Views Bangladesh

Views Bangladesh Logo

যে কারণে ছাপানো টাকায় মূল্যস্ফীতি হয়

Zeauddin Ahmed

জিয়াউদ্দীন আহমেদ

শুক্রবার, ১১ অক্টোবর ২০২৪


জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, ‘ফ্যাসিবাদী’ সরকার লুটপাট করার জন্য নতুন করে ৬০ হাজার কোটি টাকা ছাপিয়ে বাজারে ছাড়ার কারণে মুদ্রাস্ফীতির শিকার হয়েছে দেশের মানুষ এবং এই মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণই অন্তর্বর্তী সরকারের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরও মুদ্রাস্ফীতি এবং মূল্যস্ফীতির জন্য এই ৬০ হাজার কোটি টাকাকে দায়ী করেছেন। ব্যাংকিং সেক্টরে তারল্য সংকট এখন এত তীব্র যে, এরই মধ্যে কয়েকটি ব্যাংক ১২ শতাংশের বেশি সুদে আমানত সংগ্রহ করতে বাধ্য হচ্ছে। দেশ এবং ব্যাংকিং সেক্টরে বিরাজমান অস্থিরতার কারণে বিনিয়োগেও স্থবিরতা নেমে এসেছে, কয়েকটি ব্যাংক বাধ্য হয়ে সরকারি ট্রেজারি বিল ও বন্ডে বিনিয়োগ বেছে নিচ্ছে। শুধু ব্যাংক নয়, উচ্চ সুদে ব্যক্তি পর্যায়েও সরকারের বিল ও বন্ডে প্রচুর বিনিয়োগ হচ্ছে। শিল্প খাতে সৃষ্ট অনিশ্চয়তা এবং সুদের উচ্চ হারের কারণে শেয়ার বাজারে ধস নামছে।

নোট বা টাকা ছাপানো বন্ধ করার জন্য আওয়ামী লীগ আমলে নামকরা অর্থনীতিবিদদের কড়া পরামর্শ ছিল। ৬০ হাজার কোটি টাকা নিয়ে যারা কথা বলেছেন, তারা সবাই জ্ঞানী-গুণী অর্থনীতিবিদ; কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক নোট ছাপিয়ে ৬০ হাজার কোটি টাকা সরকারকে দিয়েছে, কোনো ব্যক্তিকে নয়। সরকারের প্রয়োজনে সরকারকে টাকা দেয়া কেন্দ্রীয় ব্যাংকের জন্য ফরজ। সরকার এই টাকা রাতের অন্ধকারে নেয় না, সংসদে অনুমোদিত বাজেটের ব্যয় নির্বাহের জন্য নিয়ে থাকে। প্রতিটি মন্ত্রণালয় ঠিকাদারদের প্রাপ্য টাকা চেকের মাধ্যমে পরিশোধ করে থাকে এবং সরকারের অ্যাকাউন্টে টাকা থাকা, না থাকা নির্বিশেষে সেই চেকের টাকা বাংলাদেশ ব্যাংক পরিশোধ করে থাকে। সরকারের শতাধিক অ্যাকাউন্ট বাংলাদেশ ব্যাংকে রয়েছে, এসব অ্যাকাউন্ট থেকে শুধু টাকা পরিশোধ হয় না, সরকারকে জনগণের প্রদেয় করের টাকা জমাও হয়। সারা দিন যা জমা হয়, তার চেয়ে বেশি পরিশোধ হয়ে গেলে তা সরকারের ঋণ, আর পরিশোধের চেয়ে জমা বেশি হলে সরকারের গৃহীত ঋণ স্বয়ংক্রিয়ভাবে পরিশোধ হয়ে যায়। এই পদ্ধতির ঋণ নাকচ করা হলে দেশ অচল হয়ে যাবে। এ ক্ষেত্রে একটিই সমাধান এবং তা হচ্ছে ঘাটতি বাজেট পরিহার করা। সরকারের বাজেটে আয়-ব্যয়ের ভারসাম্য না থাকলে শুধু মুদ্রানীতি দ্বারা সরকারকে ঋণ গ্রহণ করা থেকে বর্তমান গভর্নর বিরত রাখতে পারবেন না।

প্রধান উপদেষ্টার কথা থেকে প্রতীয়মান হয়, বিগত সরকার যত বেশি খরচ করেছে তত বেশি দুর্নীতিও করেছে। সব সরকারই বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে বিভিন্ন প্রকল্পে খরচ করেছে। অপরিহার্য প্রয়োজনে সরকারের ঋণ নেয়া অপরাধ নয়, অপরাধ হচ্ছে গৃহীত ঋণের যথেচ্ছ ব্যবহার। দুর্নীতি লাগাম ছাড়া ছিল বলেই বেনজীর আহমেদ, মতিউর রহমানের মতো লোকের সৃষ্টি হয়েছে, মালয়েশিয়া ও দুবাইতে বাংলাদেশিদের সেকেন্ড হোম হয়েছে, কানাডায় বেগমপাড়া গড়ে উঠেছে, আমলার বাড়িতে দুটি করে সুইমিং পুল করার প্রস্তাব করা হয়েছে, কৃষি কাজ শেখার জন্য রোডেশিয়ায় যাওয়া কথা ভাবনায় এসেছে, খিচুড়ির রান্না শেখার জন্য বিদেশ ভ্রমণের চিন্তা মাথায় এসেছে। দুর্নীতির এত ছড়াছড়ি থাকা সত্ত্বেও আওয়ামী লীগের ওবায়দুল কাদের দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্সের অমর বাণী শোনাতেন, তখন জনগণের হাসি থামাতে কষ্ট হতো।

শুধু আওয়ামী লীগ শাসনামলে দুর্নীতি আর অর্থ পাচার হয়নি, সব আমলেই হয়েছে। দুর্নীতিবাজ আমলার নিজস্ব কোনো রাজনীতি বা আদর্শ থাকে না, তারা সব সময় সরকারকে সমর্থন করে। শুধু বাংলাদেশ নয়, দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিটি দেশ থেকে অর্থ পাচার হচ্ছে। ভারতের নরেন্দ্র মোদি এবং পাকিস্তানের ইমরান খান নির্বাচনি প্রচারণায় পাচার হওয়া টাকা ফেরত আনার অঙ্গীকার করে ক্ষমতায় এসেছিলেন। পরে ইমরান খান নিজেই দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত হয়েছেন। ২০২২ সালে শ্রীলংকার প্রেসিডেন্ট গোটাবায়া রাজাপাকসেকে গণআন্দোলনে দেশ ছেড়ে পালাতে এবং তার বড় ভাই মাহিন্দা রাজাপাকসে প্রধানমন্ত্রীর পদ ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছিলেন। এই পরিবারটি দুর্নীতি ও অর্থনৈতিক দুঃশাসনের অভিযোগে অভিযুক্ত হলেও এখন আবার ক্ষমতায় আসার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।

তৃতীয় বিশ্বের গণতন্ত্রে অন্ধ দলপ্রীতি রয়েছে, বাংলাদেশের কোনো দলের কোনো কর্মী বা সমর্থক বিশ্বাস করে না যে, তাদের দলের শীর্ষ নেতারা দুর্নীতিবাজ। দলের প্রতি এমন অন্ধ আনুগত্যের জন্যই ফিলিপিন্সের একনায়ক ও দুর্নীতিবাজ ফার্দিনান্দ মার্কোসের ছেলে বোংবং মার্কোস এখন ফিলিপিন্সের প্রেসিডেন্ট। অথচ দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত ফার্দিনান্দ মার্কোস ও তার স্ত্রী ইমেলদা মার্কোসকে জনরোষে দেশ ত্যাগ করতে হয়েছিল। ব্রিটিশ আমল থেকে আজ পর্যন্ত কোনো শাসক দুর্নীতি নির্মূল করতে পারেনি, ভবিষ্যতেও পারবে বলে মনে হয় না। লর্ড ক্লাইভ ঘুষ দিয়ে ক্ষমতা দখল করেছিলেন। ব্রিটিশ আমলে এক অজ্ঞাতপরিচয় লেখকের ‘মিয়াজান দারোগার একরারনামা’ বইটিতে ঘুষ ও দুর্নীতির যে চিত্র আঁকা হয়েছে, তা অবিস্মরণীয় এবং চিরকালের। চিরকালের বলেই আওয়ামী লীগের মাঠ ছাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বিএনপির কর্মীরা দুর্নীতির মাঠ দখলে মেতে উঠেছে।

মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে পলিসি সুদের হার বৃদ্ধি করে ৯ শতাংশে উন্নীত করার কথা প্রধান উপদেষ্টা তার ভাষণে উল্লেখ করেছেন। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর ইতোমধ্যে তা সাড়ে ৯ শতাংশে উন্নীত করেছেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আগামী মাসগুলোতে এই নীতি সুদহার ক্রমান্বয়ে আরও বৃদ্ধি করে ১০ শতাংশ বা তারও বেশি বাড়ানোর পরিকল্পনা তিনি গ্রহণ করেছেন এবং এভাবে সুদহার বৃদ্ধি করে মূল্যস্ফীতিকে তিন-চার শতাংশে নামিয়ে আনার আশাবাদও ব্যক্ত করেছেন তিনি। গভর্নরের পরিকল্পনা শুনে মনে হতে পারে, সুদ হার এত বেশি বৃদ্ধি করতে হবে যাতে কেউ আর ঋণের জন্য ব্যাংকের দারস্থ না হন। সুদহার বাড়িয়ে ঋণকে ব্যয়বহুল করার নীতি ইউরোপ এবং আমেরিকায় গ্রহণ করা হলেও জনগণের ক্রয়ক্ষমতা কমানোর চেষ্টা করা হয়নি।

গভর্নরের কথা অনুযায়ী কেন্দ্রীয় ব্যাংক আগের আমলে বিলিয়ন ডলার হারালেও এখন সেই অবস্থায় নেই, তার আমলে বাংলাদেশ ব্যাংক কিছু ডলার কিনে মজুত বাড়াতে সক্ষম হয়েছে। তবে এতে নতুনত্ব কিছু নেই; বাংলাদেশ ব্যাংকের ঘোষিত নীতিই হচ্ছে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর প্রয়োজনে বাংলাদেশ ব্যাংক ডলার বিক্রি করবে এবং তাদের উদ্বৃত্ত ডলার কিনে নেবে। রিজার্ভ রক্ষার অত্যধিক রক্ষণশীল নীতির কারণে আমদানি ব্যাহত হতে পারে, রক্ষণশীল নীতির কারণে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো যখন এলসি খুলতে অনীহা দেখাবে, তখন প্রভাবশালী ব্যবসায়ীরা ডলারের জন্য ছুটে যাবে বাংলাদেশ ব্যাংকে এবং এতে দুর্নীতির নতুন খাতের উদ্বোধন হবে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়লেও মুদ্রাস্ফীতি বাড়ে; যতবেশি বৈদেশিক ঋণ বা রেমিট্যান্স রিজার্ভে জমা হবে, ততবেশি মুদ্রাস্ফীতি হবে।

প্রধান উপদেষ্টা তার ভাষণে উল্লেখ করেছেন যে, মূল্যস্ফীতি থেকে সাধারণ মানুষকে সুরক্ষা দেয়ার লক্ষ্যে ওএমএস, খাদ্যবান্ধব কর্মসূচিসহ সুলভমূল্যে প্রান্তিক মানুষের কাছে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য সরবরাহ চলমান রাখা হয়েছে। এসব কর্মসূচি প্রধান উপদেষ্টার কথিত ‘ফ্যাসিবাদী’ আওয়ামী লীগ সরকারের আমলেই চালু করা হয়েছিল। ‘স্বৈরাচার’ আওয়ামী লীগ সরকারের সবকিছু পরিত্যজ্য হলেও গরিবদের বাঁচিয়ে রেখে মূল্যস্ফীতি কমানোর এই কর্মসূচি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার হুবহু রেখে দিয়েছে। এই খাতে আওয়ামী লীগ সরকার ১ লাখ কোটি টাকা ভর্তুকি দিত। ড. ইউনূস যত কথাই বলুন না কেন, অন্তর্বর্তী সরকারকেও ভর্তুকি অব্যাহত রাখতে হবে, ভর্তুকি পরিহার করলেই জনপ্রিয়তা কমে যাবে।

সুদহার বাড়ানোর প্রধান উদ্দেশ্য ঋণের জোগান হ্রাস করা; কিন্তু অর্থনীতির পথ কখনো সরল রৈখিক নীতিতে চলে না, প্রতিটি নীতি-পদ্ধতির ভালো-মন্দ দুটি দিক রয়েছে। তাই সুদ হার অতিরিক্ত বৃদ্ধি করে বিনিয়োগ ও ক্রয়ক্ষমতা সংকুচিত করা হলে দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ও কর্মসংস্থানও সংকুচিত হবে। দেশের অর্থনীতিতে স্থবিরতা সৃষ্টি হলে কর্মহীন লোকের সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে, শিল্পায়নে স্থবিরতা নামবে, উৎপাদন কমবে, উন্নয়ন কর্মকাণ্ড ভেস্তে যাবে। সুদহার বাড়লে ব্যবসায়ীর মূলধন খরচ বেড়ে যাবে, মূলধন খরচ বেড়ে গেলে জিনিসপত্রের দামও বাড়বে। ব্যাংকে স্বস্তি ফিরে আসার যে গল্প শোনানো হচ্ছে, তা বাংলাদেশ ব্যাংকের অবিবেচনা প্রসূত ঘোষণায় নষ্ট হচ্ছে। ব্যাংকের দেউলিয়ার সংবাদ যখন বাংলাদেশ থেকে প্রচার করা হয় তখন ব্যাংকের প্রতি আমানতকারীদের আস্থা ও বিশ্বাস অটুট রাখা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।

বাজেট কাটছাঁটের কথা প্রথম উচ্চারণ করেছেন অর্থ উপদেষ্টা, একই কথার পুনরাবৃত্তি করেছেন প্রধান উপদেষ্টাও। বাজেট কাটছাঁট করার পরিকল্পনা থাকা সত্ত্বেও অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে আইএমএফ, বিশ্ব ব্যাংক এবং জাইকা থেকে ঋণ নিতে হচ্ছে। দেশকে আওয়ামী লীগ সরকার ঋণে ডুবিয়ে দিয়ে গেছে বলে আগে অনেক চিৎকার হয়েছে; কিন্তু এখন ড. ইউনূসের ঋণ সংগ্রহের দক্ষতায় সবাই গর্ববোধ করছেন। বর্তমান সরকারের ঋণ গ্রহণের বিরুদ্ধে কোনো অর্থনীতিবিদ কোনো বক্তব্য দিয়েছেন বলে শোনা যায়নি। এটা মানতেই হবে যে, সহজ শর্ত ও স্বল্প সুদে ঋণ লাগবেই, বৈদেশিক ঋণ এখনো মাত্রারিতিক্ত হয়নি, জিডিপির তুলনায় এখনো সহনীয় মাত্রায় আছে; বর্তমান অর্থ উপদেষ্টা সালেহ উদ্দিন আহমেদের অভিমতও তাই।

মূল্যস্ফীতি ও মুদ্রাস্ফীতির প্রধান কারণ সরকারের অতিরিক্ত ঘাটতি বাজেট এবং সীমিত রাজস্ব আদায়। জিডিপির অনুপাতে সরকারের রাজস্ব আহরণ মাত্র ৮ শতাংশ, তা আরও বৃদ্ধি করা সম্ভব না হলে সরকারের ঋণ নির্ভরতা ও মূল্যস্ফীতি জোর করে কমানো যাবে না। জিনিসপত্রের দাম দিন দিন বাড়ছে, তারপরও জনগণ আগের মতো চিৎকার করছে না, কারণ জনগণ এই সরকারের সফলতা প্রত্যাশা করে। জিনিসপত্রের দাম কম রাখার অভিপ্রায়ে নিত্যপ্রয়োজনীয় কিছু পণ্যের আমদানি শুল্ক বর্তমান সরকার রহিত করেছে; কিন্তু আমদানি শুল্ক হ্রাস ও রেগুলেটরি শুল্ক প্রত্যাহার করে সাময়িক বেনিফিট পাওয়া সম্ভব হলেও দীর্ঘমেয়াদি বেনিফিট পেতে হলে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের দুর্নীতি হ্রাস করা জরুরি। গোটা বাংলাদেশে যে পরিমাণ দুর্নীতি হয়, তার বেশিরভাগ হয় জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে দুর্নীতিমুক্ত করা সম্ভব হলেই কেবল দেশ ও জাতি মূল্যস্ফীতি থেকে রক্ষা পাবে।

জিয়াউদ্দীন আহমেদ: সাবেক নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক ও সাবেক এমডি, টাকশাল।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ