Views Bangladesh Logo

বছরজুড়ে আলোচনায় শিক্ষা খাত

পাঠ্যপুস্তক ও শিক্ষা পদ্ধতি বদল, শিক্ষানীতি বাতিল এবং শিক্ষার্থীদের নানা দাবি-দাওয়া নিয়ে আলোচনায় ছিল ২০২৪ সাল। বিশেষ করে ছাত্র-জনতার গণআন্দোলনে ৫ আগস্টের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর স্কুলের পাঠ্যবইয়ে এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছবি বাদ দিয়ে এতে যুক্ত হচ্ছে জুলাই আন্দোলনের গল্প ও গ্রাফিতি।

নতুন করে ছাপা হচ্ছে ৪০ কোটি বই
আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর পুরোনো টেন্ডার বাতিল ও নতুন টেন্ডার আহ্বান করা হয়। এজন্য নতুন বছরে বিনামূল্যের পাঠ্যবই ছাপানো ও বিতরণে কিছুটা বিলম্ব হবে বলে জানানো হয়েছে।

প্রাথমিক ও গণশিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা. বিধান রঞ্জন রায় পোদ্দার জানিয়েছেন, বাইরের একটি দেশে বই ছাপার কথা ছিল। ৫ আগস্টের পর সেই টেন্ডার বাতিল ও নতুন টেন্ডার আহ্বানে বই ছাপাতে কিছুটা বিলম্ব হচ্ছে। এ জন্য বই বিতরণে কিছুটা দেরি হলেও প্রাথমিকের বই জানুয়ারির মধ্যেই প্রাথমিক শিক্ষার্থীদের হাতে বই পৌঁছে দেয়া হবে। তবে আগামী ১ জানুয়ারি বই উৎসব হচ্ছে না।

জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের চেয়ারম্যান এ কে এম রিয়াজুল হাসান বলেন, ‘এবার বই ছাপা হবে ৪০ কোটির মতো। পাণ্ডুলিপির সিডি দেয়া হয়ে গেছে। আশা করছি, পরিকল্পনামতো কাজ হলে বছরের শুরুতেই শিক্ষার্থীদের হাতে বই তুলে দিতে পারবো’।

পাঠ্যবইয়ে ‘জুলাই আন্দোলন’
রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের পাঠ্যবইয়ে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছবি ও তার উদ্ধৃতি বাদ যাচ্ছে। সেগুলোতে যুক্ত হচ্ছে ‘জুলাই আন্দোলনের’ গ্রাফিতি বা দেয়ালে আঁকা ছবি।

এনসিটিবির একাধিক কর্মকর্তা বলেন, বেশকিছু পাঠ্যপুস্তকে ‘ছাত্র-জনতার আন্দোলনের চেতনার’ প্রতিফলন থাকছে। তবে বিষয়টি অতি নিকট ইতিহাস এবং এবার সময়ও কম। তাই লেখা হিসেবে না রেখে কিছু পাঠ্যবইয়ে ‘গণআন্দোলনের’ গ্রাফিতি রাখা হয়েছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একটি সূত্র জানিয়েছে, বাংলা, ইতিহাস, বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয় বইয়ের মতো কিছু বইয়ের প্রচ্ছদে বা বইয়ের কোনো কোনো অংশে এসব গ্রাফিতি যুক্ত হবে। অন্যদিকে এখন পাঠ্যবইয়ের পেছনের পৃষ্ঠায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার যেসব ছবি ও উদ্ধৃতি রয়েছে, সেগুলো বাদ দেয়া হবে। পরিবর্তে চিরন্তন কিছু বাণী যুক্ত হবে। ইতিহাসনির্ভর কিছু বিষয়ও কাটছাঁট হচ্ছে।

বাতিল হচ্ছে শিক্ষানীতি
আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে চালু ২০১০ সালের শিক্ষানীতি বাতিল হয়েছে। একে ‘অনুপযোগী ও অবাস্তবায়নযোগ্য’ বলছে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার। নতুন শিক্ষানীতি প্রণয়নে শিগগিরই গঠিত হবে শিক্ষা কমিশন।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, স্বাধীনতার পর থেকে দেশে প্রণীত ছয়টি শিক্ষানীতি সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বাতিল হয়েছে।

প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী অধ্যাপক আমিনুল ইসলাম বলেন, ‘বর্তমান শিক্ষানীতি সম্পূর্ণ অনুপযোগী এবং এতে কোনো লাভ হবে না। এর বড় অংশই বাস্তবায়িত হয়নি। যা প্রমাণ করে, এটি ‘অবাস্তবায়নযোগ্য’। তাই এটি বাতিলের সিদ্ধান্ত নিয়েছি’।

তিনি বলেন, ‘শিগগিরই নতুন শিক্ষানীতি প্রণয়নে নতুন শিক্ষা কমিশন ঘোষণা করা হবে। আমরা নিশ্চিত যে, এই কমিশন চমৎকার কাজ করবে। নতুন শিক্ষানীতি নিয়ে যেন কোনো বিতর্ক তৈরি না হয়, সেটিও নিশ্চিত করবে’।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা জানান, দুই-তিন কার্যদিবসের মধ্যে নতুন শিক্ষা কমিশনের সদস্যদের নাম প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে পাঠাতে পারে মন্ত্রণালয়।

সব প্রাথমিকে ‘মিড ডে মিল’ চালু
শিক্ষার্থীদের ঝরেপড়ার হার কমাতে আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে দেশের সব প্রাথমিক স্কুলে ‘মিড ডে মিল’ চালু করবে অন্তর্বর্তী সরকার। এ সংক্রান্ত প্রকল্পটি একনেকে পাসের অপেক্ষায়। প্রথম পর্যায়ে ১৫০টি উপজেলার সব স্কুলে এই ‘মিড ডে মিল’ চালু হবে। কক্সবাজার, বান্দরবানসহ দেশের কিছু স্কুলে ‘মিড ডে মিল’ চালু আছে।

প্রাথমিক ও গণশিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা. বিধান রঞ্জন রায় পোদ্দার বলেন, প্রাথমিক পর্যায়ে মানসম্মত শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলা মন্ত্রণালয়ের একার পক্ষে সম্ভব নয়। রকার সমাজের সবার সামগ্রিক অংশগ্রহণ। এ লক্ষ্য অর্জনে সবার সহযোগিতা কামনা করে তিনি বলেন, ‘সবার সহযোগিতায় শিশুদের সাক্ষর করে গড়ে তোলা সম্ভব’।

বিধান রঞ্জন রায় পোদ্দারের দাবি, প্রাথমিকের শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি বাড়াতে উপবৃত্তি দিতে বিশাল ব্যয় হচ্ছে। কিন্তু এটি যে উদ্দেশ্যে করা হয়েছে, সেখানে কাঙ্ক্ষিত ফলাফল অর্জিত হচ্ছে না। উপবৃত্তি পেতে প্রাথমিক স্কুলে শিক্ষার্থীদের নাম থাকে। কিন্তু তারা অন্য স্কুলে পড়ছে।

সমস্যা আর দাবির বৃত্তে সাত কলেজ
প্রায় সাত বছর আট মাস আগে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে থাকা রাজধানীর সাতটি বড় সরকারি কলেজকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করা হয়। কিন্তু কলেজগুলোর উচ্চশিক্ষার মানোন্নয়নে প্রত্যাশিত পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। ফলে শুরু থেকেই এখন পর্যন্ত পরীক্ষা ও ফল প্রকাশে বিলম্ব হওয়াসহ নানা ধরনের সমস্যা আর দাবি-দাওয়ার আন্দোলনের বৃত্তেই ঘুরছে সুপরিচিত এই কলেজগুলো।

কলেজগুলো হচ্ছে ঢাকা কলেজ, ইডেন মহিলা কলেজ, সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ, কবি নজরুল সরকারি কলেজ, বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজ, মিরপুর সরকারি বাঙলা কলেজ ও সরকারি তিতুমীর কলেজ।

রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয়সহ কয়েকটি দাবি জানিয়ে দফায় দফায় আন্দোলন করেন কলেজগুলোর শিক্ষার্থীরা। এতে রাজধানীর কয়েকট গুরুত্বপূর্ণ সড়কে যানচলাচল বন্ধ হয়ে যায়। এরপর সাত সরকারি কলেজের শিক্ষা ও প্রশাসনিক সমস্যা নিরসনে ২৪ অক্টোবর কমিটি গঠন করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।

৬ নভেম্বর শিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদের আশ্বাসে আন্দোলন সাময়িক স্থগিত করেন শিক্ষার্থীরা। তারা বলছেন, উচ্চশিক্ষা নিয়ে ভাবা বিশেষজ্ঞদের নিয়ে কমিশন গঠন করে দ্রুত ব্যবস্থা নেয়া হোক।

তিতুমীর কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরের দাবি
সরকারি তিতুমীর কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরের দাবিতে প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ছিল বছরের আরও একটি আলোচিত ঘটনা। ১৮ নভেম্বর শিক্ষার্থীরা মহাখালী রেলগেট অবরোধ এবং একটি চলন্ত ট্রেনে পাথর ও ইটপাটকেল নিক্ষেপ করলে শিশুসহ কয়েকজন আহত হন। আহত ও রক্তাক্তদের ছবি ও ভিডিও ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়লে তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থীরা ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েন।

তিতুমীর কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয় করা সম্ভব কি-না, খতিয়ে দেখতে কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত দেয় অন্তর্বর্তী সরকার। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বৈঠকে উপদেষ্টাদের আশ্বাসে আন্দোলন তুলে নেন শিক্ষার্থীরা।

তিন কলেজের শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষে রণক্ষেত্র
২৫ নভেম্বর তিন কলেজের শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষে রণক্ষেত্রে পরিণত হয় ঢাকার যাত্রাবাড়ী এলাকা। সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ ও কবি নজরুল সরকারি কলেজের কয়েকশ শিক্ষার্থী ড. মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজের শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালান। তারা কলেজ ভবন ভাঙচুর ও প্রতিষ্ঠান থেকে মূল্যবান জিনিসপত্র নিয়ে যান। শিক্ষার্থীদের ধাওয়া পাল্টা-ধাওয়ায় ৫০ জনেরও বেশি আহত হন।

ড. মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজসহ এক ডজনের বেশি কলেজের হাজারো শিক্ষার্থী পুরান ঢাকার কবি নজরুল ও সোহরাওয়ার্দী কলেজে হামলা করার একদিন পর এ পাল্টা হামলা হয়।

সংঘর্ষের সূত্রপাত ঘটে ঢাকা ন্যাশনাল মেডিকেল ইনস্টিটিউট হাসপাতালে। অভিযোগ ওঠে, চিকিৎসকের গাফিলতিতে ডা. মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজের শিক্ষার্থী অভিজিতের মৃত্যু হয়। এর বিচার দাবিতে ২৪ নভেম্বর হাসপাতালটি ঘেরাও করেন বিভিন্ন কলেজের শিক্ষার্থীরা। বিক্ষোভ সংঘর্ষে রূপ নিলে হাসপাতালসহ পাশের সোহরাওয়ার্দী ও কবি নজরুল কলেজে ভাঙচুর-লুটপাট চালানো হয়।

পাঠ্যবইয়ের পাতা ছিঁড়ে আলোচনায় শিক্ষক আসিফ
সপ্তম শ্রেণির পাঠ্যবইয়ের ‘শরীফ থেকে শরীফা’র গল্পের পাতা ছিঁড়ে প্রতিবাদ করা ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিলোসফির খণ্ডকালীন শিক্ষক আসিফ মাহতাব ২২ জানুয়ারি চাকরিচ্যুত হন। তাকে আর ক্লাস নিতে না যেতে মুঠোফোনে জানিয়ে দেয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। বিষয়টি নিয়ে উত্তপ্ত হয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। তাকে চাকরিতে পুনর্বহালের দাবি জানান কেউ কেউ।

জাতীয় শিক্ষক ফোরামের সেমিনারে শিক্ষক আসিফ মাহতাব বলেছিলেন, সপ্তম শ্রেণির পাঠ্যবইয়ে ট্রান্সজেন্ডারের গল্প ঢুকিয়ে শিক্ষার্থীদের মগজধোলাই করা হচ্ছে। পাঠ্যবইটি থেকে ‘শরীফ থেকে শরীফা’ গল্পের পাতাটিও ছিঁড়ে ফেলেন তিনি।


মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ