Views Bangladesh

Views Bangladesh Logo

হিট আইল্যান্ডে বিপর্যস্ত জনজীবন

Masum   Hossain

মাসুম হোসেন

বুধবার, ১ মে ২০২৪

দিনে অস্বস্তি, রাতেও আসে না ঘুম। মাথায় অসহ্য যন্ত্রণা। শরীরও দুর্বল। সবমিলিয়ে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে জনজীবন। ভালো নেই খেটে খাওয়া মানুষেরা। প্রতিদিনই সংগ্রাম করে পরিবারের সদস্যদের মুখে খাবার তুলে দিতে হয় তাদের। শরীরে দিকে তাকাতে গেলে চাল-ডাল শূন্য হবে ঘর। জীবিকার তাগিদে প্রকৃতির সাথে লড়াই করে কাটছে তাদের দিন।


পরিবেশবিদরা বলছেন, তীব্র গরমে আমাদের শহরগুলো তাপের দ্বীপ বা হিট আইল্যান্ডের মত দাঁড়িয়ে আছে। ফলে গ্রামের তুলনায় শহরে থাকা মানুষেরা বেশি কষ্ট ভোগ করছেন।

চিকিৎসকরা বলছেন, তীব্র তাপদাহের কারণে হাসপাতালগুলোতেও বাড়ছে রোগী। দেখা দিয়েছে বেড সংকটও। তাপমাত্রা জনিত প্রভাবে বয়সভেদে নানা রোগে আক্রাম্ত হচ্ছেন মানুষ।

বগুড়া শহরে দিনের বেলাতে তো বটেই, রাতেও কমছে না গরম। আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্যমতে, গত ২১ এপ্রিল থেকে এ জেলায় ৩৯ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ঘরে তাপমাত্রা ওঠানামা করছে।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের বগুড়া কার্যালয়ের আবহাওয়া সহকারী তারেক আজিজ জানান, ২৮ এপ্রিল পর্যন্ত তাপমাত্রা কমার কোনো সম্ভাবনা নেই।

তীব্র তাপপ্রবাহের কারণ ও হিট আইল্যান্ড

তাপদাহের কারণ মূলত বৈ‌শ্বিক উষ্ণায়ন। যা প্রাকৃ‌তিক প্রক্রিয়া হলেও কিছু মানবীয় কারণেও তা ত্বরা‌ন্বিত হয়। যখন বায়ুমণ্ডলে গ্রীন হাউজ গ্যাসের পরিমাণ বৃ‌দ্ধি পায় তখন পৃ‌থিবীর গড় তাপমাত্রাও বেড়ে যায়।

তবে বর্তমানে যে তাপদাহ এর সাথে বায়ু প্রবাহ সম্পৃক্ত। সূর্যের অবস্থান এখন কর্কটক্রা‌ন্তি রেখার কাছাকা‌ছি। এ কারণে বাংলাদেশের প্রায় সবখানেই বায়ুর উলম্ব প্রবাহ দেখা যাচ্ছে। অর্থাৎ বায়ু উপরের দিকে প্রবাহিত হচ্ছে। শীতের পর এ বছর বৃষ্টিও তেমন হয়নি বলে উত্তপ্ত বায়ু থাকলেও পর্যাপ্ত জলের উৎসের অভাবে বাতাসে জলীয় বাষ্পও প্রায় অনুপস্থিত। এ কারণে সহসা বৃষ্টির সম্ভাবনাও বেশ কম।

বর্তমানে শহরগুলোতে তাপ অসহনীয় হওয়ার কারণ হিট আইল্যান্ড। অপ‌রিক‌ল্পিত নগরায়নের কারণে ভবনগুলো সারাদিন উত্তপ্ত হয়। অথচ সন্ধ্যার পর এই তাপগুলো আবার মহাকাশে ফিরে যাওয়ার কথা। কিন্তু ভবনগুলো এত ঘনত্বে গড়ে উঠেছে যে তাপ ফিরে যাওয়ার জন্য পর্যাপ্ত ফাঁকা জায়গা পায় না। এছাড়াও পর্যাপ্ত জলাশয় না থাকার কারণে বাতাসে আদ্রতাও অনেক কম থাকে। এতে তাপ অসহনীয় হয়ে ওঠে। ফলে আশপাশের গ্রাম সন্ধ্যার পর শীতল হলেও শহরের ভবন উত্তপ্তই থাকে সারারাত। পরদিন আবারো তাপ শোষণ করা শুরু করে নগর। এভাবেই চারপাশের গ্রামগুলোর মাঝে হিট আইল্যান্ডের (তাপের দ্বীপ) মত দাঁড়িয়ে থাকে প্রতিটি শহর।

বগুড়ার সরকারি আজিজুল হক কলেজের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মো. আবু সাঈদ বলেন, রিজার্ভ ফরেস্টগুলো আমরা নির্বিচারে ধ্বংস করছি। এতে একদিকে অক্সিজেন উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে, অন্যদিকে বাড়ছে কার্বন ডাই-অক্সাইডের উৎপাদন। ব্যক্তিগতভাবে বৃক্ষরোপণ জরুরি হলেও রিজার্ভ ফরেস্ট রক্ষা আবশ্যক ও অতিপ্রয়োজনীয়।

তিনি আরও বলেন, শহরে পর্যাপ্ত ফাঁকা জায়গা না থাকায় তাপ শহরের ফাঁদে আটকে থাকছে।প্রয়োজন অনুযায়ী বৃষ্টি না হওয়া পর্যন্ত এ সমস্যার সমাধান হবে না।

মূলত এল নিনোর (প্রশান্ত মহাসাগরে উষ্ণ সমুদ্রস্রোত) কারণে আপাতত বৃষ্টি হচ্ছে না। তবে যথেষ্ট জলাধারা থাকলে স্থানীয়ভাবে বৃষ্টিপাত হতে পারে বলে জানান আবু সাঈদ।

নিম্নআয়ের মানুষদের জীবন ও জীবিকা

৫৮ বছরের জাহাঙ্গীর আলম। বগুড়ার দক্ষিণ বেজোড়া এলাকার বাসিন্দা জাহাঙ্গীর পেশায় রিকশা চালক।


তিনি জানান, শুক্রবার (২৬ এপ্রিল) সকাল নয়টার দিকে রিকশা নিয়ে বের হন। এদিন দুপুর পর্যন্ত ২০০ টাকা আয় করেছেন। অসুস্থতা অনুভব করায় এখন তিনি বিশ্রাম নিচ্ছেন। একদিকে সূর্যের তাপ, অন্যদিকে সড়কে পিচের গরম। এমন পরিস্থিতিতে রিকশা চালাতে ইচ্ছে করে না তার। কিন্তু রিকশা না চালিয়ে অন্যকোনো উপায়ও নেই। ঘরে চাল-ডাল কিনতে হলে রিকশা চালাতেই হবে। তাই বাধ্য হয়েই সড়কে নেমেছেন। তবে সুযোগ পেলেই নেন বিশ্রাম। এতে তার আয়ও কমছে।

তবে শুধু জাহাঙ্গীরই নন, তীব্র তাপদাহে এমন জীবন-যাপন করছেন অধিকাংশ রিকশা-ভ্যান চালকই।

শহরের বনানী এলাকার চা-দোকানি সাইদুল ইসলাম। এই গরমে তার দোকানে লোকজনের উপস্থিতি খুবই কম। এতে তার উপার্জনও কমেছে। শুধুমাত্র অতিরিক্ত গরমের কারণে মাঝে মধ্যে দোকান বন্ধ করে রাখতে হয় তাকে। অর্থ সংকটে কষ্টে কাটছে তার দিন। তবে এভাবে বেশিদিন চললে দুবেলা খাবার জুটানো তার জন্য কঠিন হয়ে পড়বে।

এছাড়াও কৃষিশ্রমিকসহ নানা পেশায় থাকা নিম্ন আয়ের মানুষেরা কষ্ট সহ্য করেই এমন পরিস্থিতিতে কাজ করছেন। কারণ কাজ করাটা বাদ দিলে না খেয়েই কাটবে তাদের ওই দিন। রয়েছে এমনও অনেক পরিবার।

এই তীব্র তাপদাহে খেটে খাওয়া মানুষসহ শিশুরা বেশি দুর্বল হয়ে পড়ছেন। নানা রোগে আক্রান্তও হচ্ছেন তারা।

বগুড়া শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ (শজিমেক) হাসপাতালের উপপরিচালক মো. আব্দুল ওয়াদুদ বলেন, তাপদাহজনিত নানা রোগে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। সবাইকে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।

জানতে চাইলে বগুড়া সিভিল সার্জন কার্যালয়ের মেডিকেল অফিসার ডা. সাজ্জাদ-উল-হক বলেন, প্রচণ্ড গরমে বাচ্চারা সর্দি-কাশি, জ্বর ও ডায়রিয়াতে আক্রান্ত হয়। তরুণ ও যুবকদের মাথাব্যথা, বমি বমি ভাব হয়। আর বেশি বয়স্কদের স্ট্রোক, হিট স্ট্রোকসহ হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি থাকে।

তীব্র গরমে নিজেকে সুস্থ রাখার পরামর্শ চাইলে তিনি বলেন, সরাসরি সূর্যের তাপ থেকে নিজেকে রক্ষা করতে হবে। যা টুপি বা ছাতা ব্যবহারের মাধ্যমে করা যায়। ঘর থেকে বের হলে কাছে পানির বোতল রাখতে হবে। প্রচুর পরিমাণে পানি পান করতে হবে। তবে প্রাকৃতিক পানি ছাড়া অন্য কোনো কোমল পানীয় বা জুস পান করা যাবে না। একই সঙ্গে ভাজাপোড়া খাওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ