Views Bangladesh

Views Bangladesh Logo

ধূমপান নিয়ন্ত্রণে কার্যকর করারোপ একান্ত জরুরি

Dr. Nazmul Islam

ড. নাজমুল ইসলাম

শনিবার, ২৬ অক্টোবর ২০২৪

ধূমপান বিশ্বব্যাপী প্রতিরোধযোগ্য মৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ। বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রায় ১ লাখ ৬১ হাজার মানুষ সিগারেট এবং অন্যান্য তামাকজাত পণ্য ব্যবহারের কারণে মারা যায়। তামাকের ব্যবহার সব বয়সের এবং স্তরের মানুষকে প্রভাবিত করে। তবে, নিম্ন আয়ের মানুষের ব্যয়ের এক-পঞ্চমাংশই তামাক জাতীয় পণ্য ক্রয়ে ব্যয়িত হয়ে থাকে। এর বাইরেও তামাক ব্যবহারের কারণে সৃষ্ট রোগের চিকিৎসায় প্রচুর অর্থ ব্যয় হয়। সিগারেট থেকে যে পরিমাণ রাজস্ব আয় হয়, সে তুলনায় আমাদের ক্ষতির পরিমাণ কয়েক গুণ বেশি। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে বাংলাদেশে তামাকজাত পণ্য বিক্রির ওপর শুল্ক থেকে ২২ হাজার ৮১০ কোটি টাকা সংগ্রহ করা হয়; কিন্তু একই বছর তামাকজনিত রোগের কারণে চিকিৎসা খরচ ৩০ হাজার ৫৬০ কোটি টাকা ছিল।

এ ছাড়া কিশোর-তরুণদের সিগারেট ব্যবহারের প্রবণতাও বিশেষ দুর্ভাবনার বিষয়। কারণ আগামী প্রজন্মের এ নাগরিকদের স্বাস্থ্যগত ক্ষতি হলে তা পুরো জাতির ভবিষ্যতের জন্যই হুমকি হয়ে যায়। কম আয় শ্রেণির নাগরিক এবং কিশোর-তরুণরা স্বভাবতই বাজারের সবচেয়ে সস্তা সিগারেটগুলো ব্যবহার করে থাকে, যা বাজারে বেশ সহজলভ্য। তাই সিগারেটের ওপর উচ্চ বা কার্যকর কর এবং দামবৃদ্ধি যুব সমাজ এবং নিম্ন আয়ের মানুষকে সিগারেট কেনা থেকে নিরুৎসাহিত করবে। প্রতি বছর, জাতীয় সংসদে বাজেট আলোচনার সময়, সিগারেট কোম্পানিগুলো সিগারেটের দাম বৃদ্ধির কারণে তাদের এই শিল্পের ওপর চাপের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করে।

গত কয়েক বছরে জাতীয় বাজেট পর্যালোচনা করে দেখা যায় যে, সিগারেটের দাম যতটা বেড়েছে, তা খুব কার্যকরী নয়, কারণ এটি মুদ্রাস্ফীতির সঙ্গে সমন্বয় করা হয়নি। বরং, সিগারেট অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের তুলনায় আরও সাশ্রয়ী হয়ে উঠেছে, বিশেষ করে নিম্নশ্রেণির সিগারেট। সর্বশেষ পাঁচ অর্থবছরে সিপিআই মূল্যসূচক বেড়েছে ৩২ শতাংশ। অর্থাৎ একই পরিমাণ পণ্যের জন্য ২০১৯-২০-এর তুলনায় ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৩২ টাকা বেশি গুনতে হচ্ছে। অথচ আগে ১০০ টাকায় যে পরিমাণ নিম্নস্তরের সিগারেট পাওয়া যেত, এখন সে পরিমাণের জন্য দাম দিতে হচ্ছে ১২২ টাকা। অর্থাৎ গড়ে অন্যান্য পণ্যের তুলনায় সিগারেটের দাম (১৩২-১২২)=১০ শতাংশ কম বেড়েছে। অর্থাৎ নিম্নস্তরের সিগারেট বরং সহজলভ্য হয়েছে। আর নিম্নস্তরের সিগারেট সবচেয়ে সস্তা হওয়ায় কিশোর-তরুণ এবং কম আয়ের মানুষ প্রধানত এই স্তরের সিগারেটই ব্যবহার করে থাকে।

চলতি বছরের গড় মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশের কাছাকাছি। কাজেই কার্যকরভাবে সিগারেটের দাম বাড়াতে হলে প্রত্যেক স্তরের সিগারেটের দাম ১০ শতাংশের চেয়ে উল্লেখযোগ্য মাত্রায় বেশি করে বাড়ানো দরকার; কিন্তু বাজেটের প্রস্তাবনা অনুসারে সবচেয়ে বেশি বিক্রি হওয়া নিম্নস্তরের সিগারেটের দাম বাড়ানো হয়েছে মাত্র ১১ শতাংশ। অর্থাৎ এই স্তরের সিগারেটের প্রকৃত দাম বৃদ্ধি মাত্র ১ শতাংশ। অন্যদিকে মধ্যম, উচ্চ ও প্রিমিয়াম স্তরের সিগারেটের দাম বৃদ্ধি গড় মূল্যস্ফীতির তুলনায় কম হওয়ায় কার্যত এই তিন স্তরের সিগারেট আগের তুলনায় সহজলভ্য হবে। তামাকবিরোধী নাগরিক সংগঠনগুলো সিগারেটের দাম আরও বৃদ্ধি করে এগুলোর ওপর কার্যকরভাবে করারোপের পক্ষে দাবি বা প্রস্তাবনা দিয়েছিল।

প্রস্তাবনাগুলো বাজেটে আংশিকভাবে প্রতিফলিত হয়েছে, যদি তামাকবিরোধীদের ওই প্রস্তাবনাগুলো বাজেটে পূর্ণাঙ্গভাবে প্রতিফলিত হতো তবে আরও অনেক সুফল পাওয়া যেত। সিগারেটের কার্যকর করারোপ একই সঙ্গে সরকারের রাজস্ব বৃদ্ধি করবে এবং আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে এই ক্ষতিকর পণ্যের ব্যবহার থেকে বিরত রাখবে। সারা বিশ্বে এটি তামাকের ব্যবহার কমানোর পরীক্ষিত পদ্ধতি। উদাহরণস্বরূপ, নাইজেরিয়াতে সিগারেটের দাম বাড়ানোর ফলে সিগারেটের ব্যবহার কিছুটা কমলেও রাজস্ব বেড়েছে। ফলে এখানে সিগারেটের শুল্ক বাড়ানোর ফলে তামাকজনিত রোগ ও অকালমৃত্যু ঠেকানো সম্ভব হয়েছে। ২০১২ সালে গাম্বিয়াতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সহায়তায় সিগারেটের দাম বৃদ্ধি ও করারোপের ফলে ২০১৮ সালে রাজস্ব মাত্র ছয় বছরে তিনগুণ হয়েছে।

একই সঙ্গে সিগারেটের আমদানি কমেছে প্রায় ৬০ শতাংশ এবং ব্যবহারও উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে। কলাম্বিয়ার ২০১৬ সালে সিগারেটের শুল্ক তিনগুণ বাড়ানোর ফলে সিগারেটের ব্যবহার কমেছে ৩৪ শতাংশ, রাজস্ব বেড়েছে এবং সংশ্লিষ্ট চিকিৎসা ব্যয়ও কমেছে; কিন্তু বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতি বিবেচনায় না নিয়ে সিগারেটের শুল্কারোপের ফলে সিগারেটের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণের এই পরীক্ষিত পদ্ধতি প্রত্যাশিত ফল দিচ্ছে না। এই সুযোগে তামাক কোম্পানিগুলো তাদের ক্ষতিকারক পণ্য বাজারজাত করা অব্যাহত রাখতে নানা অপকৌশলের আশ্রয় নিচ্ছে। কিশোর-তরুণদের তামাকের প্রভাব থেকে সুরক্ষিত করার ক্ষেত্রে অন্যতম প্রতিবন্ধক হিসেবে দেখা হয় তামাক কোম্পানির বিভিন্ন অপপ্রচারমূলক তৎপরতাকে।

সিগারেটের দাম উল্লেখযোগ্য মাত্রায় বাড়িয়ে সেই বিক্রয়মূল্যের ওপর বেশি বেশি করারোপ করা গেলে সিগারেটের বিক্রি কমলেও ওই বিক্রি থেকে আগের থেকে বেশি কর আদায় করা সম্ভব। এ কারণেই এ বছর নিম্নস্তরের সিগারেটের ওপর সম্পূরক শুল্ক ৫৭ থেকে বাড়িয়ে ৬৩ শতাংশ করার কথা বলা হয়েছে। এতে কার্যকর মাত্রায় দাম বাড়ানোর পরও নিম্নস্তরের সিগারেট বিক্রি থেকে সরকার আগের তুলনায় বেশি কর পাবে। অন্যান্য স্তরের সিগারেটগুলোর বিক্রয়মূল্য যেহেতু উল্লেখযোগ্য মাত্রায় বাড়ানোর কথা বলা হয়েছে, তাই ওই সিগারেট বিক্রি থেকে পাওয়া মোট করও বাড়বে। মোট হিসাবে আগের বছরের তুলনায় ২৮ শতাংশ বেশি কর আদায় করা সম্ভব হবে।

যদি তামাকজাত পণ্যের ওপর কার্যকরভাবে কর আরোপ করা যায়, তাহলে তামাকের সামগ্রিক ব্যবহার কমবে এবং নতুন তামাক ব্যবহারকারীর সংখ্যাও কমানো সম্ভব হবে। শুধু তাই নয়, সিগারেটের ওপর কার্যকর কর আরোপের মাধ্যমে তামাকজনিত অকালমৃত্যুও প্রতিরোধ করা সম্ভব। তাই, সিগারেটে করারোপে নীতিনির্ধারকদের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেয়া উচিত, কারণ কার্যকর করারোপ শুধু সিগারেটের ব্যবহারের মাত্রা কমাতে সাহায্য করবে না, সঙ্গে এটি সরকারের রাজস্ব নীতি এবং জাতীয় বাজেটকেও উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি করতে পারে।

ড. নাজমুল ইসলাম: সহযোগী অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ