ছেলেবেলার ঈদ
ঈদ আনন্দে কৃত্রিমতা চলে এসেছে
আমার মতো বয়সীদের কাছে আমাদের শৈশবের ঈদ এবং আজকের ঈদের মধ্যে আকাশ-পাতাল তফাত। ছোটবেলায় ঈদের সবচেয়ে বড় আনন্দ ছিল চাঁদ দেখা। এটা আজকাল উঠেই গেছে। সবাই দল বেঁধে ঈদের চাঁদ দেখার জন্য বাড়ির ছাদে গিয়ে জড়ো হতাম। তারপর কে চাঁদ আগে দেখেছে, এ নিয়ে ঝগড়া হতো ভাই-বোনদের মধ্যে।
আরেকটা বড় আনন্দের অনুষঙ্গ ছিল, ঈদে নতুন কাপড় পরা। আমাদের যুগে আজকালের মতো এমন রেডিমেড কাপড় (তৈরি পোশাক) ছিল না। সব বাড়িতে মায়েরা সেলাই করে ঈদ পোশাক তৈরি করে দিতেন। ওই পোশাক পরার মধ্যে অনাবিল আনন্দ ছিল। কারণ সেগুলো তৈরি হওয়ার পর ধুয়ে ইস্ত্রি করে বালিশের নিচে রেখে দিতাম, যাতে ঈদের দিন সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে গোসল করেই গায়ে দিতে পারি।
ঈদের পোশাক নিয়ে আরেকটু বলি, আমাদের সময় রেডিমেড কাপড়ের চল ছিল না। দর্জির দোকান থেকে কাপড় কিনে পোশাক বানানো হতো। দর্জির দোকানে পোশাক তৈরির সুযোগ থাকলেও সাধারণত বাড়িতে মা-বোনেরাও কাপড় সেলাই করে দিতেন। সে সময় প্রত্যেকের বাড়িতেই সিঙ্গার সেলাই মেশিন ছিল। তখন ছিল পায়ের মেশিন। হাতের মেশিনটাও ছিল। মূলত সিঙ্গার মেশিনে সেলাইয়ের কাজগুলো হতো। এ কাজগুলোর মধ্যে এক ধরনের আনন্দ ছিল, বিশেষ করে রমজান মাসে। রমজান মাসে রোজা যেমন ছিল, ইফতার যেমন ছিল, তেমনি ঈদকে কেন্দ্র করে ১৫ দিন আগে থেকে ঈদের প্রস্তুতি শুরু হয়ে যেত। বাড়িতে এক ধরনের উৎসবের আবহ বিরাজ করত। এখন তো রেডিওতে শুনে, টেলিভিশনে দেখে আমরা ঈদ করি।
আরেকটা আনন্দের বিষয় ছিল ঈদের জুতা। স্বাভাবিকভাবে আমাদের সারা বছরের জুতাটা কেনা হতো ঈদের সময়। সে সময় বাটার জুতা ছিল প্রসিদ্ধ। ছেলে-মেয়েরা বাটার জুতা ছাড়া অন্য জুতা কেনার কথা ভাবতেও পারতো না। সবার ধারণা ছিল, বাটার জুতা টেকসই।
আমাদের সময় ঈদে পাড়া-প্রতিবেশী ও আত্মীয়-স্বজনদের মধ্যে যাতায়াত ছিল। সালামি নেয়ার ব্যাপারটাও ছিল। এটা এখনকার সময়েও কিছুটা আছে; কিন্তু মনে হয় কৃত্রিমতা চলে এসেছে। আমাদের সময়ে যে আন্তরিকতা ছিল, সেটা এখন আছে বলে মনে করি না।
আমরা খুব ছোটবেলা থেকেই আব্বার সঙ্গে প্রতি ঈদে নামাজ পড়তে যেতাম। আমাদের পারিবারিক নিয়ম ছিল, আব্বার সঙ্গে প্রত্যেক ঈদের জামাতে যেতে হবে। আমরা সব সময় বরিশালে থাকিনি। আব্বার চাকরির সুবাদে দেশের বিভিন্ন জেলায় ঘুরে বেড়াতাম। সুতরাং সেখানে যেসব ঈদের মাঠ ছিল, সেখানে যেতাম। যেমন, আমি যখন ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিই তখন ঢাকায় ঈদ করেছিলাম। তখন আমরা মিন্টো রোডে থাকতাম। সে সময় রমনায় বর্তমান কাকরাইল মসজিদের জায়গায় ঈদের জামাত হতো। একটা উৎসবের আবহ থাকত।
আমাদের সময় ঈদের আরেকটা চল ছিল আচকান পরা। আমরা কিন্তু ছোটবেলায় আচকান পরেছি। যেটা এখন আবার হাল আমলের ফ্যাশন হিসেবে ফেরত এসেছে। সে সময় আচকান গায়ে দেয়ার খুব চল ছিল। আমরা দর্জির কাছে গিয়ে মাপ দিয়ে আচকান বানাতাম।
পোশাকসহ নানা বিষয়ে পরিবর্তন এলেও ঈদের খাবার অনেকটা একই আছে। তবে কিছু পরিবর্তনও এসেছে। এখনকার দিনে সেমাই তো বাইরে থেকে কেনা হয়, আমাদের সময় বাড়িতে সেমাই হাতে বানানো হতো। তখন ঈদের সময় এক ধরনের মেশিন পাওয়া যেত। হাতে ঘোরানো মেশিন। তা দিয়ে সেমাই বানানো হতো। ঈদ মানেই সেমাই আর ফিরনি। আমার মা খুব ভালো ফিরনি বানাতে পারতেন। ঈদের দিনের ফিরনি আমাদের খুব প্রিয় ছিল। এ ফিরনিটা এখন দোকান ছাড়া আর খুব একটা দেখি না।
আমরা যখন বড় হলাম, আমাদের সবার আলাদা পরিবার হলো তখন প্রতি ঈদে সব ভাই-বোন বাসায় আসত, যারা বাইরে পড়াশোনা করত, তারাও আসত। অর্থাৎ পারিবারিক মিলনমেলা হতো। পরে যখন আব্বা অবসরে যান, তখন আমাদের নিয়ম ছিল প্রতি ঈদে আব্বার সঙ্গে দেখা করতে যেতে হবে। সেখানে আমরা সব ভাই-বোন একত্র হতাম। এটা আমাদের পারিবারিক প্রচলিত নিয়ম ছিল। এটা এখনো চালু আছে। এখন তো আব্বা নেই। এখন আমরা এক ভাইয়ের বাসায় বা এক বোনের বাসায় ঈদের দিন মিলিত হই, সব ভাই-বোন মিলে। আমরা আট ভাই ও পাঁচ বোন। আমাদের পরিবার বেশ বড়।
লেখক: বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ ও সভাপতি, ওয়ার্কার্স পার্টি
অনুলিখন: রাহাত মিনহাজ
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে