‘আমার মৃত্যুর জন্য দায়ী বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা’
‘আমার মৃত্যুর জন্য দায়ী বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা’- এই একটি লাইন যেন চিৎকার করে বলে দিল, কেমন একটি ব্যবস্থা আমরা গড়ে তুলেছি যেখানে একজন তরুণ ছাত্র জীবনের শেষ আশ্রয় খুঁজে পেয়েছে মৃত্যুর মধ্যে। ময়মনসিংহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের ধ্রুবজিৎ কর্মকারের আত্মহত্যা আমাদের সামনে শুধু একটি করুণ মৃত্যুর খবর নয়, এটি আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার এক নির্মম, অন্ধকার আয়নাঘরের সন্ধান দেয়। একটি তরুণ প্রাণের নিভে যাওয়া যেমন বেদনাদায়ক তেমনি তার সুইসাইড নোট আমাদের বিবেককে নাড়িয়ে দেয়- আমরা কি সত্যিই কোনো শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলেছি, নাকি কেবল একটি নম্বরনির্ভর মানসিক নিপীড়ন মেশিন?
ধ্রুবজিতের সুইসাইড নোটে লেখা- ‘এত চাপ আমার পক্ষে নেওয়া কোনোভাবেই সম্ভব ছিল না’- এই একটি লাইনই আমাদের গোটা শিক্ষাব্যবস্থার নির্মম চিত্র উন্মোচন করে দেয়। এটি কেবল ব্যক্তিগত এক ছাত্রের অসহায়ত্ব নয়, বরং একটি পচে যাওয়া, নিষ্ঠুর এবং সহানুভূতিহীন ব্যবস্থার বিরুদ্ধে এক আর্তচিৎকার। আমরা এমন এক শিক্ষাব্যবস্থা দাঁড় করিয়েছি, যেখানে শেখার আনন্দ নেই, কেবল আছে সার্বক্ষণিক উৎকণ্ঠা, ভয়, আর দমবন্ধ করে বাঁচার সংগ্রাম। এখানে শিক্ষার্থী যতটা না জ্ঞান অর্জনের জন্য সংগ্রাম করে তার চেয়েও বেশি লড়াই করে বেঁচে থাকার জন্য। পড়াশোনা যেন পরিণত হয়েছে এক নিষ্ঠুর রেসে, যেখানে একটুখানি পিছিয়ে পড়লেই তাকে গলা টিপে ধরে বলে দেয়া হয়- ‘তুমি ব্যর্থ, তুমি অযোগ্য, তুমি সমাজের বোঝা।’ এই ব্যবস্থা কি শিক্ষাদান করে, না কি মানসিক উৎপীড়নের লাইসেন্সধারী এক যন্ত্রের মতো শিক্ষার্থীদের চেতনা মেরে ফেলে?
ধ্রুবজিৎ পরীক্ষা দিতে গিয়ে নকলসহ ধরা পড়ে- এই তথ্য শুনে অনেকেই হয়তো সহজেই হাত ধুয়ে ফেলবেন: ‘ভুল করেছে, শাস্তি তো পেতেই হতো!’ কিন্তু এই প্রশ্নটিই কি আজ আমাদের সবচেয়ে বড় অমানবিকতায় পরিণত হয়নি? একজন তরুণ ছাত্র, যে দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রযুক্তি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করছিল, যার সামনে ছিল স্বপ্ন, ভবিষ্যৎ আর সম্ভাবনা- সে কি শুধুই ‘নকলকারী’ ছিল? নাকি সে ছিল এক মানসিকভাবে চাপে পিষ্ট তরুণ, যে প্রাতিষ্ঠানিক নির্যাতনের ভার বইতে না পেরে নিজের জীবনটাই শেষ করল?
কেন সে নকল করল- এই প্রশ্নটি আজ অবধি আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার কেউ করে না। নকল যে অপরাধ তা আমরা সবাই জানি; কিন্তু কীভাবে আমরা এমন এক ভয়াবহ মানসিক ও সামাজিক কাঠামো তৈরি করেছি যেখানে একবার ধরা পড়া মানেই চরম অপমান, সামাজিক কলঙ্ক, আত্মসম্মানহানি এবং জীবনের ইতি টানা? পরীক্ষা হল থেকে খাতা কেড়ে নেয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে একজন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করল- এটা কি কেবল ব্যক্তিগত দুর্বলতা, নাকি গোটা ব্যবস্থার অমানবিক নিষ্ঠুরতার প্রতিচ্ছবি?
ধ্রুবজিতের শাস্তি কীসের জন্য ছিল- একটি ভুল সিদ্ধান্তের, না কি সেই শিক্ষাব্যবস্থার হাতে, যেটি ছাত্রকে মানুষ নয়, ‘মেশিন’ বানাতে চায়? এই মৃত্যু আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে- আমরা কোথাও একজন ছাত্রের ‘মানুষ’ সত্তাটাকেই ভুলে গেছি। শ্রেণিকক্ষে, পরীক্ষার হলে, শিক্ষকের চোখে সে আর সহানুভূতির দাবি রাখে না- শুধু নিয়ম ভাঙার জন্য দণ্ডিত হবার যোগ্য এক দোষী। এই শাস্তি শুধু ধ্রুবজিতের জন্য নয়- এই শাস্তি আমরা সবাই পাচ্ছি, প্রতিদিন, প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে, নীরব অমানবিকতায়।
আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় ‘ভুল’ করা মানেই ‘অযোগ্য’ হয়ে যাওয়া, আর ব্যর্থতা মানেই লজ্জাজনক কলঙ্ক। ক্লাসরুমে ভুল শেখার জায়গা নেই- শুধু অপমান আর তিরস্কার অপেক্ষা করে। পরীক্ষায় খারাপ করলে কেউ সরাসরি ‘মরে যাও’ বলে না; কিন্তু যেভাবে শিক্ষক, সহপাঠী ও পুরো ব্যবস্থাটি আচরণ করে তাতে সেই বার্তাটিই নির্ভরযোগ্যভাবে পৌঁছে যায় শিক্ষার্থীর হৃদয়ে। একজন তরুণ নকল করলে, মানসিক চাপে ভেঙে পড়লে- আমরা কি তাকে মানুষ হিসেবে দেখি, নাকি একটি ত্রুটিপূর্ণ প্রোডাক্ট হিসেবে বাতিল করে দিই? আমরা তাকে একবারও জিজ্ঞেস করি না- কেন এমন হলো, সে কেমন আছে, তাকে সাহায্য করা যায় কি না? কাউন্সেলিং বা সহানুভূতি নয়, বরং অপমান, নিগ্রহ আর বহিষ্কারের ভয় তার ওপর চাপিয়ে দিই আমরা। তাহলে প্রশ্ন জাগে- আমরা কি সত্যিই মানুষ গড়ার চেষ্টা করছি, না কি শুধু নম্বরের কারখানায় রোবট তৈরি করছি? শিক্ষার প্রকৃত উদ্দেশ্য যদি হয় চরিত্র গঠন ও আত্মমর্যাদাবোধ জাগ্রত করা তবে আমাদের এই ব্যবস্থাটি কেবল সেই আদর্শের কবরখানা।
ধ্রুবজিৎ কর্মকারের মৃত্যুর পর হয়তো কয়েকদিন ফেসবুকে পোস্ট হবে, কিছু ‘দুঃখজনক’ শিরোনামে সংবাদ ছাপা হবে, দায়িত্ব এড়াতে এক-দুইটা তদন্ত কমিটিও গঠন হবে- তারপর? আমরা কি আবার আগের মতোই ভুলে যাব, সবকিছু ধামাচাপা দিয়ে শিক্ষাব্যবস্থার সেই নির্লজ্জ চক্রে ফিরব, যেখানে ছাত্র মানেই রোল নম্বর, রেজাল্ট শিট, ভুল করলে ‘দাগী অপরাধী’? প্রশ্ন হলো, এই মৃত্যুর পর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কি সত্যিই কাউন্সেলিং চালু হবে? শিক্ষকরা কি নিজ নিজ ‘অভিজাত’ অবস্থান থেকে নেমে এসে ছাত্রের চোখে চোখ রেখে সহানুভূতির হাত বাড়াবেন? নাকি আবার কোনো ধ্রুবজিৎ পরীক্ষার হলে ধরা পড়বে, পায়ে ধরে কাঁদবে, অপমানিত হবে আর আমরা বইয়ের পাতা ও পলিসি কোট করে বলব- ‘সে তো নিয়ম ভেঙেছিল?’
আমরা যেন ভুলে না যাই- শিক্ষা কেবল ডিগ্রি বা চাকরির সিঁড়ি নয়, এটি জীবন গঠনের হাতিয়ার। আর জীবনের শিক্ষা দিতে হলে প্রথমেই দিতে হবে ভুল করার অধিকার, ভেঙে পড়লেও নতুন করে দাঁড়াবার সাহস। আত্মহত্যা কোনো ব্যক্তিগত ব্যর্থতা নয়, এটি আমাদের সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং প্রাতিষ্ঠানিক নিষ্ঠুরতার সম্মিলিত পরিণতি। তাই যদি আমরা সত্যিই ধ্রুবজিতের মৃত্যুতে শোকাহত হই, তবে চোখ মুছে এখনই জবাব চাইতে হবে- এবং নিজেদেরও জবাবদিহির মুখোমুখি দাঁড় করাতে হবে।
প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তা বাধ্যতামূলক করতে হবে, যেখানে প্রতিটি শিক্ষার্থী জানবে- সে একা নয়, তার পাশে একজন ‘মানুষ’ শিক্ষক আছেন, পাহারাদার নয়। শিক্ষার্থী-শিক্ষকের সম্পর্ক আর যান্ত্রিক হবে না, হবে হৃদয়ের সংলাপ। একজন ছাত্র পরীক্ষার হলে নকল করলেই তার সব স্বপ্ন শেষ, এমন বার্তা নয়; বরং বলতে হবে- ‘তুমি ভুল করেছ; কিন্তু তুমিই ভবিষ্যৎ, আবার উঠে দাঁড়াও।’
ধ্রুবজিতের শেষ চিঠির একটাই বাক্য- ‘আমার মৃত্যুর জন্য দায়ী বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা’- এই বাক্য যেন জাতীয় আত্মজিজ্ঞাসার শিরোনাম হয়। আমরা চাই এমন এক দেশ, যেখানে কোনো শিক্ষার্থীকে আর কখনো এমন লাইন লিখে যেতে না হয়। যেখানে শিক্ষা মানে হবে মুক্তি, আত্মবিশ্বাস, ভালোবাসা- শুধু শ্বাসরুদ্ধকর চাপ নয়।
চিররঞ্জন সরকার: কলামিস্ট।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে