প্রত্যেকটি জীবকে এক ধরনের বিষাদের মধ্য দিয়ে যেতেই হয়
আনিফ রুবেদ, এ সময়ের অত্যন্ত মেধাবি একজন কবি, কথাসাহিত্যিক, ভাবুক ও ছোটগল্পকার। ব্যতিক্রমী লেখালেখির জন্য সমৃদ্ধ-পাঠকের দৃষ্টি-আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছেন। পেয়েছেন জেমকন তরুণ কথাসাহিত্য পুরস্কার। রাজধানীর বাইরে থেকেও দাপটের সঙ্গে অধিকার করে নিতে পেরেছেন মূলসাহিত্যধারায়। ভিউজ বাংলাদেশের সঙ্গে কথা হলো তার সাহিত্যজীবন নিয়ে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন কামরুল আহসান।
ভিউজ বাংলাদেশ: কেমন আছেন?
আনিফ রুবেদ: ভালো আছি।
ভিউজ বাংলাদেশ: ভিউজ বাংলাদেশের পক্ষ থেকে আপনাকে স্বাগত জানাচ্ছি। আপনার জন্ম ১৯৮০ সালে। ৪৪ বছর হলো আপনার। এই ৪৪ বছরের জীবন কেমন লাগছে? জীবন সম্পর্কে কেমন অভিজ্ঞতা হলো?
আনিফ রুবেদ: আমি সাহিত্যের ভেতর দিয়ে, শিল্পের ভেতর দিয়ে জীবনটাকে সব সময় যাপন করতে চেয়েছি। এখন পর্যন্ত যাই আমি করি না কেন, আমি যখন হাঁটি, খাই, কোনো কাজ করি, সব সময়ই আমার চেতনার ভেতর সাহিত্যচর্চার বিষয়টাই থাকে। পড়া, দর্শনের চর্চা করা এই আমার জীবন। এর ভেতর দিয়েই আমি জীবনকে উপলব্ধি করি। জীবনের অভিজ্ঞতা বলতে আমার চেতনার জগৎ।
ভিউজ বাংলাদেশ: খুব ছোটবেলায় একটি ছড়া লেখার মধ্য দিয়ে আপনার সাহিত্যজীবন শুরু...
আনিফ রুবেদ: একদম তাই। ছোটবেলায় আমাদের বাড়ির বাইরে একটা টমেটোর ক্ষেত ছিল। ওই পাশেই আমরা মাদুর পেতে বসতাম, পড়তাম। এক শীতের সকালে হঠাৎ করেই আমি একটা ছড়া লিখে ফেলি। এখনো আমি বুঝতে পারি না কেন এটা আসল। কেন আমি এটা লিখলাম।
ভিউজ বাংলাদেশ: সেই ছড়ার দু-একটা লাইন কি আপনার মনে আছে?
আনিফ রুবেদ: হ্যাঁ, ছড়াটা ছিল এরকম: ‘টমেটো বাগুন টমেটো বাগুন/খোকা খায় হাপুর হাপুন/ চৈত্রমাসে আসে বউ/ মৌচাকে হয় মৌ...’ এরকম ছিল।
ভিউজ বাংলাদেশ: আপনার এক সাক্ষাৎকারে পড়েছি আপনার দাদা আপনাকে লেখালেখিতে খুব উৎসাহিত করতেন।
আনিফ রুবেদ: একদম তাই। আমার দাদাই আমাকে পড়াশোনা শিখিয়েছেন। আমি রাত্রে ঘুমাতামও তার কাছে। ভোররাতে দাদা যখন নামাজ পড়তেন, নামাজ শেষে তিনি যে মোনাজাত করতেন, মোনাজাতটা তিনি ছন্দাকারে পড়তেন। জানি না ওটা তার নিজের লেখা, নাকি কোথাও থেকে সংগ্রহ করেছিলেন। ঘুমের ঘোরে সেই মোনাজাত শুনতে আমার খুব ভালো লাগত। ওই ছন্দের দোলটা বোধহয় আমার ভেতরে কোনোভাবে থেকে গেছে।
ভিউজ বাংলাদেশ: আপনি সচেতনভাবে লেখালেখির সিদ্ধান্ত নিলেন কবে?
আনিফ রুবেদ: এই সিদ্ধান্তটা আমি সচেতনভাবে নেই ক্লাস এইটে থাকতে। তখন সংগীতের প্রতি আমার খুব আগ্রহ তৈরি হয়। তখন আমাকে মসজিদে পাঠানো হলো আরবি শিখতে। একটা খাতা দিয়ে দেয়া হলো। আমি সেই খাতা ভরিয়ে ফেললাম গান লিখে। পরবর্তীতে আমি গানের যে গঠন দেখি তার সঙ্গে মিল ছিল না এসবের। নিজে নিজে সুর করে একরকম গানের ধরন আরকি। পরে আমি লেখালেখির চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেই ইন্টারমিডিয়েটে পড়ার সময়। তখন থেকেই আমার একাডেমিক যে-পড়াশোনা সেটা মোটামুটি শেষই হয়ে গেল। শেষ হয়ে গেল মানে কোনোরকম কষ্ট করে আমি অনার্সটা শেষ করতে পেরেছি। একটা ব্যাপার আমি ধরে নিয়েছিলাম, আমাকে প্রচুর বই পড়তে হবে। এখন পর্যন্ত আমি চেষ্টা করি প্রতিদিন পঞ্চাশ পৃষ্ঠা পড়তে।
ভিউজ বাংলাদেশ: পেশাগত জীবনে আপনি কী করেন?
আনিফ রুবেদ: আমি শিক্ষকতার সঙ্গে যুক্ত আছি।
ভিউজ বাংলাদেশ: বিয়ে করেছেন?
আনিফ রুবেদ: হ্যাঁ, করেছি।
ভিউজ বাংলাদেশ: সন্তান আছে?
আনিফ রুবেদ: না, নেই।
ভিউজ বাংলাদেশ: আপনি তো লেখালেখির জীবনে প্রায় অবসেস্ড; কিন্তু আমাদের সমাজজীবনে তো শিল্পজীবনের সঙ্গে অনেক সংঘর্ষ আছে। আপনি সেগুলো কীভাবে মোকাবিলা করেন?
আনিফ রুবেদ: অনেকের কাছে তো অনেক কথাই শুনতে হয়। সেটা কীভাবে বর্ণনা করব? আমি চেষ্টা করি একটু এড়িয়ে যেতে। যারা আমার জীবনযাপন পছন্দ করে না তাদের দেখলে আমি একটু দূর দিয়ে হাঁটি।
ভিউজ বাংলাদেশ: আপনি চাঁপাইনবাবগঞ্জ যেখানে থাকে সেটা শহর না গ্রাম?
আনিফ রুবেদ: শহরের একটু উপকণ্ঠে। গ্রামই ওটা, কিন্তু গ্রামের যে-আবহ, সেটা এখন আর নেই।
ভিউজ বাংলাদেশ: ওখানে আপনার মনোবৃত্তি অনুযায়ী সঙ্গীসাথী আছে, নাকি নিঃসঙ্গ বোধ করেন?
আনিফ রুবেদ: হ্যাঁ, নিঃসঙ্গতা আছে। তারপরও আমি চেষ্টা করছি, যারা ওই ধরনের লোক, একটু শিল্পসাহিত্য চর্চা করেন, তাদের কাছে টেনে নেয়ার। আমি একটা সংগঠন করেছি, যারা গান গাইতে পছন্দ করে আবৃত্তি করতে পছন্দ করে, ওদের ওখানে ডাকি। সম্প্রতি আমি একটা বাড়িভাড়াও নিয়েছি। ওখানে বাচ্চাদের চিত্রকলা, সংগীত শেখানো ব্যবস্থা করেছি।
ভিউজ বাংলাদেশ: আপনার বয়স ৪৪, বই বেরিয়েছে ৯টি, একটি পুরস্কার আপনি পেয়েছেন, এই বয়সে এসে আপনার কী মনে হয়, বাংলাসাহিত্যে আপনার প্রতিষ্ঠা পাওয়ার আত্মবিশ্বাস কীরকম?
আনিফ রুবেদ: প্রতিষ্ঠা পাওয়া নিয়ে আমি ভাবি না। আমি লেগে থাকতে চাই। আমার শিল্পসাধনাই আমার জীবন। আমৃত্যু এ-নিয়েই থাকব।
ভিউজ বাংলাদেশ: এ বছর আপনার যে-উপন্যাসটি প্রকাশিত হয়েছে, ‘কালকাঠুরে’; এ নিয়ে কিছু বলুন।
আনিফ রুবেদ: এ-উপন্যাসটিতে আমার চিন্তাভাবনার মোটামুটি সামগ্রিক একটা রূপ আছে। বিজ্ঞানীরা যেমন বলেন, এই মহাবিশ্ব সৃষ্টি হয়েছে বিগ ব্যাং থেকে। একটা মহাবিস্ফোরণ থেকে। এটা একটা বস্তুগত ব্যাপার, যার দ্বারা গ্রহ-নক্ষত্র-জল-মাটি তৈরি হয়েছে; কিন্তু, আমি বলি, ভাবগত একটা ব্যাপারও এর সঙ্গে আছে। এর সঙ্গে একটা বিষাদবিন্দুর বিস্ফোরণ হয়েছে। এই বিষাদবিন্দুর বিস্ফোরণের ফলে আমাদের প্রত্যেকটা মানুষকে, প্রত্যেকটা জীবকে এক ধরনের বিষাদের মধ্য দিয়ে যেতেই হয়।
ভিউজ বাংলাদেশ: এই বিষাদ থেকে মুক্তির উপায় কী?
আনিফ রুবেদ: উপায় একটাই। একজন মানুষ আরেকজন মানুষকে যতটা আনন্দ দিতে পারে। আমরা সবাই যদি সবাইকে আনন্দ দিতে পারি তাহলে হয়তো এই বিষাদের কিছুা লাঘব হবে। আমার লড়াই, আমার আন্দোলন, আমার লেখালেখির কোনো উদ্দেশ্য যদি থাকে, তাহলে এটা একটা ধরা যেতে পারে।
ভিউজ বাংলাদেশ: আপনার কবিতার মধ্যে গল্পের প্রভাব, গল্পের মধ্যে গল্পের প্রভাব লক্ষ্য করি। কিন্তু, এ-দুটো তো আলাদা মাধ্যম। গল্প ও কবিতাকে আপনি কীভাবে পার্থক্য করেন?
আনিফ রুবেদ: এক সময় আমি এ-সবকিছু অস্বীকার করতে চেয়েছিলাম। আমার কাছে মনে হয়েছিল লেখা তো লেখাই। এটা কোনো গল্পও না, কবিতাও না, উপন্যাসও না। এরকম একটা ভাবনা আমার মধ্যে কাজ করতো এক সময়। এখনো এটাকে আমি সম্পূর্ণ ছেড়ে দিতে পারিনি। তবে, গল্পের মধ্যে একটা ঘটনা থাকে, কবিতার মধ্যে ভাবটুকুই প্রধান।
ভিউজ বাংলাদেশ: শৈল্পিক বা দার্শনিক ভাবনার ক্ষেত্রে আপনি কাদেরদ্বারা প্রভাবিত?
আনিফ রুবেদ: প্রভাবিত ঠিক না। আমি একটা ব্যাপক পাঠের মধ্য দিয়ে যেতে চাই। লালন, রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ দাশ আগাগোড়া আমি পাঠ করেছি। জগতজীবনকে তারা কীভাবে দেখেছেন বুঝতে চাই। ভাবের ক্ষেত্রে লালন বিরাট ব্যাপার আমার কাছে। তারপর লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি আমার কাছে একটা বিরাট ব্যাপার। একজন মানুষ যে কত ধরনের কাজ করতে পারেন, এটা ভিঞ্চিকে দেখলে বোঝা যায়।
ভিউজ বাংলাদেশ: লালনের কোন দর্শন আপনাকে শক্তি দেয়?
আনিফ রুবেদ: লালনের মানবতাবাদীদর্শন। মানুষে মানুষে এখন যে ফারাক, ধর্ম দিয়ে, গোত্র দিয়ে, রাষ্ট্র দিয়ে আমরা যে ফারাক সৃষ্টি করেছি লালন এখান থেকে আমাদের মুক্তি দেয়। তিনি বলেছেন, মানুষ ভজলেই সোনার মানুষ হবি। এই সোনার মানুষের সাধনা আমরা লালনের দর্শন থেকে পাই।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে