দ্বৈত মানদণ্ডভিত্তিক জাতিগত শুদ্ধিকরণই নীতি
মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নীতি ছিল ইসরায়েলের প্রতি নিরঙ্কুশ সমর্থন। জায়নবাদী কৌশলের সঙ্গে তার প্রশাসনের নীতি হুবহু মিলে গেছে। ইয়েমেন, ইরান থেকে ফিলিস্তিন পর্যন্ত সংঘাতের মধ্যে প্রতিরোধী নেতাদের টার্গেট করে হত্যার ক্ষেত্রেও ইসরায়েলের সামরিক ও ভূরাজনৈতিক লক্ষ্যের সঙ্গে ট্রাম্প প্রশাসনের মিল ছিল।
ইউক্রেনের জাতীয়তাবাদী আন্দোলন এবং অধিকৃত ফিলিস্তিনে জায়নবাদী সম্প্রসারণের মাঝে সমান্তরালতা টানলেও যুক্তরাষ্ট্রের বৈদেশিক নীতির দ্বিচারিতা স্পষ্ট হয়। পশ্চিমা দেশগুলো ইউক্রেনের দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের অধিকারকে সমর্থন করলেও একই সময়ে ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে ইসরায়েলের কর্মকাণ্ডকে সমর্থন করে চলেছে। ইরানের ওপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা থেকে প্রত্যক্ষ সামরিক হস্তক্ষেপ- ট্রাম্পের মধ্যপ্রাচ্য কৌশল ইসরায়েলের আঞ্চলিক আধিপত্যকে আরও শক্তিশালী করেছে, যা ‘গ্রেটার ইসরায়েল’ পরিস্থিতির পথ প্রশস্ত করতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রের কূটনীতির বিশ্বাসযোগ্যতা এখন প্রশ্নের মুখে। যুক্তরাষ্ট্র-ইসরায়েল যৌথ সামরিক মহড়া এবং ইরানের সঙ্গে উত্তেজনা বাড়ার শঙ্কার মাঝেই ট্রাম্পের উত্তরাধিকার মধ্যপ্রাচ্যের ভবিষ্যৎ সংঘাত, বিশেষ করে গাজা ও এর বাইরের অঞ্চলগুলোতে বড় ফ্যাক্টর হয়ে উঠতে পারে।
গাজায় যুদ্ধবিরতি শুধুমাত্র ইসরায়েলের আগ্রাসনকে সাময়িকভাবে থামিয়েছিল। নেতানিয়াহুর সরকার অধিকৃত পশ্চিম তীরে নির্মম অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে, যা গাজার ধ্বংসযজ্ঞেরই প্রতিচ্ছবি। ট্রাম্পের যুদ্ধবিরতি চুক্তি সম্পাদনের ভূমিকা ছিল স্বার্থসিদ্ধির জন্যই, যা তার ভাবমূর্তির উজ্জ্বলতা বাড়াতে করা হয়েছিল, প্রকৃত শান্তি আনতে নয়। একই সময়ে, তার প্রশাসন গাজাকে ‘জাতিগত শুদ্ধির’ পরিকল্পনা করেছিল, যা ট্রাম্প এবং তার মিত্র জ্যারেড কুশনার ও স্টিভ উইটকফের মন্তব্য থেকে স্পষ্ট। তাদের দৃষ্টিভঙ্গি ফিলিস্তিনিদের লাভজনক রিয়েল এস্টেট প্রকল্পের প্রতিবন্ধক হিসেবে দেখে, যেখানে ‘পরিষ্কার করার’ নামে জোরপূর্বক বিতাড়নের পক্ষে কথা বলা হয়।
তথাকথিত আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়, যারা দশক ধরে ফিলিস্তিনিদের দুর্ভোগ উপেক্ষা করে এসেছে, তারাও ফিলিস্তিনি পরিচয় ও সার্বভৌমত্ব মুছে ফেলার মতো ভয়াবহ ঘটনা রোধে বিশ্বাসযোগ্য নয়।
ট্রাম্প ও তার মিত্রদের প্রকাশ্যে সমর্থন করা ফিলিস্তিনিদের জোরপূর্বক বিতাড়ন জেনেভা কনভেনশনের অধীনে যুদ্ধাপরাধ এবং রোম সংবিধির অধীনে মানবতাবিরোধী অপরাধ। নৈতিক চরিত্রের অভাব ছাড়াও ট্রাম্পের কার্যক্রম বৃহত্তর অস্থিতিশীলতা প্রচেষ্টারও ইঙ্গিত দেয়- ন্যাটোকে দুর্বল, ইউক্রেনকে পরিত্যাগ এবং আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালতকে টার্গেট করা। দ্বিতীয় প্রেসিডেন্সির মাত্র এক মাসের মধ্যেই তিনি ফিলিস্তিনি জনগণের অস্তিত্বকে হুমকির মুখে ফেলা নীতির সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রকে জড়িয়ে ফেলেছেন।
বিশ্বও একটি বর্ণালীতে বিভক্ত- এক প্রান্তে যারা এই অপরাধগুলোর নাম ভাঙ্গিয়ে ডাকছে, অন্য প্রান্তে যারা নীরবতা বা সমর্থনের মাধ্যমে সহযোগিতা করছে।
গাজায় ইসরায়েলের সামরিক অভিযান, যুক্তরাষ্ট্রের পরপর প্রশাসনগুলোর সমর্থনপুষ্ট, হয় গণহত্যা অথবা জাতিগত শুদ্ধিকরণের লক্ষ্যে পরিচালিত হয়েছে। বাইডেন বোমা সরবরাহের মাধ্যমে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞকে সম্ভব করেছেন, আর ট্রাম্প প্রকাশ্যে গাজার জনশূন্যকরণের পক্ষে কথা বলেছেন। তথাকথিত যুদ্ধবিরতি সত্ত্বেও ইসরায়েল বারবার এর শর্ত ভঙ্গ করেছে এবং গাজায় বোমাবর্ষণ ও মানবিক সহায়তা বন্ধ করে রেখেছে। ট্রাম্পের বক্তব্য অতীতের যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসনগুলোর গোপন এজেন্ডাকে প্রকাশ্যে এনেছে: মিশরকে চাপ দিয়ে ফিলিস্তিনি উদ্বাস্তুদের গ্রহণে বাধ্য করা, যা ভূরাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক লাভের জন্য গাজার জনসংখ্যা মুছে ফেলার সমতুল্য।
মিডিয়া ও পশ্চিমা নেতারা, এই কার্যক্রমের সহযোগী হিসেবে, জাতিগত শুদ্ধিকরণের বাস্তবতাকে লুকোতে সুবিধাবাদী শব্দ ব্যবহার করছে। অন্যদিকে মিশর সীমান্ত খুলে দিতে বাইরের চাপ প্রতিহত করছে।
২০০৭ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসন- ডেমোক্র্যাট হোক বা রিপাবলিকান- গাজাকে অবরুদ্ধ করে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করার ইসরায়েলি নীতিকে নিরবচ্ছিন্নভাবে সমর্থন করে এসেছে। এটি জায়নবাদের সেই দীর্ঘদিনের লক্ষ্যেরই ধারাবাহিকতা, যেখানে ফিলিস্তিনি ভূমিকে জনশূন্য করে তোলাই মুখ্য উদ্দেশ্য। এই কৌশল- প্রত্যক্ষ জাতিগত শুদ্ধিকরণ হোক বা ধীরে ধীরে ধ্বংস- পশ্চিমা নেতাদের নীরব সমর্থন পেয়েছে, যারা নিরাপত্তার অজুহাতে তা ন্যায্যতা দেয়ার চেষ্টা করে। একই সঙ্গে ইসরায়েলকে সামরিক ও কূটনৈতিক সমর্থন দিয়ে যায়।
বর্তমান সংঘাত কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, বরং এটি এমন নীতিরই চূড়ান্ত পরিণতি, যা গাজাকে বসবাসের অযোগ্য করে তুলতে পরিকল্পিত। এই পরিকল্পনা জায়নবাদী আদর্শের গভীরে প্রোথিত, যা তার সূচনালগ্ন থেকেই বিরাজমান। ট্রাম্পের স্পষ্টবাদী বক্তব্য কেবল অতীত প্রশাসনগুলোর গোপন এজেন্ডাকেই উন্মোচন করেছে: ফিলিস্তিনিদের জোরপূর্বক বের করে দেয়া, বিশেষত মিশরকে চাপ দিয়ে শরণার্থী নিতে বাধ্য করা আর মিডিয়া ও রাজনৈতিক বয়ান, যেন এই ব্যবস্থাপত্র জাতিগত শুদ্ধিকরণের বাস্তবতাকে ঢেকে রাখে।
গাজার মানুষের অনন্ত দুঃখভোগ ও বিশ্ব সম্প্রদায়ের নিষ্ক্রিয় প্রতিক্রিয়া ন্যায়বিচার, মানবতা ও বৈশ্বিক জবাবদিহিতার এক গভীর ব্যর্থতাকে তুলে ধরে। ফাঁকা স্লোগান ও অকার্যকর নিন্দার শব্দধ্বনি যখন কেবল প্রতিধ্বনিত হয়, ফিলিস্তিনিদের জন্য তা কোনো স্বস্তি বা সাহায্য বয়ে আনে না। অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্রের পরপর প্রশাসনগুলোর সমর্থনপুষ্ট ইসরায়েলি আগ্রাসন গাজাকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত ও এর মানুষদের অমানবিক করে তুলতে কোনো রকম দম রাখে না।
এই উদ্যোগগুলো ব্যক্তিগত ক্ষতি, সহিষ্ণুতা ও স্বপ্নের গল্পগুলোকে তুলে ধরে; কিন্তু বৈশ্বিক উদাসীনতা ফিলিস্তিনিদের কেবল পরিসংখ্যানের সংখ্যায় পরিণত করে রেখেছে। অবরোধ, বাস্তুচ্যুতি ও নিরাপত্তার নামে জাতিগত শুদ্ধিকরণ- এই ব্যবস্থাপত্র পশ্চিমা শক্তিগুলোর সম্মিলিত ভূমিকাকে উন্মোচন করে। জনশূন্যকরণের স্পষ্ট বক্তব্য থেকে শুরু করে ধ্বংসের নীরব সমর্থন, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নিষ্ক্রিয়তা এই ট্র্যাজেডিকেই স্থায়ী করে তুলেছে।
সুরক্ষা ও ন্যায়বিচারের এই ধ্বংসাবশেষ ভয়, দ্বৈত মানদণ্ড ও রাজনৈতিক স্বার্থের কঠিন প্রশ্ন উত্থাপন করে, যা ইসরায়েলের দায়মুক্তিকে সম্ভব করে তুলেছে আর ফিলিস্তিনিদের মানবতাকে মুছে ফেলার পথ প্রশস্ত করেছে।
সাইমন মোহসিন: রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিকবিষয়ক বিশ্লেষক।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে