গণতন্ত্র ও শিক্ষার অধিকার পরস্পর সম্পর্কিত
বর্তমান অবস্থাকে অনেকে অনেকভাবে ব্যাখ্যা করছেন। অনেকে অনেক শব্দ ব্যবহার করছেন- অভ্যুত্থান, বিপ্লব। কেউ কেউ হয়তো অন্য শব্দও ব্যবহার করছেন। স্বাধীনতাও বলছেন দু-চারজন। এই অবস্থায় আসার আগে আমরা যে অবস্থায় ছিলাম সেটাকে যদি স্বৈরতন্ত্র বা ফ্যাসিবাদ বলি, তাহলে বর্তমান অবস্থাকে কী বলব? বর্তমান অবস্থাকে আমরা বলব গণতন্ত্র। প্রাথমিক অবস্থায়। কেউ উচ্চাভিলাষী হলে অন্য কিছু বলবেন। আমি আপাতত গণতন্ত্রই বলছি।
গণতন্ত্র কী? আপনার নির্বাচিত প্রতিনিধি যদি সরকার গঠন করে এবং সরকার গঠন করার পর যদি আইন অমান্য করে, আপনি তাকে সরাতে পারবেন। তা ছাড়া গণতন্ত্রের আরেকটা বিষয় হচ্ছে সমাজ কী করে চলবে? এ নিয়ে সারা পৃথিবীতে প্রচলিত একটা আলোচিত বক্তব্য আছে, ‘সমাজের প্রতিটা সদস্য তার যা সামর্থ্য আছে সে অনুসারে সমাজকে দেবে, বিনিময়ে তার যা কিছু প্রয়োজন তা সমাজ থেকে পাবে।’
অর্থাৎ আপনি সমাজকে দেবেন সামর্থ্য অনুসারে এবং আপনার যা দরকার তা সমাজ থেকে নেবেন। এই অবস্থায় পৌঁছাতে পারলে মোটামুটি গণতান্ত্রিক সমাজ হয়। শুধু ভোট দিলে হয় না। আমরা ভোট দিয়ে এমন সমাজ তৈরি করতে চাই, যেখানে মোটামুটি সামর্থ্যের বিকাশ ঘটবে।
আমাদের ধারণা প্রতিভা, মেধা জিনিসটা প্রকৃতি প্রদত্ত, সেটার পূর্ণ সদ্ব্যবহার চাই। একটু ভেবে দেখলে ব্যাপারটা আপনার কাছে সত্য নাও মনে হতে পারে। মেধা জিনিসটা পরিচর্যার ফসল, বিনিয়োগের ফসল। আপনি কীভাবে শিক্ষা লাভ করছেন, তা নির্ভর করে অনেক বিষয়ের ওপর । শুধু বস্তুগত পাঠ্যপুস্তকের ওপর নির্ভর করে না। আরও অনেক বিষয়ের ওপর নির্ভর করে। আপনি কোন ধরনের স্কুলে যেতে পারবেন, সেটা আপনি নির্ণয় করেন না। মেধা বিকাশের জন্য সমাজে যেসব শর্ত আছে সেটা সমানভাবে বণ্টিত হবার পর প্রতিযোগিতায় আপনি যদি প্রমাণ করতে পারেন আপনি মেধাবী, তাহলে সেটাই হবে প্রকৃত মেধা।
এর মধ্যে নানাভাবে আমরা মানুষকে ভাগ করেছি। আগে প্রাচীন ভারতীয় সমাজে ভাগ করত- ব্রহ্মচার্য, গার্হস্থ্য, বানপ্রস্থ এবং সন্ন্যাস। এগুলোকে হিন্দুধর্মের ভাষায় বলে আশ্রম। সেই জন্য হিন্দুধর্ম বর্ণাশ্রম ধর্ম। চার বর্ণে বিভক্ত এবং চারটি আশ্রম জীবনে। গড়ে ধরেন প্রতিটি আশ্রমের বয়স ১৫ বছর বা ২০ বছর, গড় আয়ুর ওপর নির্ভর করে। জীবনের প্রথম ১৫-২০ বছরই শিক্ষার সময়। আপনি বিয়ে করেন না, সন্তান নাই, সংসার নাই, সার্বক্ষণিক পড়াশোনায় নিয়োজিত। এই সময়ের পড়াশোনাটা সারা পৃথিবীতে একই রকম।
আগে বলত দ্বাদশবর্ষ গুরুগৃহে বিদ্যা অভ্যাস শেষে তিনি কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করলেন। এই জন্যই ভারতীয় ভাষায় গ্র্যাজুয়েশনের নাম হচ্ছে স্নাতক। স্নাতক সম্পন্ন হওয়ার পর একজন ছাত্র স্নান করে বেরিয়ে যান। মাদ্রাসায় পাগড়ি দেয়া হয়। ইউরোপে গ্র্যাজুয়েশন মানে গ্রেড পার হওয়া।
এখন একটি রেটরিক চালু হয়েছে সারাজীবন ধরেই শিখতে হবে আমাদের। শিক্ষার শেষ নেই। কেউ এটা অস্বীকার করছে না। শিক্ষাকে এখন তিন ভাগে ভাগ করা হয়, জাতিসংঘের হিসাবে বলছি, ১৯৪৮ সাল নাগাদ যখন ইউরোপে দ্বিতীয় মহাসমর শেষ হলো, তখন তারা একটা ঘোষণাপত্র গ্রহণ করলেন, সাধারণ মাপকাঠি হিসেবে, আইন হিসেবে নয়, লক্ষ্য হিসেবে। এটি মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণা হিসেবে বিখ্যাত, এটা ১৯৪৮ সালের ১০ ডিসেম্বর জাতিসংঘ গ্রহণ করে। সেটার ৩০টি ধারার ২৬ নম্বর ধারাতে বলা আছে, শিক্ষাকে তারা ভাগ করেছেন তিন ভাগে: একটি হলো বুনিয়াদি শিক্ষা। তাদের শব্দকে যদি আমি হুবহু উদ্ধৃতি করি, এলিমেন্টারি ও ফান্ডামেন্টাল এডুকেশন, মানে হলো প্রাথমিক ও বুনিয়াদি শিক্ষা। তারপর হচ্ছে কারিগরি ও বৃত্তিগত শিক্ষা। তারপর হলো উচ্চ শিক্ষা।
সেই হিসাব যদি করি, তারা কিন্তু বয়স নির্ধারণ করে দিয়েছেন। অর্থাৎ কয় বছর পর্যন্ত শিক্ষাকে বুনিয়াদি বলব? সারা পৃথিবীতেই একটা ইতিহাসে আছে, অর্থাৎ বাস্তব জ্ঞান আমাদের আছে, সব দেশেই, যেটাকে এখন আমরা বলি ইন্টারমিডিয়েট বা এইচএসসি, বা ইউরোপে এ লেবেল। এটুকু শিক্ষাই হচ্ছে বুনিয়াদি শিক্ষা।
এর মধ্যে আমরা ছোট ছোট ভাগ করেছি। প্রাথমিক বিদ্যালয়, মাধ্যমিক বিদ্যালয়। জুনিয়র, সিনিয়র ইত্যাদি। জাতিসংঘ বলছে, এই শিক্ষাটা হতে হবে সর্বজনীন। মানে এটা সবার জন্য হবে অবৈতনিক। ১৯৪৮ সালে গৃহীত এটা জাতিসংঘের লক্ষ্য। আমাদের দেশ তখন মাত্র ১ বছর হলো স্বাধীন হয়েছে।
পাকিস্তান স্বাধীন হওয়াটাকে আমাদের স্বাধীনতা বলছি, কারণ আমরা পাকিস্তানের অংশ ছিলাম। আমাদের ইতিহাস চক্রের মধ্যে এটাকে অস্বীকার করা হয়। এটা কিন্তু খুব ভালো ফল বয়ে আনবে না। এটা হলো অনেকটা এরকম যে, এবার যে একটা বিপ্লব হলো, এর জন্য ১৯৭১ সালকে আপনি নাকচ করে দিলেন। দু-চারজনের মধ্যে এরকম নজির দেখা যায়। তেমনিভাবে গত ৫০ বছরে অনেকেই পাকিস্তানের স্বাধীনতাকে অস্বীকার করেছেন। বলছেন যে, ১৯৪৭ ছিল সাম্প্রদায়িক আর ১৯৭১ সাল হলো জাতীয়তাবাদী। এটাও একই ধরনের ভুল হবে। আমি বলব, আমাদের স্বাধীনতা শুরু হয়েছিল ১৯৪৮ সনে। যখন আমরা আমাদের ভুল বুঝতে পারলাম আমরা নাকচ করলাম। ইংরেজিতে বলে নিগেশন করলাম। ৫৩ বছর পর আমরা আবার বুঝতে পারলাম আমাদের এক ধরনের প্রতারণা করা হয়েছে। আমরা আবার নিগেট করলাম, সুতরাং বর্তমান ঘটনার মূল্য হচ্ছে প্রায় ১৯৭১-এর সমান।
তাহলে গত ৭৭-৭৮ বছরে আমাদের ইতিহাসের তিনটি বড় মোড় পরিবর্তন যদি বলেন তা হলো- ১৯৪৭, ১৯৭১ এবং ২০২৪। শুধু নাকচ না, তার মধ্য দিয়ে উত্তরণ হচ্ছে। জার্মান পণ্ডিত হেগেল বলেন, ‘একটা আরেকটাকে অতিক্রম করছে তার পেটের ভেতরে হজম করে। আগেরটাকে বাদ দিয়ে নয়। রসটা সেবন করছে, ছোবলাটা ফেলে দিবে’। এটার আরেকটা ইংরেজি নাম হচ্ছে ক্রিটিক। ক্রিটিক মানে সম-আলোচনা। সম্যক আলোচনা, সমান আলোচনা নয়।
আমাদের শিক্ষার যদি একটা সমালোচনা আমরা করি, জাতিসংঘের যে লক্ষ্য, সর্বজনীন মানবাধিকার বলে একে ঘোষণা করা হয়েছে, এর কারণও আছে, তখন নতুন নতুন দেশ স্বাধীন হচ্ছে, যারা আগে পরাধীন ছিল, ঔপনিবেশিক ছিল, সেই সময়ে তারা বলেছে দুনিয়ার সব মানুষ সমান এটা যদি করতে চাই, সবার জন্য একই রকম শিক্ষা হতে হবে। এ কথার মানে হচ্ছে সবার জন্য একই রকম সুবিধা থাকতে হবে। সেই ক্ষেত্রে তাদের লক্ষ্য ছিল শিক্ষা কতটুকু হতে হবে অবৈতনিক, যেটাকে তারা বুনিয়াদি শিক্ষা বলছেন। আমার বিচারে ১২ বছরের শিক্ষা হবে অবৈতনিক। যদি জাতিসংঘের ঘোষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে চায়।
আরেকটা শিক্ষা হচ্ছে এলিমেন্টারি। আবশ্যিক বা বাধ্যতামূলক। মানে পিতা-মাতা যদি তাদের ছেলেমেয়েদের ওই শিক্ষাটা না দেন তাহলে তাদের দণ্ড দেয়া যাবে। এ জন্যই বলা হয় প্রাথমিক শিক্ষা হতে হবে বাধ্যতামূলক, মাধ্যমিক শিক্ষা ফ্রি। অর্থাৎ প্রাথমিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক এবং ফ্রি, আর মাধ্যমিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক কিন্তু ফ্রি নয়।
প্রাথমিক শিক্ষা কোন পর্যন্ত হবে তা নিয়েও তর্ক আছে। জাপানে, ভিয়েতনামে অনেক দেশেই প্রাথমিক শিক্ষা ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত বাধ্যতামূলক। আমাদের দেশে ইংরেজ আমল থেকেই ৫ম শ্রেণি পর্যন্ত। এগুলো নিয়ে প্রশ্ন তোলা উচিত।
জাতিসংঘের ঘোষণা অনুযায়ী দ্বিতীয় যে শিক্ষা পদ্ধতি সেটা হলো কারিগরি ও পেশাগত শিক্ষা। পেশাগত ও বৃত্তিগত শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা যাবে না, ফ্রিও নয়; কিন্তু জাতিসংঘের প্রস্তাবনা হচ্ছে, সাধারণের জন্য এটা সহজ করে দিতে হবে। যে কেউ এই শিক্ষা নিতে চাইলে তাকে বাধা দেয়া যাবে না।
পেশাগত ও কারিগরি শিক্ষা বলতে আমরা বুঝাচ্ছি ইঞ্জিনিয়ারিং, বুয়েট, মেডিকেল, অথবা অন্য যে কোনো কিছু, ফ্যাশন টেকনোলজি, ইচ্ছে অনুসারে পেশা নির্বাচন করার সুযোগ আপনার থাকতে হবে। আপনাকে পেশা দিতে হবে সমাজকে। এই যে আমরা বলছি, আসন না, ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে বাতিল করছি, এটা জাতিসংঘের লক্ষ্যবিরোধী। মানবসভ্যতার প্রগতি বলতে, জাতিসংঘ যা নির্ধারণ করেছে সেখানে পৌঁছাতে আমরা এখনো বহু দূরে।
যারা যা পড়তে চায়, তাদের তা পড়তে দিতে পারছি না। হয়তো সবাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বেন এমন না, বা দেশের মেডিকেলে ভর্তি হতে না পারলে আর পড়া হবে না এমন না; কিন্তু যে যা পড়তে চায় সেই বিষয়ে যথেষ্ট সুযোগ থাকতে হবে।
একটা প্রশ্ন আছে, সমাজের চাহিদা অনুযায়ী আপনি পড়বেন না কি নিজের মনের বাসনা অনুযায়ী পড়বেন? সেটাই হচ্ছে আমাদের পলিসির প্রশ্ন। তাতে কোনো সহজ সমাধান আছে সেটা আমি বলছি না; কিন্তু সমাধানের মতো পরিস্থিতি তৈরি করতে হবে সমাজকেই। সেটাই হচ্ছে গণতান্ত্রিক সমাজের লক্ষ্য।
(লেখাটি ‘অভ্যুত্থান-পরবর্তী বাংলাদেশ: শিক্ষা নিয়ে কিছু প্রস্তাব’ শীর্ষক আলোচনা সভায় অধ্যাপক সলিমুল্লাহ খানের বক্তব্য থেকে নেয়া)
সলিমুল্লাহ খান: চিন্তাবিদ ও অধ্যাপক, ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশ।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে