পদ্ধতি ও ফলাফল সম্পর্কে চীনের দৃষ্টিভঙ্গি বেশ স্পষ্ট এবং বেইজিং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অভিনন্দন জানানো প্রথম রাজধানীগুলোর মধ্যে থাকায় পরিষ্কার ফুটে উঠেছে।
মস্কোর ক্ষেত্রেও একই কথা বলা যেতে পারে। নির্বাচন একটি দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় উল্লেখ করে রাশিয়া দৃঢ়ভাবে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে যে যুক্তরাষ্ট্র নির্বাচন পদ্ধতিকে প্রভাবিত করার চেষ্টার মাধ্যমে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ইস্যুতে হস্তক্ষেপ করার চেষ্টা করছে। রাশিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান এবং ঐতিহাসিক সম্পর্ক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিমাদের দ্বারা আপাতদৃষ্টিতে ভ্রুকুটি করছে, কারণ তারা ক্রমবর্ধমান চীনা বিনিয়োগ এবং বাংলাদেশে জড়িত থাকার বিষয়ে উদ্বিগ্ন। ইইউসহ প্রধান প্রধান পশ্চিমা দেশের কেউই ৭ জানুযারির নির্বাচনে পর্যবেক্ষক দল পাঠায়নি। যারা এসেছেন তারা পশ্চিমের নিজ নিজ সরকারের প্রতিনিধি নন। ইইউ উল্লেখ করে যে তারা বাজেটের অভাবে কোনো পর্যবেক্ষক দল পাঠায়নি; কিন্তু পরবর্তী আলোচনা ও বিবৃতি থেকে বোঝা যায় যে তারা বাংলাদেশে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের অনুকূল পরিবেশে আস্থাশীল নয়। যুক্তরাজ্য একই ধরনের ইঙ্গিত দিয়েছে। যাই হোক, এই দেশগুলো নির্বাচনের আগে যা-ই মনে করা থাক, ৭ জানুয়ারি বিদায় নিয়েছে। আমাদের সবাইকে আগামী দিনে কী এবং কীভাবে সমস্যাগুলো বিকশিত হবে সেদিকে তাকাতে হবে। ভারত, চীন এবং রাশিয়ার জন্য বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে সামনের রাস্তা পরিষ্কার, যদিও এটি বাংলাদেশে ভারতীয় বনাম চীনা ফ্যাক্টরের কারণে কিছুটা বাধাগ্রস্ত হতে পারে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারত-চীন প্রতিযোগিতার গোলকধাঁধাকে কৌশলে ব্যবহার করেছেন। এটি অব্যাহত থাকার সম্ভাবনা রয়েছে, তবে এই অঞ্চলে মার্কিন অগ্রাধিকার থেকে উদ্ভূত নতুন সতর্কতাসহ। যদিও দক্ষিণ এশিয়ার জন্য ভারতকে তার প্রধান মিত্র হিসেবে এবং চীনের বিরুদ্ধে পাল্টা জবাব দিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সম্মত। যাই হোক, রাশিয়ার বিষয়ে মার্কিন উৎকণ্ঠা এড়ানো এবং সকল সম্পর্ক, বিশেষ করে বাণিজ্য সম্পর্ক বজায় রাখার জন্য দিল্লির অব্যাহত ঝোঁক একথাই বলছে যে, ভারত তার অভ্যন্তরীণ, আঞ্চলিক এবং বৈশ্বিক স্বার্থের দ্বারা নির্ধারিত নিজস্ব নীতি অনুসরণ করবে এবং শুধুমাত্র মার্কিন ইচ্ছার কাছে নতিস্বীকার করবে না। একইভাবে, এরকম সম্ভাবনাও রয়েছে যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর দ্বারস্থ হবে; অর্থাৎ, ভারতীয় ইচ্ছা থেকে বাংলাদেশ কতটা মুক্ত থাকবে। তাই, আমরা দেখতে পাব যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার মূল অগ্রাধিকার এবং লক্ষ্যগুলোর মাধ্যমে বাংলাদেশে তার সকল স্বার্থ অব্যাহত রাখার পাশাপাশি বাংলাদেশের শাসকগোষ্ঠী যেন তার গণতান্ত্রিক, মানবাধিকার এবং নাগরিক অধিকারের অগ্রাধিকারসমূহ মেনে চলে তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ইচ্ছাকৃতভাবে শক্তিশালী অবস্থান ও কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। বাংলাদেশের শ্রম খাতের বিরুদ্ধে মার্কিন নিষেধাজ্ঞাগুলো বড় আকার ধারণ করার আশঙ্কা যেমন রয়েছে, তেমনি সুশাসন ও মানবাধিকারের ক্ষেত্রে মার্কিন অগ্রাধিকারগুলো মেনে চলার জন্য বাংলাদেশ সরকারকে প্রলুব্ধ করতে বাংলাদেশের নির্বাচনোত্তর সমানের মাসগুলোয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অন্যান্য অস্ত্র ও প্রচেষ্টা নিয়ে হাজির হবে।
বাংলাদেশও রাশিয়ার সঙ্গে বর্ধিত সম্পর্ক উপভোগ করতে থাকবে, কারণ মস্কো বাংলাদেশে তার ভূ-রাজনৈতিক প্রভাব দেখাতে শুরু করেছে, বিশেষ করে অতিমারির পর থেকে। রাশিয়া কেবল বাংলাদেশেই নয়, এশিয়ার অন্যান্য দেশেও তার ভূ-রাজনৈতিক প্রভাব প্রতিষ্ঠার জন্য ভ্যাকসিন কূটনীতির মাধ্যমে অপরাপর বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক শক্তির সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছে। বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে মার্কিন অবস্থানের সমালোচনা করে আওয়ামী লীগ শাসনকে প্রকাশ্যে সমর্থন করে রাশিয়া এটা পরিষ্কার করে দিয়েছে যে ঢাকার সঙ্গে তার সম্পর্ক কেবল ইতিবাচকই নয়, তা ক্রমবর্ধমান গতিতে এগিয়ে যাবে। চীনের ক্ষেত্রেও তাই হবে। সম্পর্কগুলো শুধু একটি ইতিবাচক গতিপথের সঙ্গে উন্নত এবং বিকশিত হতে চলেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বেগ, বিশেষ করে ভারত সেখানে থাকবে, তবে প্রধানমন্ত্রী হাসিনাকে তার কূটনৈতিক নৈপুণ্য আগামী দিনে আরও বেশি প্রমাণ করতে হবে।
ইইউ রাষ্ট্রগুলোর অপেক্ষাকৃত শান্ত মনোভাব এই বার্তা দিচ্ছে যে তারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো কঠোর হতে চাইছে না, তবে গণতান্ত্রিক এবং মানবাধিকারের উন্নতি দেখতে চায়, যে বিষয়ে তারা নিয়মিতভাবে বলে আসছে এবং বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। বাংলাদেশ বা বাংলাদেশের কোনো প্রতিষ্ঠানের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা নিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলো থেকে কোনো উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়নি; কিন্তু মার্কিন দৃষ্টিভঙ্গি সর্বদা ইইউ নীতিমালাকে অভিন্ন দিকে পরিচালিত করে। যাই হোক, বাংলাদেশের মর্যাদা এলডিসি থেকে উন্নীত হওয়ার প্রেক্ষাপটে ২০২৬ সালের জন্য জিএসপি সুবিধাদি নিয়ে ইইউ ইতিমধ্যেই বাংলাদেশের সঙ্গে আলোচনা করছে। সরকারের গণতন্ত্র ও মানবাধিকার রেকর্ড উন্নত করা নিশ্চিত করতে ইইউর কাছে বাংলাদেশের সঙ্গে আলোচনার জন্য একটি শক্তিশালী অস্ত্র রয়েছে। যাই হোক, এখন অবধি এই আলোচনাগুলোর ডেমোক্লেসের তরবারিতে পরিণত হওয়ার আশঙ্কা নেই বললেই চলে।
নির্বাচনকে সামনে রেখে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তার সম্পর্ক সামলানোর চেষ্টা করেছে। এই গতিশীল ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক মোকাবিলার জন্য বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বিচক্ষণ কূটনৈতিক কৌশল এবং বিচক্ষণ সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রয়োজন হবে। চীন, রাশিয়া এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখার চেষ্টা করার সময় বাংলাদেশকেও মানবাধিকার এবং গণতান্ত্রিক নীতিগুলোকে অগ্রাধিকার দিতে হবে, বিশেষ করে সম্ভাব্য ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল গ্রহণের প্রেক্ষাপটে। তবে, যদি এই আলিঙ্গন যদি চীনের সঙ্গে সম্পর্ক বিযুক্তির শর্তে হয়, তাহলে সেটি হবে ওয়াশিংটনের তরফে একটি অবাস্তব চাওয়া, কারণ তা এমন কিছু দাবি করবে যা ভারত বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কেউই অর্জন করতে সক্ষম হয়নি; যা প্রমাণ করে যে উৎপাদন, কৌশল, সরবরাহ প্রবাহ এবং তথ্যের এই বৈশ্বিক দুনিয়ায় বিযুক্তির ধারণাটি নিছক একটি মিথ। সুতরাং, ওয়াশিংটন এখন চীনের সঙ্গে মাখামাখি কমানোর কথা বলছে, যেটি এমন একটি কৌশল যা বাংলাদেশের সঙ্গে চীনের গভীর সম্পৃক্ততার কারণেও সম্ভব নয়। যাই হোক, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগ শাসনকে উন্নত গণতান্ত্রিক ও মানবাধিকার পরিবেশের জন্য চাপ দিতে থাকবে, এবং বিশেষজ্ঞরা বিশ্বাস করেন যে সুনির্দিষ্ট নিষেধাজ্ঞাগুলো হাতের কাছে থাকতে পারে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই অস্ত্রটি বিশ্বব্যাপী, ঐতিহাসিকভাবে ব্যবহার করেছে এবং বাংলাদেশও এর থেকে মুক্ত নয়। নিষেধাজ্ঞাগুলো শত শত বছর ধরে একটি অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। সতেরো ও আঠারো শতকের মধ্যে, যুদ্ধরত ইউরোপীয় দেশগুলো বাণিজ্য নিষিদ্ধ করার জন্য একে অপরের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল। সাম্প্রতিক ইতিহাসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সুনির্দিষ্ট নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে; অর্থাৎ, এগুলো বেসামরিক লোকজনের পরোক্ষ ক্ষতি কমিয়ে অপরাধের জন্য দায়ী সংস্থা বা সরকারী কর্মকর্তাদের উদ্দেশে আরোপ করা হয়। সাম্প্রতিক সময়ে, কোনো দেশের সন্ত্রাসবাদ, পারমাণবিক অস্ত্র সঞ্চয়, মানবাধিকার লঙ্ঘন, সামরিক বিরোধ এবং অন্যান্য বৈদেশিক নীতির সঙ্গে সম্পৃক্তার কারণে সে দেশের বিরুদ্দে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। এভাবে, সুনির্দিষ্ট নিষেধাজ্ঞা আরোপ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য একটি কার্যকর বিকল্প, তবে তা আরও গুরুতর মানবাধিকার ও গণতান্ত্রিক অনুশীলন লঙ্ঘনের রেকর্ডধারী মিয়ানমারের প্রতি আরোপিত নিষেধাজ্ঞার চেয়ে বেশি হবে এমনটি ঘটবার আশঙ্কা কম।
পশ্চিমা দেশগুলো ইতিমধ্যে বাংলাদেশের নির্বাচন এবং এর ফলাফলকে স্বীকার করে বা প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে, তাদের বক্তব্যতে অভিনন্দনের লেশমাত্র নেই। তাদের বক্তব্যে অনেকটা নির্বাচনের প্রতি বিমর্ষ সারবত্তা স্বীকার প্রতীয়মান। যাই হোক, এটা অপরিহার্য যে আওয়ামী লীগ সরকার আগামী বছরগুলোতে মানবাধিকার এবং সুশাসনের রেকর্ডের উন্নতি নিশ্চিত করবে। বিশ্বের বহুমুখী ভূ-রাজনৈতিক পরিবেশে, বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক শক্তির মধ্যে একাধিক ফ্রন্টে ক্রমবর্ধমান দ্বন্দ্বের পাশাপাশি সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব এবং কারো সঙ্গেই শত্রুতা না করার কার্যকর নীতি বজায় রাখতে বাংলাদেশের প্রচলিত কূটনৈতিক কৌশল বজায় রাখা সহজ কাজ হবে না। ঢাকার কূটনীতি এখন গভীর নৈপুণ্য দাবি রাখে।
লেখক: রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিক বিষয়ের বিশ্লেষক
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে