জলবায়ু পরিবর্তন
উপকূলীয় অঞ্চলে বাড়ছে সুপেয় পানির সংকট
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সুপেয় পানি প্রাপ্তি একটি অন্যতম সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে দেশের দক্ষিণাঞ্চলে এর প্রভাবটা বেশি। এই অঞ্চলের উপকূলীয় এলাকাগুলোতে ভূগর্ভের পানির স্তর দিন দিন নিচে নেমে যাচ্ছে। এতে অসম্ভব হয়ে পড়ছে গভীর নলকূপ স্থাপন করা। ফলে বাধ্য হয়েই লবণাক্ত পানি পান করছেন উপকূলীয় জনগোষ্ঠী।
এক গবেষণায় দেখা যায়, বাংলাদেশের উপকূলীয় জনগোষ্ঠীর প্রায় ৫ কোটি মানুষ সুপেয় পানির সংকটে রয়েছেন। ভূ-পৃষ্ঠ ও ভূগর্ভস্থ পানিতে লবণের পরিমাণ বৃদ্ধি এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে এমনটা হচ্ছে।
খুলনার লবণাক্ততা প্রভাবিত উপকূলীয় অঞ্চল ওই গবেষণার জন্য বেছে নেয়া হয়। এই গবেষণার মূল উদ্দেশ্য পানির লবণাক্ততা সমস্যার টেকসই সমাধান করা। সেখানে সূর্যশক্তির সাহায্যে পানি বিশুদ্ধ করা যায় এমন একটি ফিল্টার অংশগ্রহণমূলক গবেষণা পদ্ধতিতে ব্যবহার করা হয়। প্রায় ৬৮ শতাংশ মানুষ ওই ফিল্টার ব্যবহার করে সন্তুষ্টি প্রকাশ করেন।
খুলনার দাকোপ ও বটিয়াঘাটা উপজেলায় এই গবেষণাটি করেন কানাডার পানি সম্পদ প্রকৌশলী সাবরিনা রশিদ সেওঁতি। তিনি পানি সম্পর্কিত স্টার্টআপ (কোনো একটি বড় সমস্যাকে সমাধান করার উদ্যোগ) টেট্রা (Tetra) এর প্রতিষ্ঠাতা এবং পরিচালক। টেট্রা কাজ করছে উপকূলীয় এলাকার পানির লবণাক্ততা নিয়ে।
আর সৌরশক্তির সাহায্যে পানি বিশুদ্ধ করার ওই ফিল্টারটি উদ্ভাবন করেন সাবরিনা ও তার বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) তিন বন্ধু।
সাবরিনা পানিসম্পদ প্রকৌশলী এবং কনসালটেন্ট হিসেবে কানাডায় কাজ করছেন। এ ছাড়াও তিনি বাংলাদেশ এবং কানাডায় বন্যা, নদীভাঙন, ড্রেনেজ বিষয়ক প্রজেক্ট এর হাইড্রোটেকনিকাল ডিজাইন এবং কনসালটেন্সি করছেন। ছয় বছর ধরে বিভিন্ন রিসার্চ (গবেষণা) সেক্টরেও কাজ করছেন সাবরিনা।
লবণাক্ত পানি পান করার কারণে উপকূলীয় জনগোষ্ঠী স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়ছেন। তাদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য গবেষণা পরিচালনা করেন সাবরিনা।
রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসক (সিনিয়র ক্লিনিক্যাল প্যাথলজিষ্ট) নাহিদা সুলতানা জানান, একজন প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষের পক্ষে প্রতিদিন ৫ গ্রামের বেশি লবণ খাওয়া উচিত নয়। অতিরিক্ত লবণ স্ট্রোক এবং হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকিসহ বিভিন্ন রোগ সৃষ্টি করে।
তবে উপকূলীয় জনগোষ্ঠী প্রতিদিনই অতিরিক্ত লবণ খাচ্ছেন। যা পানির সঙ্গে তাদের শরীরে প্রবেশ করছে।
গবেষকরা বলছেন, লোনা পানি পানের কারণে দক্ষিণাঞ্চলে নারীদের গর্ভপাতের হারও বেড়েছে। এতে স্বাস্থ্যঝুঁকির পাশাপাশি পানিতে লবণাক্ততা বৃদ্ধির ফলে কৃষি জমিও কমে যাচ্ছে।
এ বিষয়ে কথা হয় বগুড়ার কাহালু উপজেলার কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপসহকারী কৃষি এসএম আল-আমিনের সঙ্গে। তিনি জানান, বন্যা ও জলাবদ্ধতার কারণে দীর্ঘদিন ধরে লোনা পানিতে ডুবে থাকে কৃষি জমি। এতে কৃষি জমি হারাচ্ছে উর্বরতা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, উপকূলীয় অঞ্চলে লোনা পানির প্লাবনে অনেক কৃষক ফসল উৎপাদন করা ছেড়ে দিয়ে পেশা বদল করেছেন।
পরিবেশ ও কৃষিতে লবণাক্ত পানির প্রভাব সম্পর্কে জানতে চাইলে বগুড়ার সরকারি আজিজুল হক কলেজের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মো. আবু সাঈদ বলেন, পরিবেশের জন্য উপকূলীয় অঞ্চলে লবণাক্ততা অন্যতম একটি সমস্যা। বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ফলে মেরু অঞ্চলের বরফ গলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পাওয়ায় এ সমস্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশেষ করে উপকূলীয় কৃষি পরিবেশ হুমকির সম্মুখীন হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, সমুদ্রের লবণাক্ত পানি আগের তুলনায় মূল ভূমির দিকে চলে আসছে। ফলে আগের চেয়ে বেশি পরিমাণে ভূমি লবণাক্ত জোয়ারের পানিতে ডুবে যাচ্ছে। এ কারণে কৃষি ভূমি তার স্বাভাবিক উৎপাদন ক্ষমতা হারিয়ে ফেলছে। এ ছাড়াও লবণাক্ততার কারণে স্বাভাবিক ভূমির গাছপালাও টিকে থাকতে ব্যর্থ হচ্ছে। যে কারণে স্বাভাবিক পরিবেশ ও প্রতিবেশ কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে।
কৃষিতে লবণাক্ত পানি ব্যবহার করা যায় কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, পরিবেশের এ প্রতিকূলতাকেও কাজে লাগানো যেতে পারে লবণ উৎপাদন ও চিংড়ি চাষের মাধ্যমে। কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো যদি লবণাক্ততা সহিষ্ণু কোনো ধানের জাত আবিস্কার বা কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থার উদ্ভাবন করতে পারে তাহলে এ সমস্যা দূর হওয়ার সম্ভাবনাকে জাগাতে পারে।
সাধারণত দক্ষিণবঙ্গের উপকূলীয় অঞ্চলগুলোতে পানির সংকট পাওয়া যাবে না। তবে এসব অঞ্চলে সুপেয় পানির তীব্র সংকট রয়েছে। অঞ্চলগুলোর অধিকাংশ স্থানের পানিই লবণাক্ত।
উপকূলীয় অঞ্চলের জীবনযাত্রা নিয়ে বাংলাদেশের জাহাঙ্গীরনগর, ব্রাক ও জাপানের হককাইডো বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের করা এক গবেষণাপত্রে উল্লেখ করা হয়, বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের বাসিন্দাদের অত্যাধিক লবণ খাওয়ার বিষয়ে সামগ্রিক ঝুঁকির ধারণা কম। পানির মাধ্যমেও যে শরীরে লবণ প্রবেশ করতে পারে তা তাদের জানা ছিল না। নোনা জল ব্যবহারের কারণে গ্রামবাসীরা চর্মরোগ, চুল পড়া, ডায়রিয়া, গ্যাস্ট্রিক এবং উচ্চ রক্তচাপে ভুগছেন। এ ছাড়াও লবণাক্ত পানিবাহিত নানা রোগে তারা আক্রান্ত।
উপকূলীয় এলাকায় উচ্চ রক্তচাপের জন্য লবণাক্ত পানি একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ। লবণাক্ত পানির কারণে গর্ভবতী নারীরা প্রি-এক্লাম্পসিয়া (গর্ভাবস্থায় উচ্চ রক্তচাপজনিত জটিলতা) ও এক্লাম্পসিয়ায় (খিঁচুনি) আক্রান্ত হন। সেইসাথে শিশু মৃত্যুর ঝুঁকিও বাড়ে।
কানাডার পানি সম্পদ প্রকৌশলী (ম্যাট্রিক্স স্যুলুশন) সাবরিনা রশিদ সেওঁতি বলেন, উপকূলীয় এলাকার বাসিন্দাদের স্বাস্থ্যের উপর অনিরাপদ লবণাক্ত পানির দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব নিয়ে সচেতন হতে হবে। একইসঙ্গে অবশ্যই বিশুদ্ধ নিরাপদ পানি পান করাটা জরুরি।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে