ভারতের নির্বাচনি ফল বহুমাত্রার সাংস্কৃতিক পরিচয়
বিশ্বের জন্য সবচেয়ে ব্যস্ত নির্বাচনি বছর ২০২৪। বিভিন্ন মহাদেশে আমরা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে দেখছি। ভূ-রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ এমন কয়েকটি দেশেও নির্বাচন হচ্ছে; কিন্তু আমাদের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, তাৎপর্যপূর্ণ নিঃসন্দেহে ভারতের নির্বাচন। এই নির্বাচনের ফল প্রকাশের দ্বারপ্রান্তে আমরা। বহুমাত্রার এ নির্বাচন আমাদের ওপরও বহুমুখী প্রভাব ফেলবে।
পৃথিবীর সবচেয়ে বড় গণতান্ত্রিক দেশের নির্বাচনের গুরুত্ব নানা দিকেই। ভারতের মোট জনসংখ্যা ১৪০ কোটি । এর মধ্যে ৯৭ কোটি ভোটার। ১৯ এপ্রিলে শুরু হয়ে ৭ দফায় দেড় মাস ধরে ভোটগ্রহণের আনুষ্ঠানিকতা ১ জুন শেষ হয়। শুরু থেকেই প্রচারিত হচ্ছিল মোদি আবার ক্ষমতায় ফিরে আসছেন। এই লেখা যখন লিখছি (৪ জুন, বিকেল নাগাদ) শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত জানা গেছে মোদি আবার ক্ষমতায় আসছেন বটে, তবে ২৭২ আসনের একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা বিজিপি আর পাচ্ছে না। কংগ্রেস এবং তার মিত্ররা নির্বাচনের ফলে এগিয়ে থাকার কারণে এবার জোট সরকার গঠনের সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে।
এবারের নির্বাচনের ফলে ভারতীয় রাজনীতির বিভিন্ন প্রভাব দৃশ্যমান। এর রাজনৈতিক বিবর্তন, প্রতিবেশীদের সঙ্গে এর সম্পর্কগত প্রভাব এবং বিশ্বব্যাপী ভারতের অবস্থানও এবারের ফলে ফুটে উঠছে। কে হারবে আর কে পরাজিত হবে এর চেয়ে বেশি এবারের নির্বাচনে প্রধান আলোচনার বিষয় ছিল নির্বাচনে কতখানি অখণ্ডতা থাকবে তা নিয়ে। নির্বাচন সুষ্ঠু ও অবাধ হয়েছে কি না, তা নিয়েও কম বিতর্ক হয়নি। নির্বাচনের প্রচারের ঠিক আগে আগে নির্বাচন কমিশন যেভাবে গঠিত হয়েছে, প্রয়োজন অনুযায়ী পরিবর্তন আনা হয়েছে। তা নিয়ে অসংখ্য প্রশ্ন ও বিতর্কের পরিপ্রেক্ষিতে এটা স্পষ্ট যে, নির্বাচনের লক্ষ্য ছিল ধর্ম ও সুশাসন রক্ষার লড়াই।
এই নির্বাচনের আরেকটি বিরাট আলোচনার বিষয় নির্বাচন-সংক্রান্ত বা জাতীয় কোনো ইস্যু নয়, বরং এই নির্বাচনের প্রধান চরিত্র কে পালন করছেন তা নিয়ে। ৭৩ বছর বয়সি নরেন্দ্র মোদিকে নিয়েই আলোচনা হয়েছে বেশি। ভারতের অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ২০১৪ সালে তিনি ক্ষমতায় এসেছিলেন; কিন্তু ক্ষমতায় এসে রাজনীতি ও ধর্মকে তিনি এক করে ফেলেছেন।
এই পদ্ধতির কারণে দিন দিন হিন্দু জাতীয়তাবাদীদের মধ্যে তার জনপ্রিয়তা বেড়েছে বটে, কিন্তু প্রতিশ্রুত অর্থনৈতিক উন্নয়ন পুরোপুরি বাস্তবায়ন করতে ব্যর্থ হয়েছেন। মোদির নেতৃত্বে একদিকে বিশ্বমঞ্চে ভারতের প্রভাব বেড়েছে, অন্যদিকে দেশে বেড়েছে বেকারত্বের হার। তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনা। বিশেষ করে হিন্দুত্ববাদী আক্রমণের ফলে মুসলমানদের ওপর নিপীড়নের ঘটনা বেড়েছে। এসব ঘটনা ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। তাই মিডিয়ার স্বাধীনতা, বাক স্বাধীনতা এবং ভিন্নমত প্রকাশের স্বাধীনতাও ধীরে ধীরে হ্রাস পেয়েছে। সাম্য, ন্যয্যতা, রাষ্ট্রযন্ত্রের সম-ক্ষমতায়নের প্রশ্নগুলো ভারতীয় রাজনীতির কেন্দ্রীয় বিষয়, প্রধানমন্ত্রী মোদির প্রভাবে যা ক্ষুন্ণ হয়েছে। মোদি তার আরএসএস, বিজেপি এবং অভিজাত গোষ্ঠীকে অনেকরকম বেআইনি সুবিধা ভোগ করার সুযোগ দিচ্ছেন।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিরোধী দল কংগ্রেসের সদস্যদের এবং অন্য দলগুলোর সদস্যদের দুর্নীতি প্রমাণ করতে সরকার প্রভাবিত কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থাগুলোর প্রচেষ্টার কোনো কমতি ছিল না; কিন্তু বিজিপির বেলায় তারা অন্ধ ছিল। উদ্দেশ্য পরিষ্কার। ২০২৪ সালের নির্বাচনের পথ মোদির জন্য যতটা সম্ভব পরিষ্কার রাখা। বিজিপির প্রার্থীদের অ-প্রতিদ্বন্দ্বী রাখা। গত দুই মেয়াদে ক্ষমতায় থাকার সময় বিজিপি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোতে দুর্বল করে ফেলেছে। দলের একমাত্র প্রতীকে পরিণত হয়েছেন মোদি স্বয়ং। দলটি আগামীতে কেবল ধর্মের নামে চলবে বলেই আশঙ্কা করা যাচ্ছে। নির্বাচনি প্রচারে তাদের মূল এজেন্ডা ছিল এটিই।
মোদি সরকার যে সব খারাপ করেছে তা নয়, কিছু ভালো দিক আছে। ভারত এখন বিশ্বের একটি গুরুত্বপূর্ণ পরাশক্তিতে পরিণত হয়েছে। দেশের অর্থনীতির আকার প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। দেশের শেয়ারবাজারের আকার বেড়েছে তিনগুণ; কিন্তু এসব সুবিধার বেশির ভাগই ভোগ করেন বিদেশে বসবাসকারি উচ্চবিত্ত ও সচ্ছল অস্থায়ী ভারতীয়রা, যাদের অধিকাংশই আবার দ্বৈত নাগরিকত্ব ধারণ করে। এত উন্নতি সত্ত্বেও ভারতের প্রায় ৯০ শতাংশ লোকের বার্ষিক আয় মাত্র ৩ হাজার ৫০০ মার্কিন ডলারে নিচে।
মোদি সরকারের অধীনে অনেক সমাজকল্যাণমূলক সরকারি কর্মসূচি চালু করা হয়েছে, যা প্রত্যন্ত গ্রামীণ এলাকায় জীবনমানকে আরও সহনীয় করে তুলেছে। কিন্তু এসব কর্মসূচি সরকারি কোষাগারে যতটা চাপ ফেলেছে ততটা কর্মসংস্থান বাড়াতে কাজে লাগেনি। এর বেশির ভাগই ছিল স্বজনপ্রীতির আওতায়। অনেক মানবাধিকার ও নাগরিক অধিকার হ্রাস করা হয়েছে। জনসাধারণের ওপর অর্থনীতির চাপ বাড়িয়েছে। সংখ্যালঘুদের ওপর নিপীড়ন সৃষ্টি করেছে।
ওপরে উল্লিখিত পরিস্থিতিগুলোর জন্য মোদি আন্তর্জাতিকভাবেও সমালোচিত হয়েছেন। এবার বিজিপি সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে বিজয়ী হলে কী হবে তা নিয়ে অনেকেই উদ্বিগ্ন ছিলেন। হিন্দুত্বভিত্তিক জাতীয়তাবাদী প্রচার এবং জনপ্রিয়তাবাদী আখ্যান তাদের তুরুপের তাস হয়ে ওঠে। এর মধ্য দিয়ে প্রতিযোগীদের তারা ভালোই এগিয়ে রাখেন। তবে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা তো দূরের কথা, সংখ্যাগরিষ্ঠতা থেকেই তাদের বঞ্চিত করে।
এটি মোদি এবং তার দলের জন্য খারাপ খবর। কারণ এখন যে কোনো আইন পরিবর্তন করতে হলে তাকে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হবে। অভিজাত দলীয় লোকজনের দাবি অনুযায়ী হিন্দু জাতীয়তাবাদী এজেন্ডা বাস্তবায়ন আর ততটা সহজ হবে না। বিশ্বের আস্থা সৃষ্টি করতে হলেও ক্রমাগত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি প্রয়োজন। ভারতীয় রাজনৈতিক পরিস্থিতির জন্য এটি হয়তো কিছুটা ভালো খবর। বিশেষ করে সংখ্যালঘুদের জন্য। কিন্তু ভারতীয় অর্থনীতির ওপর বিনিয়োগকারীদের এখন পর্যন্ত যে-আস্থা তা বোধহয় কিছুটা কমবে এবার।
দক্ষিণ এশিয়ার পুরো অঞ্চলজুড়েই এই নির্বাচনের প্রভাব রয়েছে। দক্ষিণ এশিয়া এখন ভারত ও চীনের লড়াইক্ষেত্র। বেশির ভাগ অঞ্চলই প্রতিযোগিতার বলয় হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে আমি বলব যে, এই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের পরিস্থিতি শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ, নেপাল এমনকি ভুটানের মতো ভয়াবহ নয়। ভারতকে ছাপিয়ে চীনের অর্থনৈতিক সহায়তা এবং আর্থিক আধিপত্য এখানে প্রভাব বিস্তার করতে চাচ্ছে। রাজনৈতিক দলগুলোও খোলাখুলি চীনের পক্ষেই গুণগান গাইছে।
মালদ্বীপ যেখানে ভারতবিরোধী স্লোগান দিচ্ছে, বাংলাদেশেও তেমন ভারত ও ভারতীয় পণ্য বয়কটের স্লোগানের প্রতিধ্বনি শোনা যাচ্ছে। কিন্তু, তা এখনও কার্যকর কোনো উদ্যোগে রূপান্তরিত হয়নি। ভারতীয় নির্বাচনের মাধ্যমে বাংলাদেশের উপর কীরকম প্রভাব সম্পর্কে নিচের অনুচ্ছেদগুলোতে আরও কথা বলব। সামগ্রিক দক্ষিণ এশিয়ার ক্ষেত্রে, ভারতকে একটি দুষ্ট প্রতিবেশীতে পরিণত করেছেন প্রধানমন্ত্রী মোদি। দক্ষিণ এশিয়ার বাকি রাষ্ট্রগুলো যাকে অবাঞ্ছিত আত্মীয় হিসেবে দেখে। দূর থেকে যার প্রশংসা করে বটে; কিন্তু যতটা পারে তাকে এড়িয়ে চলে; কিন্তু এই অঞ্চলে গঠনগত কারণে, ভূ-রাজনীতি, ভূ-অবস্থান এবং আর্থ-রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রভাবের কারণে ভারতের প্রভাব পুরোপুরি এড়িয়ে যাওয়া যায় না। মোদির ক্ষমতায় ফিরে আসা পরিস্থিতির কোনো উন্নতি করবে না, বরং নতুন শাসনামলে তার সরকারের দুর্বলতা সম্ভবত চীনকে আরও জায়গা করে দেবে। প্রতিবেশী অঞ্চলে তার অবস্থানকে মজবুত করতে যা বেইজিংকে আরও সহায়তা করবে।
বাংলাদেশের জন্য অবশ্য মোদি সরকার অন্তত রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে ভালোই হয়েছে। অন্য দিকে আমি অবশ্যই বলব, গণপর্যায়ে ভারতবিরোধিতা অনেকটা ভারত-বিদ্বেষে রূপ নিয়েছে। আমাদের সবচেয়ে কাছের প্রতিবেশীর প্রতিই আমাদের লোকজন যে তীব্র বিদ্বেষ পোষণ করে উল্লেখ করার মতো। ভারত বিরোধী মনোভাব কয়েক দশক ধরে বাংলাদেশে বেড়েই চলেছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তা চরমে পৌঁছেছে।
একই সঙ্গে এ-কথাও বলতে হয়, দুই দেশের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক এবং অর্থনৈতিক অংশগ্রহণও যথেষ্ট বৃদ্ধি পেয়েছে। এই প্যারাডক্সটি অনেকটা ধর্মের লেন্সের ভেতর দিয়ে বোঝা যায়, কারণ মোদির মুসলিম বিরোধী অবস্থান এবং কাজগুলি প্রকৃতপক্ষে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলাদেশের জন্য ক্ষতিকর হয়েছে, যাদের কাছে ধর্ম অনেক বড় বিষয়। বাংলাদেশে হিন্দু উগ্রবাদের কিছু ঘটনা ঘটেছে এমন উদাহরণও রয়েছে। এই ধরনের অনুভূতি সোশ্যাল মিডিয়ায় দ্রুতগতিতে বেড়েছে বলে জানা গেছে। এটি শুধুমাত্র হিন্দুত্ববাদী জনপ্রিয়তাকামী জাতীয়তাবাদের নামে মোদির হিন্দু ক্ষমতায়নের কারণেই নয়, বরং বাংলাদেশেই একপ্রকার ধর্মান্ধতা বেড়ে যাওয়ায়। বাংলাদেশের সংখ্যালঘু হিন্দু জনগোষ্ঠীও সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম জনগোষ্ঠীর কাছে এরকম অনিরাপত্তা বোধ করেন।
সুতরাং, ভারতের নির্বাচনে ফলাফল যাই হোক না কেন, ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের বিরূপ প্রভাব পড়ার সম্ভাবনা কম। তবে, একজন দুর্বল মোদি অবশ্যই ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলির ওপর তার চাপ কমাবেন, যারা বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভারতীয় প্রভাবকে তাদের ধর্মীয় পরিচয়ের জন্যও হুমকি হিসাবে দেখে।
পরিশেষে, এটা অবশ্যই বলা উচিত যে, মোদির ক্ষমতায় ফিরে আসা ভারতের বৈশ্বিক অবস্থার জন্য সহায়ক হবে। ভারতের পরিবর্তনশীল চরম হিন্দুত্ববাদী রাজনীতিতেও এটা অন্যরকম প্রভাব ফেলবে। কারণ ভারতের প্রতি বিশ্বাসীর শ্রদ্ধা এর বহুত্ববাদ ও বৈচিত্র্যের জন্য। বহু মত-পথ নিয়েও এর সহনশীলতার জন্য। মোদি যে চোখ ধাঁধানো সংখ্যাগরিষ্ঠতায় জয়ী হতে পারলেন না এটা ভারতীয় সংস্কৃতির বহুমুখী, বহুমাত্রাকে ইঙ্গিত দেয়। এতে এই বোঝা যায় যে, মোদির প্রচারণাগুলো, তার নীতিগুলো আর আগের মতো জনপ্রিয় নেই। তার ক্যারিশমা কমে যাচ্ছে। একটি রক্ষণশীল জাতীয়তাবাদী ভারত সমগ্র ভারতের জন্য কাম্য নয়। এতে কতিপয় নির্বাচিত প্রতিনিধিই কেবল সুবিধা পেতে পারে। এবারের নির্বাচনি ফল এটাই স্পষ্ট করছে যে, ভারত বহুমাত্রার সাংস্কৃতির এক দেশ হিসেবেই থাকতে চায়।
লেখক: রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিকবিষয়ক বিশ্লেষক।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে