ভুল কৃষিতে সুপেয় পানি নষ্ট করা যাবে না
সব মাটি যে সব ফসলের জন্য উপযুক্ত নয় তা বাংলার কৃষকরা হাজার বছর ধরেই জানেন। তারপরও ভুল কৃষিতে নোয়াখালীর সুবর্ণচরে সুপেয় পানি নষ্ট করা হচ্ছে, যার কারণে সুপেয় পানির জন্য হাহাকার দেখা দিয়েছে আশপাশের জনপদে। গতকাল বৃহস্পতিবার (১৩ মার্চ) সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে জানা যায়, ধান চাষে ভূগর্ভের পানি অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহারে বাড়িঘরের গভীর নলকূপে এখন আর পানি ওঠে না। পুকুর-জলাশয়েও পানি থাকছে না। সুপেয় পানি কিনে খেতে হচ্ছে অনেককে। এতে গৃহস্থালির কাজে দেখা দিয়েছে অচলাবস্থা। বিশুদ্ধ পানির অভাবে সুবর্ণচরের লাখ লাখ মানুষ দুর্বিষহ জীবন কাটাচ্ছেন।
প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, এক সময় সুবর্ণচর ছেয়ে থাকত সবুজের সমারোহে। আমন ধান কাটার পরই শুষ্ক মৌসুমে মাঠে মাঠে ধুম পড়ত রবি ফসল চাষে। তরমুজ, ডাল, বাদাম, মরিচ, শীতকালীন সবজি, সরিষা, কালিজিরা, সূর্যমুখীতে হাসত চরের মাটি। তবে কয়েক বছরে বদলে গেছে নোয়াখালীর রবিশস্যের ভাণ্ডার উপকূলীয় জনপদ সুবর্ণচরের চাষাবাদ। রবিশস্য ছেড়ে বোরো (ইরি) ধান চাষ করছেন কৃষক। শুষ্ক মৌসুমে ধান চাষই এখন সুবর্ণচরের জন্য অভিশাপ! খাল-বিল-ডোবায় ভরপুর মিঠাপানির রাজ্যে এখন পানীয় জলের হাহাকার।
ধান চাষের জন্য প্রচুর পানি লাগে, তার জন্য ধানি জমির আশপাশে খাল-বিল-নদী থাকতে হয়; বা নদীর পাশের জমিতেই মানুষ ধান চাষ করে- এমনটাই হাজার বছরের রীতি। গত কয়েক দশক ধরে ব্যাপকভাবে ভূগর্ভস্থ পানি দিয়ে ধান চাষ হচ্ছে তার ক্ষতিকর দিক নিয়েও অনেক কথা হয়েছে। তাও যদি লোকালয়ের বাইরে, মানুষের আবাসস্থল থেকে দূরে হয় তাও একটা কথা; কিন্তু যেখানে হাজার হাজার মানুষের বাস এবং সেই সব মানুষরা পানি পানের জন্য ভূগর্ভস্থ পানির ওপরই নির্ভরশীল সেখানে ভূগর্ভস্থ পানি দিয়ে ধান চাষ তো আত্মঘাতীর শামিল। রবিশষ্য চাষে এত পানি ব্যয় হয় না। কুয়াশাতেই রবিশষ্য হয়ে যায়। তাহলে সুবর্ণচরে রবিশস্য চাষ বাদ দিয়ে ধানের চাষ কেন?
কৃষি বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, সুবর্ণচরে ৩৮ হাজার ৫০০ হেক্টর আবাদি জমি আছে। এর মধ্যে ২০০০ সালে মাত্র ২০০ হেক্টর জমিতে বোরো চাষ হয়েছে। বাকি জমিতে হয়েছে রবি ফসলের আবাদ। গত বছর সুবর্ণচরে ১৫ হাজার ৬৫০ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ ও ৩ হাজার ৫০০ হেক্টর জমিতে ডালজাতীয় ফসল আবাদ হয়। এ বছর ১৮ হাজার হেক্টর জমিতে বোরো ধান ও ২ হাজার ৭৫০ হেক্টর জমিতে খেসারি আবাদ হয়েছে। এই ধান চাষে ব্যবহার হয়েছে ৫০ কোটি ১৬ লাখ ২০ হাজার ২৮০ কিউসেক পানি। এর মধ্যে মাত্র ৩০ শতাংশ পানি ব্যবহার হয় উপরিভাগ থেকে। প্রতি হেক্টর ধান চাষে ৪ লাখ ১৪০ কিউসেক পানি খরচ হচ্ছে।
সুবর্ণচরের অধিবাসীরা সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন, ধান চাষে কৃষি বিভাগ থেকে উন্নত জাতের বীজ, সার, কীটনাশকসহ সব রকম সহায়তা দেয়া হচ্ছে। অথচ রবিশস্য ধ্বংস করে ধান চাষ বিস্তারের কারণে পুরো জনপদ পানিশূন্য হয়ে যাওয়ার বিষয়টি আমলেই নেয়া হচ্ছে না। উল্টো কোনো পরিকল্পনা ও অনুমোদন ছাড়া স্থানীয় চাষিরা বোরো চাষের জন্য ১ হাজার থেকে ১ হাজার ২০০ ফুট গভীর নলকূপ বসিয়ে পানি তোলার কারণে উপজেলাজুড়ে পানির সংকট দেখা দিয়েছে। আমরা চাই এই সমস্যা সমাধানের দিকে সরকার অচিরেই নজর দিক। ভূগর্ভস্থ পানিতে ধান চাষের ফলে যে ব্যয় হচ্ছে তার চেয়ে বেশি হচ্ছে প্রাকৃতিক ক্ষতি, এটা সরকারকে অবশ্যই আমলে নিতে হবে। একটা কথা সরকারকে অবশ্যই মনে রাখতে হবে, ভুল কৃষিতে সুপেয় পানি কোনোভাবেই নষ্ট করা যাবে না।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে