অবৈধ ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার বন্ধে উদ্যোগ প্রয়োজন
গত ৫৩ বছরে দেশের স্বাস্থ্য খাতের বিরুদ্ধে বড় অভিযোগ হচ্ছে ‘অব্যবস্থাপনা’। সত্যিকার অর্থেই দেশে এখনো আন্তর্জাতিক মানের পেশাদার স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা গড়ে ওঠেনি। শহর থেকে গ্রামের তৃণমূল পর্যন্ত একই দৃশ্য প্রতীয়মান। ভুল চিকিৎসার ভূত যেন আমাদের পিছু ছাড়ছেই না। ভুল চিকিৎসায় অকালে প্রাণ ঝরছেই। সুন্নতে খতনা করাতে গিয়ে ভুল চিকিৎসায় শিশু আয়ান ও আফনাফের হৃদবিদারক মৃত্যু দেশের চিকিৎসা-অব্যবস্থাপনার সাম্প্রতিক দুটো বড় উদাহরণ।
এসব দেখে মানুষ দেশের চিকিৎসা-ব্যবস্থার ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলছেন। ফলে দেখা যাচ্ছে যার সামর্থ্য আছে সাধারণ চিকিৎসার জন্যও এখন বিদেশে ছুটে যাচ্ছেন। মধ্যবিত্তরা যদি ভারতে যান, উচ্চবিত্তরা যান সিঙ্গাপুর, ধনীরা যান ইউরোপ-আমেরিকা। এতে একদিকে যেমন দেশের মুদ্রা বাইরে যাচ্ছে, আরেক দিকে দিন দিন দেশের চিকিৎসাব্যবস্থার প্রতি মানুষের অনাস্থা বাড়ছে। ফলে মানুষ ভালো সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, যা দেশের জন্য অত্যন্ত উদ্বেগজনক।
খবরে জানা গেছে, সম্প্রতি দেশের ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদক ও বিরোধী দলের মহাসচিব চিকিৎসার প্রয়োজনে বিদেশে গেছেন। চিকিৎসার প্রয়োজনে নেতাদের বিদেশ গমনও জনমনে দেশের চিকিৎসা-ব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন তোলে এবং অনাস্থা সৃষ্টি করে।
অথচ যে খাতটির সঙ্গে জীবন-মৃত্যু সম্পর্কিত সেই মৌলিক প্রয়োজনটি নিয়ে কেন এত অবহেলা? প্রিয়জনের মৃত্যু একটি পরিবারের জন্য অপূরণীয় ক্ষতি; কিন্তু এ দেশে মানুষের জীবন যেন গিনিপিগের মতো। নানা দুর্ঘটনায় মানুষ তো মরছেই অবিরত, তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে চিকিৎসা-সংক্রান্ত অবহেলা ও অব্যবস্থাপনা।
চিকিৎসার নামে গলা কাটা ডাকাতি এখন দেশে প্রতিষ্ঠিত সত্য। সরকারি হাসাপাতালগুলোতে রোগীর তুলনায় ডাক্তারের সংখ্যা খুবই কম, ফলে একজন রোগীকে প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম সময় দিয়ে থাকেন একজন ডাক্তার। এই সুযোগে ব্যাঙের ছাতার মতো দেশে গজিয়ে উঠছে অসংখ্য অবৈধ ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার। সংবাদমাধ্যমের সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে দেশে প্রায় অর্ধ লক্ষাধিক বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিক। এর মধ্যে মাত্র ১৫ হাজার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নিবন্ধনকৃত।
প্রশ্ন হচ্ছে, এসব অবৈধ হাসপাতাল, ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টার চলছে কী করে? উত্তরা সহজ। ওপরের চাপে। ওপরের চাপটা আসে কোত্থেকে তা অনেক সময় জানা যায় না। অনুমান করা যায় অদৃশ্য ক্ষমতার ছত্রছায়া ছাড়া এগুলো চলতে পারে না।
আশার কথা, সম্প্রতি স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. সামন্ত লাল সেন অবৈধ ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার বন্ধের অভিযান শুরু করেছেন। গত সপ্তাহেই স্বাস্থ্যমন্ত্রী জানিয়েছিলেন, এক মাসে সারা দেশে অভিযান চালিয়ে ১ হাজার ২২৭টি অবৈধ হাসপাতাল, ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টার বন্ধ করা হয়েছে। এ ব্যাপারে গত রোববার (৩ মার্চ) জেলা প্রশাসক সম্মেলনে জেলা প্রশাসকদের সহযোগিতাও চেয়েছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী।
আমরা মনে করি, স্বাস্থ্যমন্ত্রীর কথায় আশ্বাসবাণী থাকলেও এতে সংশয়ও কম নেই। কারণ, অবৈধ এসব প্রতিষ্ঠান বন্ধে মাঝে মাঝে অভিযান চলে। অভিযান শেষে কিছুদিন বন্ধও থাকে; কিন্তু পরে আবার চালু হয়। কখনো অন্য নামে, কোথাও আবার ঠিকানা বদল করে। অদৃশ্য ক্ষমতার চাপে বন্ধ করা যায় না সব অবৈধ হাসপাতাল ও ক্লিনিক।
অবৈধ হাসপাতাল, ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টার স্থাপনই যে দেশের চিকিৎসাব্যবস্থার একমাত্র অরাজক দিক তা নয়, এর সঙ্গে আছে ওষুধ কোম্পানিগুলোর দৌরাত্ম্য এবং সরকারি ডাক্তারদের অবহেলা। অভিযোগ আছে, উপজেলার সরকারি হাসপাতালগুলোতে বেশির ভাগ সময়ই ডাক্তার উপস্থিত থাকেন না। স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী ডা. রোকেয়া সুলতানও এ অভিযোগ স্বীকার করেছেন।
একটি বিষয় লক্ষণীয়, দেশের স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতির খবর প্রায়ই গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়। তাই স্বাস্থ্য খাতের মান উন্নয়নে প্রথমেই প্রয়োজন এ খাতকে দুর্নীতিমুক্ত করা। পাশাপাশি প্রয়োজন নিয়মিত গবেষণা, সঠিক কর্মপরিকল্পনা এবং নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করা। এ ক্ষেত্রে আমাদের অর্জনও কম নয়। তবে দেশের জনসাধারণের সামগ্রিক স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার ত্রুটিগুলো নিরসন করে দেশের সব ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের স্বচ্ছতা বজায় রাখা জরুরি।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে