স্বপ্ন ডুবে যাচ্ছে ভূমধ্যসাগরের অতলে!
শাহরুখ খানের বয়স ৫৮। অনেক দিন প্রত্যাশা অনুযায়ী সাফল্য পাচ্ছিলেন না; কিন্তু গত বছর যেন নতুন রূপে পর্দায় ফিরে এলেন কিং খান। প্রথমে পাঠান, তারপর জাওয়ান দিয়ে রীতিমতো ঝড় তোলেন তিনি। দক্ষিণের কাছে হেরে যেতে বসা মুম্বাই ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিই যেন নতুন করে ফিরে এলো শাহরুখের হাত ধরে। গত বছর তার তিন নম্বর ছবিটি আগের দুটির মতো বক্স অফিসে হয়তো ঝড় তোলেনি। তবে ডানকি নিয়ে আলোচনা হয়েছে অনেক বেশি। রাজকুমার হিরানী আর শাহরুখ খানের প্রথম মেলবন্ধন নিয়ে আগ্রহ ছিল অনেকেরই। থ্রি ইডিয়টস, পিকে, মুন্না ভাইয়ের কারণে হিরানী কাছে দর্শকদের প্রত্যাশা আকাশচুম্বী। আমি শাহরুখের গত বছরের তিন ছবির কোনোটিই দেখিনি এখনো। তবে ডানকি দেখব। যতটা না শাহরুখ খানের কারণে, তারচেয়ে বেশি হিরানীর কারণে। তবে ডানকি দেখার আসল আগ্রহ এর বিষয়ের কারণে অবৈধ অভিবাসন নিয়ে বানানো হয়েছে ডানকি। উন্নত জীবনের আশায় ভারত থেকে অনেক মানুষ অবৈধ পথে ইউরোপ আমেরিকায় পাড়ি জমানোর চেষ্টা করেন। ভারতের পাঞ্জাবে এ ধরনের চেষ্টাকে ‘ডানকি ফ্লাইট’ বলে। সে ধরনের কাহিনি নিয়েই নির্মিত হয়েছে ‘ডানকি’।
যেহেতু ছবিটি দেখিনি, তাই কাহিনিটা জানি না। তবে এটা জানি, শুধু ভারত নয়, বাংলাদেশের ঘরে ঘরে এমন হাজারটা বেদনাবিধুর সিনেমার উপাদান আছে। শুধু বাংলাদেশই বা বলি কেন, প্রবল বৈষম্যের কারণে বিশ্ব আসলে দুভাগে বিভক্ত। গরিব দেশের মানুষ ভাগ্য বদলানোর আশায় উন্নত বিশ্বে যেতে চায়, বৈধভাবে হোক আর অবৈধভাবে। ভারতীয় উপমহাদেশ আর আফ্রিকা থেকে মানুষ ইউরোপ-আমেরিকায় পাড়ি জমাতে চায়। চাইলেই তো আর হয় না। তাই মানুষ লাখ লাখ টাকা খরচ করে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সীমানা পেরোনোর চেষ্টা করে। কেউ কেউ পারে, অনেকেই পারে না। মরুভূমিতে বা সাগরে ডুবে মরতে হয় অনেককে। প্রতি বছর হাজার হাজার মানুষ লোভের ফাঁদে পরে জীবন দেয়।
বাংলাদেশের অর্থনীতি দাঁড়িয়ে আছে ইংরেজি অক্ষর ‘আর’ এর ওপর। রাইস, রেমিট্যান্স আর রেডিমেড গার্মেন্টস- এই তিনটি আমাদের অর্থনীতির চালিকাশক্তি। বাংলাদেশে অনেককিছুর অভাব আছে; কিন্তু মানুষের অভাব নেই। এই মানুষ আমাদের বোঝা নয়, সম্পদ। মানুষ আছে বলেই আমাদের অর্থনীতি এগিয়ে যাচ্ছে। মানুষ বেশি বলে আমাদের দেশে শ্রম সস্তা। কৃষকরা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে ধান উৎপাদন করেন বলেই আমরা এত মানুষ পেট ভরে খেতে পাচ্ছে; কিন্তু মাথার ঘাম পায়ে ফেলা শ্রমের মূল্য কৃষকরা কতটা পান, সেটা কি আমরা শহুরে মানুষরা জানি? প্রতি বছর মৌসুমে পত্রিকায় নিউজ হয় এক মন ধানে একটা ইলিশ মাছ পাওয়া যায় না। যে মাছ ধরা ছাড়া আর কিছু করতে হয় না, সেই মাছের দাম ধানের চেয়ে বেশি। সস্তা শ্রমের কারণেই বাংলাদেশে তৈরি পোশাক খাতের এত রমরমা। গার্মেন্টস মালিকরা বছরে বছরে গাড়ির মডেল পাল্টান, আর শ্রমিকদের মজুরির কথা উঠলেই গলা শুকান।
বাংলাদেশের রিজার্ভ ফুলেফেঁপে ওঠে যাদের পাঠানো রেমিট্যান্সে, সেই প্রবাসী শ্রমিকরা সবচেয়ে অবহেলিত। বিমানবন্দরে যাওয়া-আসার সময় তাদের সঙ্গে যে আচরণ করা হয়, তা রীতিমতো শাস্তিযোগ্য অপরাধ। অথচ যারা বাংলাদেশের সম্পদ বিক্রি করে বিদেশে পাচার করে সেখানে সম্পদ গড়েন, তারা বিমানবন্দরে ভিআইপি মর্যাদা পান। বিদেশে বাংলাদেশের মিশনগুলোতেও প্রবাসী শ্রমিকদের সঙ্গে রীতিমতো কুকুর-বিড়ালের মতো আচরণ করা হয়।
অভিবাসন যুগ যুগ ধরে চলে আসছে। মানুষ তার সুবিধামতো জায়গায় বসবাস করতে চায়। তবে এখন যেভাবে সীমানা দিয়ে রাষ্ট্র সুরক্ষিত রাখা হয়, তাতে অবৈধ অভিবাসন অনেক কঠিন এবং ঝুঁকিপূর্ণ। মেক্সিকো সীমান্তে বিশাল দেয়াল তুলেও যুক্তরাষ্ট্র অভিবাসীদের ঠেকাতে পারে না। সত্তরের দশকের শেষ দিকে বাংলাদেশের মানুষ ব্যাপকভাবে বিদেশে যাওয়া শুরু করে। মূলত মধ্যপ্রাচ্য, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুরে বাংলাদেশের শ্রমিকরা কাজ করেন। শিক্ষিত মানুষের গন্তব্য হয় ইউরোপ-আমেরিকা। গ্রামের মানুষ জমিজমা বিক্রি করে বিদেশে যায়। যারা ঠিকঠাকমতো যেতে পারেন, তাতের ভাগ্য বদলে যায়। পরিবারের একজন সদস্য বিদেশে যেতে পারলে পুরো পরিবারের চেহরাই বদলে যায়। তবে সবার ভাগ্য অত ভালো না। পদে পদে হয়রানি আর প্রতারণার শিকার হতে হয় তাদের। দালালরা অনেকের টাকা মেরে দিয়ে হাওয়া হয়ে যান। অনেকে বিদেশে যেতে পারলেও প্রতিশ্রুত চাকরি বা অর্থ পান না। দিনের পর দিন কষ্ট করে, খেয়ে না খেয়ে সামান্য অর্থই সঞ্চয় করতে পারেন। প্রবাসীদের পাঠানো টাকা পরিবারের অন্য সদস্যদের মেরে দেয়ার ঘটনাও কম নয়। প্রবাসীদের স্ত্রীরা স্বামীর পাঠানো টাকা নিয়ে অন্যের হাত ধরে পালিয়ে যান, এমন উদাহরণও অনেক। ভাগ্য বদলাতে গিয়ে অনেকে নিঃস্ব হয়ে যান। মালয়েশিয়া বা থাইল্যান্ডের জঙ্গলে বাংলাদেশি তরুণের স্বপ্ন ফিকে হয়ে যায়, কত তরুণকে না খেয়ে মরতে হয়; আমরা খবরও রাখি না। প্রবাসী নারী শ্রমিকদের অবস্থা আরো করুণ। অন্য সব হয়রানীর পাশাপাশি তাদের যৌন হয়রানির শিকার হতে হয় আকছার। নিয়মিত বিমাবন্দরে প্রবাসী শ্রমিকদের লাশ আসে।
বৈধপথে যারা বিদেশে যান, পদে পদে তাদেরও হয়রানি আর প্রতারণার শিকার হতে হয়। আর যারা অবৈধ পথে বিদেশে যেতে চান, তারা আসলে জীবনকে হাতের মুঠোয় নিয়েই ঘর ছাড়েন। শুরুতে হিন্দি সিনেমার কথা বলেছি। আরেকটি সিনেমায় দেখেছিলাম, খুব অর্থের প্রয়োজন এমন লোকদের জড়ো করে একটা খেলার আয়োজন করা হয়। তাদের নানা ঝুকিঁপূর্ণ কাজে নামানো হয়। বেঁচে ফিরলে অনেক টাকা পাবে, এই প্রলোভনে অনেকে সেই খেলায় নামেনও। অবৈধপথে ইউরোপ-আমেরিকায় যেতে চাওয়া মানুষদের অবস্থাও তেমন। হয় মৃত্যু, নয় উন্নত জীবন-এমনটা জেনেও তারা মরুভূমিতে বা সাগর পাড়ি দিতে নেমে যান।
দুদিন আগে পত্রিকায় একটি শিরোনাম দেখেই এই লেখার প্রস্তাবনা, ‘আমার বাপজানের ইতালি যাওয়া লাগত না, তোমরা ওরে ফিরাইয়া দাও’। ইতালি যাওয়ার জন্য দালালকে ১২ লাখ টাকা দিয়ে দেশ ছেড়েছিলেন মাদারীপুরের সজল বৈরাগী। তার বাবা সুনীল বৈরাগীর আক্ষেপ এটি। এখন কত সুনীল বৈরাগী সন্তান হারানোর বেদনায় আর্ত হন, তার সঠিক পরিসংখ্যান আমরা জানি না। গত সপ্তাহে অবৈধভাবে ইতালি যাওয়ার পথে ভূমধ্যসাগরে অভিবাসনপ্রত্যাশীদের একটি নৌকাডুবিতে বাংলাদেশের তিন তরুণসহ ৬ জন মারা গেছেন। জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে ৫২ জনকে। নিখোঁজ রয়েছেন বেশ কয়েকজন। দালালরা বাংলাদেশের তরুণদের ইতালিতে পাঠানোর কথা বলে ১০-১২ লাখ টাকা নেন। প্রথমে তাদের দুবাই নেয়া হয়। পরে সেখান থেকে নেয়া হয় লিবিয়ার বেনগাজিতে। গত বৃহস্পপতিবার (১৫ ফেব্রুয়ারি) বাংলাদেশিসহ বিভিন্ন দেশের প্রায় ৭০ জন অভিবাসনপ্রত্যাশী নিয়ে একটি ইঞ্জিনচালিত নৌকা ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইতালির উদ্দেশে যাত্রা শুরু করে। অভিবাসনপ্রত্যাশীদের বহন করা নৌকাটি ভূমধ্যসাগরের তিউনিসিয়ার সীমানায় প্রবেশ করলে নৌকাটির তলা ফেটে ডুবে যায়। যে নৌকায় ৩০ জন বহন করার কথা, সে নৌকায় ৭০ জন তুললে তার তলা ফেটে যাওয়ারই কথা। এমন দুয়েকটি নৌকা হয়তো ইতালি পর্যন্ত যেতে পারে। কেউ কেউ পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে ইতালিতে ঢুকেও যান; কিন্তু বেশিরভাগের স্বপ্ন তলিয়ে যায় ভূমধ্যসাগরের অতলে।
বলছিলাম ডানকির মতো শত শত সিনেমার কাহিনি আছে বাংলাদেশের ঘরে ঘরে। আমার এক আত্মীয় এমনভাবে ইউরোপ যাওয়ার চেষ্টা করে মৃত্যুর মুখে পড়েছিলেন। প্রাণ নিয়ে ফিরেছিলেন বটে। তবে তার যাত্রা পথের যে গল্প- কাভার্ডভ্যানে লুকিয়ে যাত্রা, মরুভূমিতে খেয়ে না খেয়ে পালিয়ে থাকা, কাঠের নৌকায় সমুদ্র পাড়ি দেয়ার চেষ্টা- প্রত্যেকটা ঘটনা সিনেমার চেয়েও অবিশ্বাস্য ও থ্রিলিং।
লিবিয়া থেকে ভুমধ্যসাগর পাড়ি দেয়ে ইতালি যাওয়ার এই রুট এখন পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়ংকর মৃত্যুফাঁদ। ভূমধ্যসাগরে নৌকাডুবির খবর প্রায়শই আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের শিরোনাম হয়। আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার পরিসংখ্যানে গতবছর বিভিন্ন অভিবাসন রুটে ৩ হাজার ৮০০ জন মানুষ প্রাণ দিয়েছে। ২০১৭ সালে এই সংখ্যা ছিল ৪ হাজার ২৫৫ জন। তবে পুরো চেষ্টাটাই যেহেতু অবৈধ, তাই মৃত্যুর সঠিক পরিসংখ্যান হয়তো আমরা কখনোই জানতে পারব না।
বলছিলাম, বাংলাদেশে যেহেতু মানুষ বেশি তাই শ্রম সস্তা। আর সেই সেই সস্তা শ্রম ফেরি করে বেড়াই দেশে-বিদেশে। কিন্তু বাংলাদেশে শ্রমের চেয়েও সস্তা হলো মানুষের জীবন। এই মাদারীপুরের তিন তরুণের স্বপ্ন ভূমধ্যসাগরে তলিয়ে গেল, এর জন্য দায়ীদের কী শাস্তি হবে? আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি, হবে না। তাদের নাগালই পাওয়া যাবে না। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা অনেক ইস্যু নিয়ে কথা বলে; কিন্তু প্রতি বছর সবার চোখের সামনে হাজার হাজার তরুণের মৃত্যু তাদের ভাবায় না। অভিবাসন হবেই। এটা কেউ ঠেকাতে পারবে না। আর রেমিট্যান্সের জন্যও আমরা চাইব আরও বেশি করে মানুষ বিদেশে যাক; কিন্তু অভিবাসন প্রক্রিয়াটা যেন বৈধ ও নিরাপদ হয়। দালালদের কথা শুনে আমরা যেন অনিশ্চয়তার পথে পা না বাড়াই। জীবন একটাই। এরচেয়ে মূল্যবান কিছু নেই।
লেখক: হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে