Views Bangladesh

Views Bangladesh Logo

লিবারাল ওয়েস্টার্ন আইডোলজিকে অনুসরণ করেই ড. ইউনূসকে চলতে হবে

Dr. M M  Akash

ড. এম এম আকাশ

রবিবার, ১৩ অক্টোবর ২০২৪

ড. এম এম আকাশ, অর্থনীতিবিদ ও চিন্তক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক এই অধ্যাপক ‘ভিউজ বাংলাদেশ’-এর সঙ্গে কথা বলেছেন, দেশের চলমান রাজনীতি ও সাংস্কৃতিক পরিস্থিতি নিয়ে। তার সাক্ষাৎকার নিয়েছেন, অর্থনীতিবিষয়ক লেখক এম এ খালেক‘ভিউজ বাংলাদেশ’-এর সহযোগী সম্পাদক গিরীশ গৈরিক


ভিউজ বাংলাদেশ: ইসলামপন্থিরা চেয়েছিল অধ্যাপক সামিনা লুৎফা এবং অধ্যাপক কামরুল হাসান মামুনের পদত্যাগ; কিন্তু সরকার পুরো কমিটিটি বিলুপ্ত করে দিল। এর কারণ কী?
এম এম আকাশ: সরকার সম্ভবত দেখেছে যে, এই কমিটিতে একটু ভারসাম্যহীন, যেটা রাজনৈতিকভাবে তাদের জন্য সামলানো কঠিন। মানে রাজনৈতিকভাবে গ্রহণযোগ্য না। কারণ ওই কমিটি নিয়ে যদি সরকার আরও কাজ করে, তাহলে হয়তো আরও এমন প্রস্তাব আসবে; যেগুলো রাজনৈতিকভাবে সরকার এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবে না। কেন রাজনৈতিকভাবে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবে না? তার কারণ হলো, এই সরকারে যাদের রাজনৈতিক প্রভাব আছে, তারা হলো তিনটি শক্তি।

একদল হলো বিষম্যবিরোধী ছাত্রসমাজ, আরেক দল হচ্ছে বিএনপি ও আরেকটি শক্তি হচ্ছে হেফাজতে ইসলাম। তাদের আরেকটি দূরবর্তী শক্তি বামপন্থিরা। আমার ধারণা, বামপন্থি ও বৈষম্যবিরোধী শক্তিরা হয়তো এইসব সংস্কারের পক্ষেই থাকবে। কম বেশি। বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের মধ্যে যেমন আবার শিবির আছে, অন্যরা আছে, ওখানে একটা মতভেদ হবে। মতভেদ হলে আমরা ধরে নিতে পারি এক অংশ পক্ষে থাকবে, অন্য অংশ বিরুদ্ধে থাকবে।

সামিনা লুৎফা বা অন্যদের প্রতি সহানুভূতিশীল এমন ছাত্রও তো বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের মধ্যে আছে। সুতরাং বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের একাংশ তাদের রাখতে চাইবে, সংস্কারগুলো গ্রহণ করতে চাইবে, বামপন্থিরাও গ্রহণ করতে চাইবে, তারপর লোকজ ইসলামের অনুসারী যারা, যেমন যেসব মাওলানা ধর্ম নিয়ে অত বাড়াবাড়ি করে না এবং লালন-বাউল-ফকির এই ধারাকে অনুসরণ করে এবং পল্লি গ্রামের সাধারণ মানুষ যারা ধর্মকে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করতে চায় না, তারাও হয়তো এটাতে খুব একটা আপত্তি করবে না। আপত্তি করবে যারা রাজনৈতিক ইসলামের ভক্ত।

প্রথমত, জামায়াতে ইসলাম, ইসলামী ছাত্রশিবির, ইসলামী শাসনতন্ত্র এবং মামুনুল হকের মতো লোক। হিযবুত তাহরীর যদিও আধুনিক বিজ্ঞান নিয়ে চর্চা করে, এ ক্ষেত্রে তারাও হয়তো এর বিরোধে থাকবে। মুশকিল হয়ে গেছে যে, যদিও বিএনপি একটু আধুনিক, মনে মনে হয়তো এ ধরনের সংস্কারের বিরুদ্ধে তারা না; কিন্তু আগামীতে ভোটে জিততে হলে তাদের এই জোটের সঙ্গে থাকতে হবে। সে জন্য তারা হয়তো এ ক্ষেত্রে সম্মতি দিতে পারে, অথবা নীরব থাকতে পারে। সুতরাং ওভারঅল ব্যালেন্স কিন্তু চলে যাচ্ছে এর বিরুদ্ধে।

তাই আমার কাছে মনে হয়েছে যে, বর্তমান সরকার হয়তো এটা বিপজ্জনক মনে করেছে। যদিও সামিনা লুৎফা বা কামরুল হাসান মামুনকে যদি বাদ দিত, তাহলে মনে করা হতো যে শুধু ওই কারণে তাদের বাদ দেয়া হয়েছে। এখন ওরা বলবে যে, এর মধ্য দিয়ে আমরা দুপক্ষকেই বাতিল করে দিয়েছি। এটা হয়তো তাদের জন্য একটা রাজনৈতিক কৌশলগত পদক্ষেপ।

ভিউজ বাংলাদেশ: এর আগে আমরা দেখেছি সংবিধান সংস্কার কমিটি থেকে সদস্য বাদ দেয়া হয়েছে, এখন দেখছি সংবিধান সংস্কার কমিটি বাদ দেয়া হলো। এভাবে যদি সরকার কমিটি বাদ দিতে থাকে, তাহলে সরকার কী ধরনের সমস্যায় পড়বে বলে আপনি মনে করেন?

এম এম আকাশ: এভাবে যদি বাদ দেয়া চলতে থাকে, তাহলে সরকারের উদ্দেশ্য নিয়ে মানুষ সন্দেহে পড়বে। তারা যে সুবিধাবাদী এ নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। মানুষ বলবে যে, তাদের কোনো উদ্দেশ্য নেই, তাদের কোনো নীতি নেই, তাদের কোনো শক্ত অবস্থান নেই। তারা ক্ষমতায় থাকতে চায়। সেটার জন্য যখন যে পালে হাওয়া দিতে থাকতে পারে সেটাই করবে। তাতে যেটা ক্ষতি হয়ে যাবে দেশের, নীতিগতভাবে আমরা যেসব প্রত্যাশা করেছিলাম, সংস্কারের মাধ্যমে নৈতিক বিশুদ্ধতা বা নৈতিক উন্নয়ন, সেগুলো আপসের মধ্যে চলে আসবে।

ভিউজ বাংলাদেশ: অধ্যাপক আলী রিয়াজকে এখন সংবিধান সংস্কার কমিটির প্রধান করা হয়েছে; কিন্তু তর্ক উঠছে যে সংবিধান নতুন করে লিখতে হবে। অনেকে মত দিচ্ছেন যে, সংবিধান পুনর্লিখন নয়, সংস্কার করা যেতে পারে। প্রশ্ন হলো, এমন কোনো আইন আছে কি না যে, এই সরকার সংবিধান নতুন করে লিখতে পারে।

এম এম আকাশ: এই সরকারকে সই করে রাষ্ট্রপরিচালনার দায়িত্ব দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি। রাষ্ট্রপতিকে তো উৎখাত করা হয়নি। তার মানে সংবিধানের মধ্য থেকেই কিন্তু এই সরকারের প্রতিষ্ঠা। সংবিধান বহির্ভূতভাবে কিন্তু এই সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়নি। তার মানে আমরা ধরে নিতে পারি যে, সংবিধান আমাদের আগে ছিল সেটা এখনো বহাল আছে। এটাই এই সরকারের বৈধতা। যদি সেটাই সত্য হয়, তাহলে এই সংবিধানই বলে দেবে এটা কীভাবে সংশোধন করতে হবে। আইন সংশোধন করতে পারে কোনো অনির্বাচিত সরকার; কিন্তু সংবিধান সংশোধন করার মতো সাংবিধানিক অধিকার বা আইনগত অধিকার কোনো অনির্বাচিত সরকারের নেই।

এ কারণে আমি মনে করি, সরকারের উচিত সেই সংস্কারগুলো করা, যে সংস্কারগুলো এই সংবিধানের বিরুদ্ধে না। বা এই সংবিধান যেগুলো অনুমোদন করতে সক্ষম। সে হিসেবে নির্বাচনি আইনটির সংশোধন করা যেতে পারে। সেটার বিধিমালা সংশোধন করা যেতে পারে। রাজনৈতিক আইনের, রাজনৈতিক আচরণের যে বিধিলিপি সেগুলো সংশোধন করা যেতে পারে। ব্যাংকের সংস্কার করা যেতে পারে। এমন কিছু আইনও করা যেতে পারে, যেগুলো সংবিধানের লিখিত আইনের বিরুদ্ধে নয়। আর বিশেষ করে সংবিধানের প্রথম দিকের যে এক-তৃতীয়াংশ, মৌলিক নীতি, যেখানে বলা হয়েছে, এগুলো সংশোধন করতে সংসদে নাগরিকদের দুই-তৃতীয়াংশ ভোট লাগবে, সেগুলোতে হাতই দেয়া যাবে না।


সুতরাং আমি বুঝতে পারছি না আলী রিয়াজ কেন এটা বলছেন। তিনি তো সংবিধান পড়েছেন। তিনি জানেন। তাহলে তাকে বলতে হবে যে, আমি বিপ্লবের মাধ্যমে ক্ষমতায় এসেছি। আমি বিপ্লবী সংস্কার চাই। যেটা ফরহাদ মজহার বলেছিলেন। ফরহাদ মজহার বলেছেন যে, ইউনূস সাহেবের উচিত ছিল শহীদ মিনারে দাঁড়িয়ে শপথ নেয়া। ঘোষণা করা যে, আমি বিপ্লবী সরকার। সমস্ত বৈষম্যবিরোধী ছাত্ররা তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকবেন, তারপর অক্টোবর বিপ্লবের পরে যেমন লেনিন বা চীনের বিপ্লবের পরে মাও সেতুং বা কিউবা বিপ্লবের পরে ফিদেল কাস্ত্রো নতুনভাবে সবকিছু করেছে। যদিও সব কিছু বাংলাদেশেও হতে পারত, তাহলে আলী রিয়াজের বক্তব্য গ্রহণযোগ্য হতো।

আমরা দেখতে পাচ্ছি এবং আমরা জানি, ড. ইউনূস সেই ধরনের মানুষ নন। ড. ইউনূসকে যখন পছন্দ করা হয়েছে, তখন বোঝাই যাচ্ছে, লিবারাল ওয়েস্টার্ন আইডোলজিকে অনুসরণ করেই তাকে চলতে হবে। লিবারাল ওয়েস্টার্ন আইডোলজিতে কনস্টিটিউশন ইজ ভেরি ইম্পর্টেন্ট। কনস্টিটিউশনাল পলিটিক্সই এখানে সব। তাই আমি বুঝতে পারছি না সোনার পাথর বাটি তারা কোথা থেকে প্রত্যাশা করে!

ভিউজ বাংলাদেশ: ট্রান্স জেন্ডারশিপ নিয়ে সম্প্রতি বাংলাদেশে একটা বিতর্ক দেখা দিয়েছে। ইসলামপন্থিদের একটি গোষ্ঠীর আপত্তিতে বর্তমান সরকারের পাঠ্য সংস্কার কমিটি বাতিল হয়ে গেছে। এ বিষয়ে কিছু বলুন।

এম এম আকাশ: তাদের যে মামনুল হক বহিষ্কারের দাবি করলেন এবং পরবর্তীকালে সরকার সেটা মেনে নিল, এটার পরিপ্রেক্ষিতটা এবং ভেতরের ব্যাপারটা জানতে হবে। তার মানে ভেতরে কী বিতর্ক হয়েছিল? যে বিতর্কে সরকার এবং মামুনুল হক একমত হলেন যে, এদের রাখা যাবে না। সেই বিতর্কের পয়েন্টার আমাদের আগে জানতে হবে।

আমার ধারণা, বিতর্কের পয়েন্ট ছিল ট্রান্সজেন্ডারশিপ নিয়ে। ট্রান্সজেন্ডারশিপ নিয়ে পাঠ্যপুস্তকে একটা আর্টিকেল ছিল, যেটা নিয়ে আগে থেকেই তর্ক ছিল। এই নতুন সরকার আসার আগে থেকেই। তর্কটা ছিল অনেকটা এরকম, হিজড়াদের নিয়ে ইসলাম ধর্মে কোনো বিরোধ নেই; কিন্তু নারী যদি পুরুষ হতে চায় বা পুরুষ যদি নারী হতে চায়, যেটাকে আমরা বলি ট্রান্সজেন্ডারশিপ, সেটা নিয়ে বিতর্ক আছে। ওই লেখাটা হিজড়া নিয়ে না ট্রান্সজেন্ডার নিয়ে ওটা নিয়ে একটা বিতর্ক ছিল। পরে দেখা গেল যে, এটা ট্রান্সজেন্ডারশিপ হিসেবেও ব্যাখ্যা করা যায়।

ওটা ছিল শরিফ থেকে শরিফা হয়ে ওঠার ব্যাপার। তার মানে এটা আসলেই ট্রান্সজেন্ডারশিপ। মানে শরিফ একটা ছেলে, সে মেয়ে হতে চায়। তার মানে হলো যে, ট্রান্সজেন্ডারকে ইসলাম যেভাবে দেখে বলে বলা হচ্ছে, সেটা ঠিক কি না? ইসলাম আসলেই ট্রান্সজেন্ডাশিপ অনুমোদন করে না, এরকম কি না? আমি তো সে ব্যাপারে বিশেষজ্ঞ নই, কোরআন-হাদিস ঘেটে হয়তো এটা বের করা যাবে যে, এটা ইসলাম অনুমোদন করে না। আমি এটা ধরে নিচ্ছি, আবার কেউ ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করে এটা বোঝাতেও পারে যে, এটা ইসলাম অনুমোদন করে। সেই বিতর্কে না গিয়ে আমি ধরে নিচ্ছি যে, ইসলাম এটাকে অনুমোদন করে না।

যদি সেটা সত্য হয়, তাহলে আধুনিক যুগের এই বিজ্ঞান বা বিজ্ঞানমনষ্ক মানুষ সেটা মেনে নিত কি না? এটা হলো দ্বিতীয় প্রশ্ন। আমার বিচারে এটা মেনে নেবে না। কারণ যখন বিজ্ঞান এতদূর এগিয়ে গেছে, যখন একটা ভেড়ার ক্লোন থেকে আরেকটা ভেড়া বানাচ্ছে, তখন একজন পুরুষ থেকে মেয়ে হয়ে গেল, মেয়ে থেকে পুরুষ হয়ে গেল এটা সম্ভব। আধুনিক বিজ্ঞান যখন এটা পারে এবং যদি কোনো ব্যক্তি এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে চায়, অন্য কারও তো তাতে ক্ষতি হচ্ছে না। ক্ষতি হলে তারই হবে, লাভ হলে তারই হবে।


তো মানবাধিকারের প্রথম আইন হচ্ছে এটা যে, ব্যক্তির সেসব কাজ করার অধিকার থাকবে, যাতে অন্য কারও লাভ-ক্ষতির ব্যাপার নেই; কিন্তু ব্যক্তির লাভও হতে পারে, ক্ষতিও হতে পারে। যেমন একটা বিতর্ক হয়েছিল, আত্মহত্যা করার অধিকার থাকবে কি না? অনেক দেশে আছে, অনেক দেশে নেই। আত্মহত্যা করলে অন্য কারও ক্ষতি হয় কি না এটা একটি প্রশ্ন। আরেকটি প্রশ্ন হলো, যে আত্মহত্যা করে তার তো ক্ষতি হলো, ওর জীবন চলে গেল। কেউ মনে করতে পারেন ওর মৃত্যু হলে তো বাবা-মা, ভাইবোন-পরিবারের ক্ষতি হবে, এটা হতে পারে না। এ ক্ষেত্রে পার্থক্যটা হচ্ছে, আত্মহত্যার ক্ষেত্রে মৃত মানুষকে আর জীবিত করা যায় না; কিন্তু এখানে যে অধিকারটার কথা আমরা বলছি, যে পুরুষ নারী হলো, বা যে নারী পুরুষ হলো, এখানে যদি ওই ব্যক্তির কোনো ক্ষতি হয়ে থাকে, তাহলে তাকে আবার আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা যাবে। এটা এমন কোনো পদক্ষেপ নয়, যেটা অসংশোধনীয়। সে কারণে এটা ব্যক্তি অধিকারের মধ্যে থাকতে পারে। আমি ব্যক্তিগতভাবে এই অধিকার অনুমোদন করি। (চলবে)

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ