ডোনাল্ড লুর কণ্ঠে উল্টো হাওয়া
বাংলাদেশের বিদ্যমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে ব্যাখ্যা করতে হলে দুটি তারিখ মাথায় রাখতে হবে। একটি হলো গত বছরের ২৮ অক্টোবর, আরেকটি চলতি বছরের ৭ জানুয়ারি। মূল তারিখটি আসলে ৭ জানুয়ারি। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগের আর পরের বাংলাদেশ এক নয়। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে বিএনপির নেতৃত্বে বিরোধী দলগুলো সরকার পতনের একদফা আন্দোলন শুরু করেছিল। তাদের আন্দোলনের চূড়ান্ত যাত্রার দিনক্ষণ ছিল গত বছরের ২৮ অক্টোবর। সেদিন মহাসমাবেশ থেকে আন্দোলনের নবযাত্রা হবে এমনটাই ভাবা হচ্ছিল; কিন্তু বিএনপির বিক্ষুব্ধ নেতাকর্মীরা প্রধান বিচারপতির বাসভবনে হামলা, পিটিয়ে পুলিশ হত্যা, হাসপাতালে হামলা, ভাংচুর, অগ্নিসংযোগ করে পরিস্থিতি পাল্টে দেয়। ভণ্ডুল হয়ে যায় মহাসমাবেশ। সুযোগটা পুরোপুরি কাজে লাগায় সরকার।
২৮ অক্টোবরের সন্ত্রাসের ঘটনায় বিএনপির ওপর স্টিম রোলার চালিয়ে দেয় সরকার। মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ বিএনপির অধিকাংশ সক্রিয় নেতা হয় কারাগারে নয় আন্ডার গ্রাউন্ডে চলে যান। কর্মীরাও মামলার ভয়ে পালিয়ে যায়। তারপর আর গতি পায়নি সরকার পতনের একদফা আন্দোলন। আন্দোলন করার বদলে বিএনপি নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতেই ব্যস্ত হয়ে পরে। এই সুযোগে ফাঁকা মাঠে নির্বিঘ্নে নির্বাচন করে টানা চতুর্থ মেয়াদে ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ।
বিএনপির এই আন্দোলনের উত্থান-পতনের পেছনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটা বিশাল ভূমিকা আছে। মূলত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রই বিএনপির আন্দোলনে হাওয়া দিয়েছে। নির্বাচনের আগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নানা পর্যায়ের কর্মকর্তারা ঘন ঘন বাংলাদেশ সফর করেন। একটা সময় বাংলাদেশের সবচেয়ে ব্যস্ত মানুষ ছিলেন বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে পিটার হাসের নগ্ন হস্তক্ষেপ কূটনীতির সকল সীমা লঙ্ঘন করে। পিটার হাসকে বিএনপি নেতারা ‘অবতার’ হিসেবে অভিহিত করেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও র্যাবের কর্মকর্তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা, ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে বাংলাদেশের ওপর প্রবল চাপ সৃষ্টি করে। আওয়ামী লীগ-বিএনপির মধ্যে শর্তহীন সংলাপের চাপ দেয়। মার্কিন তৎপরতা আর বিএনপির আন্দোলন দেখে মনে হচ্ছিল, নির্বাচন নয়, যুক্তরাষ্ট্র সরকার হটিয়ে বিএনপিকে ক্ষমতায় বসিয়ে দেবে; কিন্তু সরকার বিএনপিকে যেমন নিষ্ঠুর কায়দায় দমন করেছে, তেমনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে মোকাবিলা করে সাহসের সঙ্গে।
রাজনীতিতে পর্দার সামনে যা ঘটে, পর্দার আড়ালে ঘটে তারচেয়ে বেশি। বাংলাদেশের নির্বাচনের ব্যাপারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কড়া অবস্থানে থাকলেও ভারতের অবস্থান ছিল ভিন্ন। আঞ্চলিক স্বার্থ বিবেচনায় মূলত ভারতের চাপেই নতি স্বীকার করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। পিটার হাসের ভারত সফরের পর পাল্টে যায় দৃশ্যপট। বিএনপির আন্দোলনের মতো পিটার হাসও গায়েব হয়ে যান। বঙ্গভবনে সরকারের শপথের দিনে পিটার হাসের সহাস্য উপস্থিতি চমকে দেয় সবাইকে। অবস্থাটা হয়েছিল গাছে তুলে মই সরিয়ে নেয়ার মতো। নিজেদের জোরে নয়, বিএনপি আসলে আন্দোলন শুরু করেছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভরসায়; কিন্তু সেই যুক্তরাষ্ট্রই যখন সরে গেল, বিএনপির আর কিছু করার ছিল না।
যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু গত সপ্তাহে তিন দিনের সফরে বাংলাদেশে এসেছিলেন। বাংলাদেশের রাজনীতিতে ডোনাল্ড লু খুব আলোচিত নাম। শুধু বাংলাদেশ নয়, এ অঞ্চলের রাজনীতি নিয়ন্ত্রণে তার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। বলা হয়, বিভিন্ন দেশে অপছন্দের সরকার হটিয়ে পছন্দের লোকদের ক্ষমতায় বসানোর ব্যাপারে তার ভূমিকা সমালোচিত দেশে দেশে। বিশেষ করে পাকিস্তানে ইমরান খানের পতনের জন্য দায়ী করা হয় ডোনাল্ড লুকে। ডোনাল্ড লু নিজে অস্বীকার করলেও ইমরান খান একাধিকবার এ অভিযোগ করেছেন। ডোনাল্ড লু তার ক্ষমতার কালো হাত বিস্তৃত করতে চেয়েছিলেন বাংলাদেশেও। চেষ্টা কম করেননি।
জাতীয় নির্বাচনের আগের এক বছরে দুবার বাংলাদেশ সফর করেন ডোনাল্ড লু। নানা রকমের নিষেধাজ্ঞার হুমকি, ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেও শেখ হাসিনাকে কাবু করতে পারেননি তিনি। চিঠি লিখে শর্তহীন সংলাপের তাগিদ দিয়েছেন; কিন্তু কিছুতেই কাজ হয়নি। যুক্তরাষ্ট্রের ভরসায় থাকা বিএনপি নির্বাচনে অংশ নেয়নি। আওয়ামী লীগও বিএনপি এবং যুক্তরাষ্ট্রকে পাত্তা না দিয়ে একতরফা নির্বাচনের পথে এগিয়ে যায়। বিএনপি আশায় ছিল নির্বাচনের পর আরও কঠোর নিষেধাজ্ঞা নিয়ে মাঠে নামবে যুক্তরাষ্ট্র; কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র পল্টি মারায় বিপাকে পড়ে যায় আওয়ামী লীগ। নতুন সরকারের শপথ অনুষ্ঠানে পিটার হাসের হাস্যোজ্জ্বল উপস্থিতির কথা তো আগেই বলেছি। যুক্তরাষ্ট্র সরকারও বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে কাজ করার ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করে।
নির্বাচনের আগের এক বছরে ডোনাল্ড লুর দুবারের সফর তখন বাংলাদেশের রাজনীতিতে রীতিমতো লু হাওয়া বইয়ে দিয়েছিল; কিন্তু এবার তার সফরের সময় প্রকৃতিতে লু হাওয়া বইলেও ডোনাল্ড লুর কণ্ঠে উল্টো হাওয়া। এবার তার কণ্ঠ শীতল। আগের সফর দুটিতে তীব্র উত্তেজনা থাকলেও এবার তিনিও যেন নির্ভার। ফুচকা খেয়ে, ক্রিকেট খেলে হালকা চালে তিন দিনের সফর শেষ করেছেন তিনি। তবে এরমধ্যে সুশীল সমাজের সঙ্গে বৈঠক, পররাষ্ট্রমন্ত্রীসহ সরকারের নীতি নির্ধারকদের সঙ্গে কথা বলেছেন। এবার তার সফরের মূল সুর ছিল রিবিল্ড। বাংলাদেশের সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক পুনর্নির্মাণ। তিনি নিজেই স্বীকার করেছেন, নির্বাচনের আগে বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কে কিছু টেনশন সৃষ্টি হয়েছিল। তিনি এবার এসেছেন সেই টেনশন দূর করতে। তিনি সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘বাংলাদেশ সফরে এসে আমি দুই দেশের জনগণের মাঝে পুনরায় আস্থা স্থাপনের চেষ্টা করছি। আমরা জানি, গত বছর বাংলাদেশের সঙ্গে আমাদের অনেক টেনশন ছিল। আমরা অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন (বাংলাদেশে) অনুষ্ঠানে যথেষ্ট চেষ্টা করেছিলাম। এতে কিছু টেনশন তৈরি হয়েছিল। আমাদের সম্পর্কের ক্ষেত্রে এটা স্বাভাবিক। তবে আমরা সামনে তাকাতে চাই, পেছনে নয়। আমরা সম্পর্ক জোরদারের উপায় খুঁজে বের করতে চাই।’
বিএনপি যাই মনে করুক, যুক্তরাষ্ট্র নিজেদের স্বার্থটাই বুঝে নিতে চাইবে। শুধু যুক্তরাষ্ট্র কেন, সবার কাছেই নিজেদের স্বার্থটাই আগে। তবে নিজেদের স্বার্থ আদায়ে যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বজুড়ে যা যা করে; তা সভ্যতা, ভব্যতা, মানবাধিকার, নৈতিকতার সঙ্গে যায় না। বিশ্বজুড়ে অশান্তির মূল কারণ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। নিজেদের স্বার্থে তারা যুদ্ধ লাগিয়ে রাখছে। ইসরায়েল বছরের পর বছর ফিলিস্তিনে আগ্রাসন আর গণহত্যা চালাতে পারছে যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনে। যারা আমাদের মতপ্রকাশের সবক দেয়, সেই যুক্তরাষ্ট্র তাদের দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যুদ্ধবিরোধী বিক্ষোভ দমন করে নিষ্ঠুর কায়দায়। বাংলাদেশে রাজনৈতিক কারণে কাউকে গ্রেপ্তার করা হলে যুক্তরাষ্ট্র উদ্বিগ্ন হয়; কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র যখন যুদ্ধবিরোধী বিক্ষোভের দায়ে শত শত শিক্ষক ও শিক্ষার্থীকে নির্বিচারে গ্রেপ্তার করে; তখন বিশ্ব বিবেক কোথায় থাকে? কদিন আগে মানসিক ভারসাম্যহীন এক তরুণকে নিউইয়র্ক পুলিশ মায়ের সামনে যেভাবে ঠান্ডা মাথায় খুন করেছে, সেই ভিডিও দেখার পর ডোনাল্ড লু বা বাইডেন কারোই আর মানবাধিকার নিয়ে উচ্চবাচ্য করার কথা নয়। ক্রসফায়ারের অভিযোগে র্যাবের কয়েকজন কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। নিউইয়র্ক পুলিশ যা করেছে, সেটা তো ক্রসফায়ারও নয়, একদম ঠান্ডা মাথার খুন। মা উপস্থিত থেকেও খুনি নিউইয়র্ক পুলিশকে নিবৃত করতে পারেনি। এখন নিউইয়র্ক পুলিশের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেয়া হবে? আমরা গণতন্ত্র চাই, ভোটাধিকার চাই, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা চাই, মানবাধিকার চাই; কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের কাছে লেকচার শুনতে চাই না।
আগেই বলেছি, ডোনাল্ড লুর এবারের সফরের সুর ভিন্ন। বাংলাদেশের দুই রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়াও যথারীতি ভিন্ন। আওয়ামী লীগ খুব নির্ভার। দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রীর আসা নিয়ে আমার কিছু বলার নেই। একটা দেশের সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী এসেছেন, এটা নিয়ে এত মাতামাতি কিসের।’ তবে বিএনপির কষ্টটা বুঝতে অসুবিধা হয় না। যে যুক্তরাষ্ট্রের ভরসায় তারা আন্দোলনের গলা পানিতে নামলো, সেই যুক্তরাষ্ট্র এখন তাদের অথৈ সাগরে ভাসিয়ে আওয়ামী লীগের নৌকায় উঠে গেল। ডোনাল্ড লুর সফর নিয়ে বিএনপি মহসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের প্রতিক্রিয়াটা আমার কাছে নিজেদের সান্ত্বনা দেয়ার মতো শুনিয়েছে। তিনি বলেছেন, ‘আমি জানি না আপনারা কী অবস্থানে তাদের ভেবেছিলেন। আমরা যেটা দেখেছি, সেটা হচ্ছে তারা একটা অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের পক্ষে কথা বলেছেন। এটা তারা এখনো অব্যাহত রেখেছেন। তাদের যে হিউম্যান রাইটস রিপোর্ট বেরিয়েছে, সেই রিপোর্টে তো বাংলাদেশে আপনারা যা বলেন না, তার অনেক বেশি তারা বলেছেন। এটাতে প্রমাণিত হয় যে তারা এতটুকু খুশি নন বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে।
আপনারা জানেন, যে কোনো দেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক অব্যাহত রাখতে হয় সবাইকে। সে জন্য তারা সেটাকে অব্যাহত রাখেন। এমনকি সামরিক শাসকদের সঙ্গেও তাদের সম্পর্ক রাখতে হয়। আজকে বাংলাদেশের যে অবস্থাটা, সে অবস্থার প্রেক্ষাপটে তারা তাদের দেশের প্রয়োজনে যেটা উপকারী মনে করছেন, সেটা করছেন। তারা কিন্তু বাংলাদেশের জনগণের বিরুদ্ধে গিয়ে কিছু করছেন না।’ মির্জা ফখরুলের মন্তব্যের বিষয়ে ওবায়দুল কাদের সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘আপনারা যে প্রশ্ন করেছেন, তা আমাকে না করে মির্জা ফখরুলকে করুন। তিনি কীভাবে জানলেন, যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান এখনো আগের জায়গায়? সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লুর বক্তব্য কি ফখরুল সাহেব শোনেননি? ফখরুলের প্রশ্নের জবাব ডোনাল্ড লু তার বক্তব্যে পরিষ্কার করেছেন। এটা আর বলার দরকার নেই। মন্তব্য করারও প্রয়োজন নেই। ডোনাল্ড লু যে কথা বলেছেন, এরপরে ফখরুল সাহেবের যে বক্তব্য, তার কোনো মূল্য নেই।’
ডোনাল্ড লু চলে গেছেন; কিন্তু তাকে নিয়ে রাজনীতির পাল্টাপাল্টি কথা চলছে এখনো। আমি খালি সবাইকে একটা বিষয় স্মরণ করিয়ে দিতে চাই- মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যার বন্ধু, তার আর শত্রু দরকার নেই।
প্রভাষ আমিন: কলামিস্ট ও হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে