অর্থনৈতিক বৈষম্য কি মানুষকে অসৎ হতে প্ররোচনা দেয়?
রাজধানীর হাতিরঝিলের মধুবাগ এলাকায় ওষুধ কিনতে না পেরে জয়নাল আবেদীন (৪৫) নামে এক ব্যক্তির আত্মহত্যার খবর যেদিন (২৬ মার্চ) গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়, তার সপ্তাহখানেক আগেই বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ‘খাদ্যনিরাপত্তা পরিসংখ্যান ২০২৩’-এর চূড়ান্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশের এক-চতুর্থাংশ পরিবার খাদ্য, বাসস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষার মতো মৌলিক চাহিদা মেটাতে ঋণ করে।
এর মাস তিনেক আগে গত ডিসেম্বরের খবর, দেশের মোট আয়ের ৪০ শতাংশই যায় শীর্ষ ১০ শতাংশ ধনীর পকেটে। একটি সরকারি সমীক্ষার প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়, ব্যাংকিং খাতে অনিয়ম, কর ফাঁকি ও অর্থ পাচার উদ্বেগজনক হারে বেড়ে যাওয়ায় সমাজে আয় বৈষম্য বেড়েছে।
বস্তুত বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রধান সমস্যা বৈষম্য। বৈষম্যের প্রধান কারণ দুর্নীতি। আর এই দুর্নীতিগ্রস্ত ও বৈষম্যমূলক অর্থনীতির প্রভাব পড়ে নিত্যপণ্যের বাজারে, যার খেসারত দিতে হয় সাধারণ মানুষকে।
সাবেক পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী শামসুল আলমও স্বীকার করেন, দেশ অর্থনৈতিক বৈষম্য কমানোর পথে সবচেয়ে বড় বাধা হচ্ছে দুর্নীতি। গত ডিসেম্বরে জাতীয় প্রেস ক্লাবে এক গোলটেবিল আলোচনায় তিনি বলেন, গত ১৫ বছরে দেশে অভাবনীয় অর্থনৈতিক উন্নতি হওয়া সত্ত্বেও দেশে অর্থনৈতিক বৈষম্য বেড়েছে। এ বৈষম্য কমানোর পথে দুর্নীতি সবচেয়ে বড় বাধা। এ সময় তিনি দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকারের জিরো টলারেন্স নীতির কথাও উল্লেখ করেন। (সময় টিভি, ৩০ ডিসেম্বর ২০২৩)।
সাম্প্রতিক বছরগুলোয় বাংলাদেশের অবকাঠামো খাতে যে ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে, সেটি দৃশ্যমান। বিশ্ব ব্যাংকের চোখরাঙানি উপেক্ষা করে নিজস্ব অর্থায়নে নির্মিত পদ্মা সেতু নিশ্চয়ই একটি ‘সাহসের স্মারক’। ঢাকার যানজট কমাতে মেট্রোরেল, ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়ে, এলিভেটেডে এক্সপ্রেসওয়ে, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের মতো প্রকল্প একসময় বাংলাদেশের মানুষের কাছে কল্পনার অতীত ছিল; কিন্তু প্রশ্ন হলো, এইসব দৃশ্যমান অবকাঠামোর আড়ালে পড়ে যাচ্ছে কত শত মানুষের চোখের জল! কত জয়নাল ওষুধ না কিনতে পেরে স্বেচ্ছামৃত্যুর পথ বেছে নিচ্ছেন; কত শত মানুষ নিত্যপণ্যের বাজারে গিয়ে বিব্রত হচ্ছেন; কত শত মানুষ রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোয় সেবা নিতে গিয়ে হয়রানির শিকার হচ্ছেন; ঘুষ ছাড়া কোনো কাজ আদায় করতে পারছেন না; সড়কের অভাবনীয় উন্নয়ন, নগরায়ন আর শিল্পায়নের নামে কত নদী, খাল, জলাশয়, পুকুরের অস্তিত্ব বিলীন করা হচ্ছে এবং একেকটি জলরেখা মুছে দিয়ে কত হাজার কোটি টাকা জাতীয় আয়ে যোগ করা হচ্ছে আর কোনো জনপদ থেকে একটি প্রাকৃতিক জলাধার বা জলরেখা মুছে দেয়ার ফলে পরিবেশ ও প্রাণ-প্রকৃতির যে ক্ষতি হলো- তার অর্থনৈতিক মূল্য কত, রাষ্ট্রের কাছে কি সেই হিসাব আছে?
১৯৭৪ সালে দেশের জনসংখ্যা যখন সাড়ে সাত কোটি, তখনো দেশে দুর্ভিক্ষ হয়েছে; কিন্তু এখন ১৭ কোটি লোকের দেশে কোনো দুর্ভিক্ষ বা দুর্ভিক্ষের পরিস্থিতি নেই; নিত্যপণ্যের দাম নিয়ে সাধারণ মানুষের মনে অসন্তুষ্টি থাকলেও অন্তত কোথাও খাদ্য সংকটে নেই বা কেউ না খেয়ে থাকছে না- এগুলো নিশ্চয়ই গত অর্ধ শতাব্দীতে রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের বিরাট অর্জন; কিন্তু মুদ্রার অন্যপিঠের খবর আমরা কতজন রাখি?
ওষুধ কিনতে না পেরে যে জয়নাল মরে গেলেন, এক অর্থে এটি বিনা চিকিৎসায়ই মৃত্যু। যে দেশ নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতুর মতো বিরাট অবকাঠামো নির্মাণ করে বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দেয়, সেই দেশে একজন মানুষও যদি বিনা চিকিৎসায় কিংবা ওষুধ কিনতে না পেরে দুঃখে কষ্টে নিজের পেটে ছুরি চালিয়ে দেন, সেই লজ্জা কার?
উন্নয়ন হচ্ছে- এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই; কিন্তু সেই উন্নয়নের সুফল কত শতাংশ লোক পাচ্ছে? দেশে কোটিপতি তো বটেই, শত ও হাজার কোটি টাকার মালিকের সংখ্যাও যে বাড়ছে, সেই খবরও আমরা জানি; কিন্তু শত ও হাজার কোটি টাকার মালিক হয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়াটি কী? কার টাকায় কে কোটিপতি হচ্ছেন? প্রতিটি উন্নয়ন প্রকল্প থেকে যে বিপুলসংখ্যক টাকা লুট করে একটি শ্রেণি ফুলেফেঁপে উঠেছেন, সেই নির্মম সত্যটি অস্বীকার করার কোনো সুযোগ আছে?
দুঃখজনক হলেও সত্যি, বাংলাদেশে এখন প্রকল্প মানেই শত বা হাজার কোটি টাকা এবং প্রকল্প মানেই কিছু লোকের ধনী থেকে আরও ধনী হওয়া। যারা এভাবে জনগণের করের পয়সা এবং বিদেশি ঋণে পরিচালিত বিভিন্ন প্রকল্পের টাকায় ধনী থেকে আরও ধনী হয়েছেন বা হচ্ছেন, তাদের সব টাকা কি দেশেই থাকছে? না। বিরাট অংশই নানা উপায়ে চলে যাচ্ছে দেশের বাইরে। কারণ এই ধনীদের বিরাট অংশই বসবাসের জন্য বাংলাদেশকে নিরাপদ মনে করেন না। এমনকি সন্তানের পড়ালেখা ও চিকিৎসাও তাদের বিদেশে। বাংলাদেশকে তারা একটি টাকা কামানোর মেশিন ছাড়া আর কিছুই ভাবেন না।
আগামী বিশ বা পঞ্চাশ বছর পরে বাংলাদেশের কী অবস্থা হবে; বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থায় কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে- সেই ভাবনা তাদের নেই। রাষ্ট্রও তাদের জবাবদিহির মধ্যে আনতে ব্যর্থ। কেননা পুরো অর্থনৈতিক ব্যবস্থাটিই এমন একটি দুষ্টুচক্রে পড়ে গেছে যে, এখন চোখের পলকে কিছু লোক ফকির থেকে আমির হয়ে যাচ্ছেন, অথচ বিপরীতে বিরাটসংখ্যক মানুষকে তার মৌলিক চাহিদা মেটাতেও ধারদেনা করতে হচ্ছে। বিরাটসংখ্যক ধনী পেটের পীড়া হলেও সিঙ্গাপুরে চলে যাচ্ছেন, তার বিপরীতে জয়নালরা ওষুধ কিনতে না পেরে আত্মহননের পথ বেছে নিচ্ছেন।
সাম্প্রতিক বছরগুলোয় বাংলাদেশের সরকারগুলো যে ধরনের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে, সেটি স্পষ্টত বাহাত্তরের মূল সংবিধানের চেতনার পরিপন্থি। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরের বছর গণপরিষদ যে সংবিধান গ্রহণ করে, সেখানে মূলনীতি সমাজতন্ত্রের যে ব্যাখ্যা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দিয়েছিলেন, সেটি হচ্ছে ‘গণতান্ত্রিক উপায়ে সমাজতন্ত্রে উত্তরণ।’ তার ভাষায়: ‘সমাজতন্ত্র না হলে সাড়ে সাত কোটি মানুষ ৫৪ হাজার বর্গমাইলের মধ্যে বাঁচতে পারবে না। সেজন্য অর্থনীতি হবে সমাজতান্ত্রিক।…আমাদের সমাজতন্ত্রের মানে শোষণহীন সমাজ। সমাজতন্ত্র আমরা দুনিয়া থেকে হাওলাত করে আনতে চাই না। এক এক দেশ, এক এক পন্থায় সমাজতন্ত্রের দিকে এগিয়ে চলেছে। (বাংলাদেশের গণপরিষদ বিতর্ক, সিবিসি ফাউন্ডেশন/২০১৪, পৃ. ৯৬২)।
বলাই হয়, বঙ্গবন্ধু যেসব কারণে সপরিবারে নিহত হয়েছেন, তার অন্যতম প্রধান কারণ তার অর্থনৈতিক চিন্তা। তিনি যে ধরনের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন, সেখানে মুনাফাখোরী, লুটপাট ও রাষ্ট্রীয় সম্পদ তছরুপের বন্ধ হয়ে একটি জনবান্ধব অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে উঠতো; রাষ্ট্রের সব সম্পদের ওপর সত্যিই জনগণের মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হতো; কিন্তু দুর্বৃত্তরা বঙ্গবন্ধুকে সেই সুযোগ দেয়নি। উপরন্তু তার মৃত্যুর পরে সব সরকারই এমন একটি পুঁজিবাদী ও দুর্বৃত্তায়িত অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার দিকে এগিয়ে গেছে, যা বরাবরই সমাজে ধনীক শ্রেণির স্বার্থ রক্ষা করেছে; ধনীকে আরও ধনী বানানো এবং নানাবিধ উপায়ে নব্য ধনী সৃষ্টির পথ প্রশস্ত করেছে, যার চূড়ান্ত পরিণতি অর্থনৈতিক বৈষম্য।
সুতরাং এখান থেকে বের হওয়া খুব কঠিন। কেননা অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করতে হলে দুর্নীতি কমানো তথা যে কোনো উপায়ে বিপুল বিত্ত-বৈভবের মালিক হওয়ার পথ বন্ধ করতে হবে। এটি করতে গেলে ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মী এবং সরকারের বিভিন্ন স্তরের লোকেরাই বাদ সাধবেন।
তাদের বিরাট অংশই বেতনে সন্তুষ্ট নন। নন বলেই বিভিন্ন প্রকল্পের অর্থ চুরি ও লুটপাট করে বিশাল সাম্রাজ্য গড়ে তোলেন। অতএব, সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছা ছাড়া দুর্নীতি বন্ধ করা সম্ভব নয়। আর দুর্নীতি বন্ধ না হলে অর্থনৈতিক বৈষম্য কোনোভাবেই কমবে না। কেননা একই মাছের বাজারে গিয়ে যখন একজন সাধারণ মানুষ মাছের দরদাম করেন, তার পাশে এসে দাঁড়ান অবৈধ পথে কোটি কোটি টাকা কামানো আরেকজন ক্রেতা। ফলে সৎ পথে জীবিকা অর্জনকারী একজন সাধারণ মানুষকে তার পছন্দের মাছটি না কিনেই বাড়ি ফিরতে হয়।
এই বৈষম্য শুধু অর্থনৈতিক নয়, মনস্তাত্ত্বিকও। কেননা একজন সাধারণ মানুষ যখন দেখেন যে, তিনি সৎ পথে থেকেও নিজের পছন্দের জিনিসটি কিনতে পারছেন না; সন্তানকে একটি ভালো স্কুলে পড়ানোর সুযোগ পাচ্ছেন না; পরিবারের কেউ অসুস্থ হলে সরকারি হাসপাতালের নানাবিধ হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে, তখন তার ভেতরে যে ক্ষোভ ও বঞ্চনার সৃষ্টি হয়, সেই বঞ্চনা অনেক সময় সৎ মানুষকেও অসৎ হওয়ার জন্য প্ররোচিত করে। দুর্নীতিগ্রস্ত অর্থনৈতিক ব্যবস্থা এবং বাজার অর্থনীতির বৈষম্যের ফলে নাগরিকের মনোজগতে যে কী প্রভাব পড়ছে- তা নিয়ে বোধ হয় খুব বেশি গবেষণা হয়নি।
লেখক: কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স এডিটর, নেক্সাস টেলিভিশন।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে