আয়করেও বৈষম্য: এক দেশে দুই আইন
সংবিধানের আলোকে সব নাগরিকের সমান অধিকার পাবার কথা থাকলেও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) আয়কর আইনে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সাথে সাধারণ এবং বেসরকারি চাকরিজীবীদের রয়েছে চরম বৈষম্য। আয়কর দিতে নানা ধরনের ছাড় পান রাষ্ট্র পরিচালনায় যুক্ত ব্যক্তি এবং বিচার বিভাগের বিচারপতি কিংবা সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। শুধুমাত্র মূল বেতন ও উৎসব ভাতার ওপর তাদেরকে আয়কর দিতে হলেও চাকরিকালীন অন্য সুবিধাগুলো কিংবা অবসরকালীন সব সুবিধা যেমন পেনশন, আনুতোষিক, স্বীকৃত ভবিষ্য তহবিল, বার্ধক্য তহবিল এবং স্বেচ্ছায় অবসর গ্রহণকালে প্রাপ্ত যেকোনো অর্থ, পেনশনারস সেভিংস সার্টিফিকেট থেকে গৃহীত সুদ/মুনাফা ইত্যাদিকে এর আওতার বাইরে রাখা হয়েছে। অন্যদিকে সব ধরনের আয়ের ওপর আয়কর দিতে হয় বেসরকারি চাকরিজীবীদের।
প্রধানমন্ত্রী, স্পিকার, মন্ত্রী, ডেপুটি স্পিকার, এমপিসহ রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিরা এই সুবিধা নেওয়ার ক্ষেত্রে আরো এককাঠি সরেস। তারা শুধু মূল বেতন বা সম্মানির ওপর আয়কর দেন। বাকি সব আয়করমুক্ত। একই সুবিধা ভোগ করেন প্রধান বিচারপতিসহ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ ও হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতিরাও।
কর প্রদানে এক দেশে দুই ধরনের আইনের প্রয়োগকে সংবিধানের মূলনীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক, বৈষম্যমূলক, ন্যায্যতার পরিপন্থী এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, আগের সরকার বিভিন্ন অন্যায্য সিদ্ধান্ত নিলেও এসব বৈষম্যমূলক আইন বাতিলের এখনি উপযুক্ত সময়।
‘আয়কর আইন, ২০২৩’ অনুসারে এসআরও জারি করে মেয়াদহীনভাবে প্রধানমন্ত্রী, স্পিকার, ডেপুটি স্পিকার, মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, উপমন্ত্রী এবং মন্ত্রী পদমর্যাদার উপদেষ্টা ও সংসদ সদস্যদের মূল বেতন ছাড়া প্রাপ্ত উৎসব ভাতা, সব ধরনের ভাতা ও অন্যান্য সুবিধাকে আয়কর অব্যাহতি দিয়েছে এনবিআরের আয়কর বিভাগ। আরেকটি এসআরওর মাধ্যমে একই ধরনের সুবিধা দেওয়া হয়েছে প্রধান বিচারপতি, সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ ও হাইকোর্ট বিভাগের বিচারকদের।
নিজেদের যেকোনো আয়কে আয়করের আওতায় রাখায় ক্ষুব্ধ বেসরকারি চাকরিজীবীরা। তারা বলছেন, মন্ত্রী-এমপিরা জনগণের সেবক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তাদের এবং সরকারি কর্মকর্তাদের ব্যাপক পরিসরে করছাড় নৈতিকভাবে গ্রহণযোগ্য নয়। তাদের এই অনৈতিক সুবিধা নেওয়ার প্রবণতা বৈষম্যমূলক এবং করদাতাদের মধ্যে নেতিবাচক ধারণা তৈরি করছে। কারণ, সবাই এ দেশের নাগরিক।
এদিকে, জনপ্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার পর কোনো ধরনের শুল্ক ছাড়াই বিদেশ থেকে গাড়ি আমদানি করতে পারেন সংসদ সদস্যরা। তবে দেশের সাধারণ একজন নাগরিককে সিসিভেদে একই গাড়ি কিনতে গেলে ৮৯ থেকে ৮৫০ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক পরিশোধ করতে হয়। সেই হিসাবে একটি গাড়ির দাম এক লাখ টাকা হলে তা আমদানিতে অন্তত আরো ৮৯ হাজার টাকা শুল্ক পরিশোধ করতে হয়। আর সর্বোচ্চ হার ধরা হলে শুল্ক দাঁড়ায় আট লাখ ৫০ হাজার টাকা। তবে এমপিদের জন্য শুল্ক পরিশোধে কোনো খরচ নেই।
এনবিআর সূত্র জানায়, ২০১৭ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত শুল্কমুক্ত সুবিধায় ৩১৬টি গাড়ি আমদানি করেছেন সংসদ সদস্যরা। এসব গাড়ির মূল্য ২৬০ কোটি টাকা। সর্বোচ্চ ৮৫০ শতাংশ শুল্ক হিসাব করলে সরকার রাজস্ব হারিয়েছে দুই হাজার ২১০ কোটি টাকা। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের পরামর্শে চলতি অর্থবছরের বাজেটে এমপিদের গাড়ি আমদানির ওপর ২৫ শতাংশ কাস্টমস ডিউটি ও ১৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপের প্রস্তাব দেওয়া হলেও বৈষম্য ধরে রাখতে তা আর আলোর মুখ দেখেনি বলেও অভিযোগ সূত্রটির।
সংবিধানের ২৭ অনুচ্ছেদ বলছে, ‘সব নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান’। আইন কার্যকর হলে তাই সবার জন্যই সমানভাবে হওয়া উচিত এবং এর ব্যত্যয় ঘটলে তা সুস্পষ্ট বৈষম্য বলে মনে করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়াও।
তিনি বলেন, ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে আলাদাভাবে সুবিধা দেওয়ার পদ্ধতি চালু করেছিল আগের সরকার। এখনকার অন্তর্বর্তী সরকারের এমন কোনো দায় নেই। এটি বাতিলের তাই এখনি খুব উপযুক্ত সময়’।
বিচারকপতিদেরও বিশেষ সুবিধা নেওয়ার পরিবর্তে এ বিষয়ে আরো স্বচ্ছ থাকা উচিত বলে মনে করেন এই আইনজীবী। তিনি বলেন, ‘আমরা বৈষম্য বিলোপের কথা বলছি। কিন্তু এমন মূর্তিমান বৈষম্যগুলো সঙ্গে রেখে বৈষম্য বিলোপের আলাপ তোলা যাবে না। বিচারিক জায়গায় বিচারপতিরা কেন এমন বিশেষ সুবিধা ভোগ করবেন? তাদের বরং কর দেওয়া এবং এ বিষয়গুলোতে আরো স্বচ্ছ থাকার দায়বদ্ধতা বেশি।’
‘এগুলো বাতিলের প্রস্তাব খুবই যুক্তিযুক্ত এবং এমন বৈষম্যমূলক প্রক্রিয়াগুলো থাকাই উচিত নয়’ বলেও দাবি ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়ার।
একই মত পোষণ করেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন ও এনবিআরের সাবেক সদস্য (করনীতি) ড. সৈয়দ আমিনুল করিম।
ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, ‘কর সবারই দেওয়া এবং সবার জন্য একই হওয়া উচিত। বেতন-ভাতাসহ সরকারের যেকোনো খরচ হচ্ছে জনগণের টাকায়। আয়কর রেয়াত নেওয়া তাই ন্যায্যতার ভিত্তিতে সঠিকও নয়।’
ড. সৈয়দ আমিনুল করিম বলেন, ‘কোনো সন্দেহ নেই, এগুলো অসঙ্গতিপূর্ণ ও বৈষম্যমূলক এবং এসব থাকতে পারে না। বেসরকারি চাকরিজীবীদের প্রভিডেন্ট ফান্ডের ওপর কর আছে, কিন্তু সরকারি কর্মচারীদের নেই। দুজনেই যেহেতু রাষ্ট্রের নাগরিক, সেহেতু এটাও থাকতে পারে না।
‘এক দেশে দুই আইন থাকতে পারে না’ মন্তব্য করে অন্তর্বর্তী সরকারকে এ আইন সংশোধনের আহ্বানও জানান দুই বিশেষজ্ঞ।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে