Views Bangladesh Logo

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে বৈষম্য কমানোর বাজেট প্রত্যাশা

বিশ্বের চ্যালেঞ্জিং অর্থনীতির মুখে আমাদের মতো বিশাল জনসংখ্যার দেশে বাজেট করা কঠিন কাজ। অর্থনীতির প্রচলিত নিয়মে একে বাঁধা যায় না। রাষ্ট্রের সামাজিক, অর্থনৈতিক, নৈতিক, মেধা মননের বিকাশের ক্ষেত্রে যে কয়েকটি খাত রয়েছে তার মধ্যে শিক্ষা অন্যতম। এ খাতটি একটি রাষ্ট্রে বসবাসরত প্রতিটি নাগরিকের মেধা, চিন্তা, শক্তি স্বাভাবিক জীবন বোধের জাগরণের সঙ্গে সম্পৃক্ত; কিন্তু দুর্ভাগ্যভাবে এ খাতের উন্নয়নকল্পে যা যা পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে তা থেকে রাষ্ট্র অনেক দূরে। বড় সমসা আমাদের শিক্ষার উন্নতিকল্পে জাতীয় বাজেটে বরাদ্দ খুবই কম। অথচ আমাদের পাশ্চাত্য দেশ ভারত, নেপাল, ভুটান, শ্রীলঙ্কায় শিক্ষা খাতে বরাদ্দের পরিমাণের চেয়ে বাংলাদেশে অত্যন্ত কম।

বাংলাদেশে এমন কিছু খাত আছে যেখানে বরাদ্দ অনেক অথবা উৎপাদনশীল খাত নয় সেখানে বরাদ্দ বাড়ানো হয় আর শিক্ষা খাতে বরাদ্দ বাড়ে না বরং কমে। সাধারণত স্নাতক শিক্ষিতদের মধ্যে উচ্চ বেকারত্ব হার বিরাজ করছে, তার একটি বড় কারণ হচ্ছে যে তারা যে ধরনের শিক্ষা অর্জন করেছে আর যে ধরনের যোগ্যতার জন্য চাকরি বাজারে চাহিদা আছে তার মধ্যে বিস্তর ফারাক। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে জনসংখ্যা ক্রমাগতভাবে বাড়ার কারণে প্রতি অর্থবছরে বাজেটের পরিমাণও বাড়ে। সুতরাং আমরা বলতে পারি, রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে বসবাসরত জনগোষ্ঠীর সার্বিক উন্নয়ন ও সামাজিক নিরাপত্তাসহ বিভিন্ন সেবা খাতে অর্থ বরাদ্দের যে পরিকল্পনা সেটাই সাধারণত বাজেট হিসেবে পরিলক্ষিত হয়। আমাদের মতো দেশে মূল্যস্ফীতির বড় কারণ দুষ্প্রাপ্যতা। মাঝে মধ্যেই অনেক জিনিস দুষ্প্রাপ্য হয়ে ওঠে যা আমাদের আমদানি করতে হয়। সেগুলো আমদানি করতে আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার প্রয়োজন হয়। এ জায়গাটায় আমাদের কিছুটা ঘাটতি রয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকার এ সমস্যা কিছুটা সমাধান করতে পারলেও পুরোপুরি সন্তোষজনক এমনটা বলা যাবে না। সুতরাং বাজেটের লক্ষ্য থাকবে রাজস্বনীতি ও মুদ্রানীতির সমন্বয় করে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ।

একই সঙ্গে মূল্যস্ফীতির পেছনের কারণগুলোর দিকেও মনোযোগ দিতে হবে। কিছু কিছু পণ্যসামগ্রীর অপ্রাপ্যতা নিরসনে তা আমদানি করতে হয়। সেগুলো আমদানিতে যেন বৈদেশিক মুদ্রার ঘাটতি না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। আমাদের রপ্তানি উৎসাহিত করতে হবে। আমাদের আরেকটি বড় শক্তির জায়গা হচ্ছে বিদেশে কাজ করা শ্রমজীবী মানুষের পাঠানো রেমিট্যান্স। তা যেন অব্যাহত গতিতে বাড়তে থাকে সেটা প্রত্যাশা করছি। এজন্য ডলারের বাজারমূল্য এবং সরকারের কাছ থেকে বা ব্যাংক হারের মধ্যে পার্থক্য যত কমিয়ে আনা যায় ততই মঙ্গল। এতে হুন্ডি নিয়ন্ত্রণ করা যাবে বলে আশা করা যায়। বাজেটের উন্নয়নমূলক দিকও থাকে। তবে উন্নয়নমূলক বাজেট হিসেবে অতীতে যেভাবে খোলা হাতে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে, বিশেষ করে চোরতন্ত্র শক্তিশালী করার জন্য; এবারের বাজেটে যেন সেটা না করা হয়। যথাযথভাবে লাভ-ক্ষতি বিশ্লেষণ করে যাতে প্রকল্পগুলো নেয়া হয়।

আবার সেই সঙ্গে প্রশ্ন উঠতে পারে, যেসব প্রকল্প অর্ধসমাপ্ত আছে সেগুলোর কী হবে? এগুলো গলার কাঁটা হলেও সেগুলো শেষ বা সুসম্পন্ন করা প্রয়োজন। তা না হলে যে অর্থটা এরই মধ্যে ব্যয় হয়েছে তা পুরোটাই জলে যাবে। আংশিক শেষ হওয়া প্রকল্প শেষ করা, নতুন প্রকল্প নেয়ার ক্ষেত্রে বেহিসাবি না হয়ে হিসাবি হওয়ার দিকে জোর দিতে হবে। বড় প্রকল্প মানেই যে মানুষের উপকারে আসবে এমনটা নয়। এমন অনেক উন্নয়ন প্রকল্প আছে যাতে অল্প ব্যয় হলেও মানুষের অনেক উপকার হয়। বিশেষ করে দরিদ্র মানুষের উপকারে আসে এমন প্রকল্পগুলো সম্পন্ন করতে হবে। একসময় আমরা দরিদ্রবান্ধব বাজেট নামে একটা কথা শুনতাম, আজকাল শুনি না। প্রো-পুওর বাজেট কথাটা অবশ্য বিশ্বব্যাংকই চালু করেছিল। জানি না, বিশ্বব্যাংক সে অবস্থান থেকে সরে এসেছে কিনা। আমাদের দেশের দরিদ্র মানুষ এখন খুব কষ্টে আছে। আমরা দারিদ্র্য জয় করেছি বলে যে কথা শুনতাম আসলে দারিদ্র্য কিন্তু সেভাবে কমেনি।

বাংলাদেশের পরিসংখ্যান ব্যুরোর দারিদ্র্যের মানচিত্রেও তা উঠে এসেছে। অনেক জেলায় এখনো অর্ধ শতাংশের বেশি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করছে। দারিদ্র্যসীমায় বসবাস মানে কিছু কিছু লোক অতি দরিদ্র হবে, দারিদ্র্যসীমার নিচে অবস্থান করবে। এটা তো একটা ভয়াবহ সমস্যা। এর সমাধান কেবল কিছু সাহায্য, কিছু ভাতা দিয়ে, কিছু কল্যাণমূলক কাজে হবে না। ভাতা দিয়ে সাময়িকভাবে বিপর্যয় ঠেকানো যাবে; কিন্তু এর একটা দীর্ঘমেয়াদি সমাধান প্রয়োজন। দীর্ঘমেয়াদি সমাধান হচ্ছে কর্মসংস্থান সৃষ্টি। আর এই কর্মসংস্থান বাড়াতে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ দরকার। দেশীয় বিনিয়োগ সক্রিয় না হলে বিদেশি বিনিয়োগ আসবে না। বিদেশি বিনিয়োগ আসার পথে আমরা অনেক বাধা তৈরি করে রেখেছি। ওয়ান স্টপ সার্ভিস একটা কথার কথা হিসেবেই রয়ে গেছে। এটাকে বাস্তবে রূপান্তরিত করতে হবে। বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার সুযোগ রয়েছে, বিশ্ব অর্থনীতির পরিস্থিতিও রয়েছে; কিন্তু আমাদের অভ্যন্তরীণ পলিসি, রাষ্ট্রীয় পলিসি বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণের পথে বাধা। তার সঙ্গে দুর্নীতি অন্য একটি বড় সমস্যা। অনেক বিদেশি বিনিয়োগকারী আমাদের এখানে আসেন, কথা বলেন কিন্তু এগুলোর কারণে বিনিয়োগ না করে চলেও যান।

দেশে বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ থাকলে ব্যবসায়ী, উদ্যোক্তারা বিনিয়োগ করবেন। দেশীয় বিনিয়োগ হওয়ার অর্থ হলো দেশে বিনিয়োগ অনুকূল পরিবেশ রয়েছে। যে কারণে বারবার বলা হয়, দেশীয় বিনিয়োগ না বাড়লে বিদেশি বিনিয়োগ বাড়বে না। বিদেশি বিনিয়োগকারীরা প্রথমে দেখবে দেশের ব্যবসায়ীরা কতটা সক্রিয় এবং কতটা উৎসাহের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য করছেন। যদি তারা দেখেন যে দেশি বিনিয়োগকারী বা ব্যবসায়ীরা সেভাবে সক্রিয় নন, তাহলে স্বাভাবিকভাবেই তারা নেতিবাচক সিদ্ধান্তে পৌঁছে যাবেন। এজন্য দেশীয় বিনিয়োগকে গুরুত্ব দিতে হবে। শিক্ষা, মানবসম্পদ সৃষ্টির ওপর অগ্রাধিকার দেয়া প্রয়োজন। আমরা যদি সত্যিকার অর্থে মানবসম্পদ সৃষ্টি করতে পারি তাহলে এর সুফল দেশে অভ্যন্তরে পেতে পারি।

একই সঙ্গে দক্ষ মানবসম্পদ কাজে লাগিয়ে এবং বিদেশে রপ্তানি করে প্রচুর সম্পদ ও বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে পারব; কিন্তু সমস্যা হলো বাজেটের যৎসামান্যই শিক্ষা ও মানবসম্পদ উন্নয়ন খাতে বরাদ্দ দেয়া হয় যা ২ শতাংশেরও কম। বরাদ্দের এখানে পরিবর্তন প্রয়োজন; কিন্তু কেবল বাজেটে বরাদ্দ বাড়ালেই এসব খাতে বড় ধরনের পরিবর্তন আসবে না। শিক্ষা খাতের বর্তমান সমস্যা হলো এখানে শিক্ষার নামে অশিক্ষা চলছে। প্রত্যেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে রাজনৈতিক বা অন্য সামাজিক বিবেচনায় এমন কাউকে নিয়োগ দেয়া হচ্ছে যাদের শিক্ষকতা করার যোগ্যতা নেই। সুতরাং এক্ষেত্রে যতদিন পর্যন্ত না আমরা সুশাসন নিশ্চিত করতে পারব ততদিন অর্থ বরাদ্দ বা শিক্ষক নিয়োগ বাড়িয়ে সুফল পাওয়া যাবে না। এক্ষেত্রে আমাদের সর্বপ্রথম সংস্কার করা দরকার। কীভাবে আমরা যোগ্য শিক্ষক নিয়োগ ও ভালো শিখন নিশ্চিত করতে পারি, স্কুল-কলেজগুলোকে শিক্ষা উপকরণ, গ্রন্থাগার, ল্যাবরেটরি ইত্যাদি দিক থেকে উন্নত করতে পারি, পেশাদারত্বের প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ শিক্ষক তৈরি- এসব ক্ষেত্রে মনোযোগ দিতে হবে। আর বর্তমান শিক্ষক প্রশিক্ষণের জন্য বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থাকলেও প্রকৃত প্রস্তাবে কোনো ভালো প্রশিক্ষক নেই।

এদিকেও মনোযোগ দেয়া প্রয়োজন। এছাড়া এগুলো বর্তমানে যে বিধ্বস্ত অবস্থায় রয়েছে তা কীভাবে পুনরুদ্ধার বা নতুনভাবে তৈরি করা যায়, সেসব দিকেও নজর দেয়া জরুরি। আমাদের দেশের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তায় ব্যবসায়ী বা বিনিয়োগকারীদের মাঝে এক ধরনের পিছুটান তৈরি হয়। তারা সাহসী বা উদ্যোগী হতে পারেন না; কিন্তু যদি রাজনৈতিক পরিস্থিতি স্থিতিশীল এবং দীর্ঘমেয়াদে কোনো অনিশ্চয়তা না থাকে তাহলে তারা বিনিয়োগ করেন এবং কর্মকাণ্ডের গতি বাড়ান। দেশপ্রেমী মানুষের মধ্যে কর্মের উৎসাহ বাড়ে। এজন্য রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আবশ্যক। সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোর মাঝে এক ধরনের সমঝোতা থাকা দরকার। দলগুলোর ন্যায্য দাবি কীভাবে পূরণ করা যায় সেদিকে সরকারের মনোযোগ দিতে হবে।

এমনিতেও সংস্কার ও নির্বাচন ঘিরে একটা জাতীয় বিতর্ক শুরু হয়েছে। এ বিতর্ক থেকে রক্ষা পাওয়ার একমাত্র উপায় হলো প্রয়োজনীয় সংস্কারের ব্যাপারে পদক্ষেপ নেয়া এবং একটা অনির্বাচিত সরকার যতটুকু সংস্কার করতে পারে ততটুকুই করা। বাকি সংস্কার কার্যক্রম নির্বাচিত সরকারের জন্য রেখে দেয়া। এটাই একটা সহজ পথ বলে আমি মনে করি। সর্বোপরি ব্যক্তি হিসেবে যা প্রত্যাশিত সম্মান ও স্বীকৃতি, উন্নয়নে অংশগ্রহণ- সব ক্ষেত্রে বৈষম্য মানুষের জীবন অর্থপূর্ণ করতে ব্যর্থ হয়েছে। তরুণদের স্বপ্ন হরণ করা হয়েছে। তাদের নির্ভরশীলতার দিকে ঠেলে দেয়া হয়েছে। এ প্রক্রিয়াকে বিপরীতমুখী করার মতো উপকরণ এ বাজেটে প্রত্যাশিত। সেটা শুধু কথা আর আশ্বাস নয়, হতে হবে দ্রুত বাস্তবায়নযোগ্য। এক বছরে কতটুকু করা যাবে, সেখানে সীমাবদ্ধতা থাকতেই পারে। তবে অন্তত দুই বা তিন বছরের জন্য কর্মপরিকল্পনা, লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে তার প্রথম অংশের বাস্তবায়নের জন্য এবারে বরাদ্দ রাখা যায়। বাকিটা তার যুক্তিসংগত পদাঙ্ক অনুসরণ করে এগিয়ে যাবে ধরে নেয়া যায়। ক্রমবর্ধমান যে বৈষম্য, তা সবচেয়ে জাজ্বল্যমান গ্রাম ও শহরের মধ্যে। শুধু শহর-গ্রামের বৈষম্য বললেও পুরো পার্থক্য সুস্পষ্ট হয় না। শহর-গ্রামের বৈষম্য কমানোর কিছু প্রচেষ্টা দৃশ্যমান হওয়া দরকার। সেই সঙ্গে জড়িত কৃষির প্রশ্ন, যেটা আসলে কৃষকের প্রশ্ন।

বাজেটে কৃষির জন্য, বরাদ্দ থাকে অবশ্যই, সেগুলোর বেশ খানিকটা ভৌত অবকাঠামোর জন্য থাকে সাধারণভাবে ভর্তুকি, যন্ত্রপাতির জন্য কর রেয়াত ইত্যাদি। কাজেই কৃষির যান্ত্রিকীকরণে প্রণোদনা দিয়ে উৎপাদনশীলতা বাড়াতে হবে; কিন্তু কৃষি মজুর, যারা কাজ হারাচ্ছেন তাদের কী হবে, সেটাও ভাবতে হবে। গবেষণায় দেখা গেছে, অতিক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তার সংখ্যা কমে গেছে। মোট কর্মসংস্থানে সেগুলোর অংশও তাই কমেছে। অন্যদিকে বৃহৎ উদ্যোক্তাদের কর্মসংস্থানের অংশ বেড়েছে। শ্রমবাজারে তাদের আধিপত্য বেড়েছে যা বৈষম্য বাড়ার প্রক্রিয়ায় ইন্ধন জোগাচ্ছে। বৈষম্য কমানোর যদি আন্তরিক আগ্রহ থাকে তাহলে এ বাজেটকে কাজে লাগিয়ে বাস্তব পদক্ষেপ নিতে হবে।

লেখক: গবেষক ও কলাম লেখক।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ