Views Bangladesh

Views Bangladesh Logo

বিদ্যুৎ মানুষের জীবনমানের সব সূচক বদলে দিয়েছে

Engineer Mohammad Hossain

প্রকৌশলী মোহাম্মদ হোসাইন

বৃহস্পতিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৩

বিদ্যুৎ বিভাগ শতভাগ মানুষের ঘরে বিদ্যুতের আলো পৌঁছে দিয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশই প্রথম শতভাগ বিদ্যুতায়নের মাইলফলক অতিক্রম করেছে। এজন্য বিদ্যুতের উৎপাদন, বিতরণ এবং সঞ্চালন তিন খাতেই চলেছে ব্যাপক কর্মযজ্ঞ। বিদ্যুৎ বিভাগ সাধুবাদ যেমন পেয়েছে, তেমন সমালোচনাও কম হয়নি। বিদ্যুৎ বিভাগের নীতি নির্ধারণী গবেষণা প্রতিষ্ঠান পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক, আন্তর্জাতিক জ্বালানি বিশেষজ্ঞ, চেয়ারম্যান, আইইবি, ঢাকা সেন্টার প্রকৌশলী মোহাম্মদ হোসাইন এর সঙ্গে এসব বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন ভিউজ বাংলাদেশের সিনিয়র রিপোর্টার মামুন-অর-রশিদ

ভিউজ বাংলাদেশ: শতভাগ মানুষের ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে গেছে, এ অর্জনকে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
প্রকৌশলী মোহাম্মদ হোসাইন:
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা সরকারের নির্বাচনী অঙ্গীকার ছিল সবার ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেয়া। আমরা পাহাড়, বিচ্ছিন্ন দীপসহ দুর্গম চরাঞ্চলের মানুষের ঘরেও বিদ্যুৎ পৌঁছে দিয়েছি। একই দেশে বাস করে কেউ বিদ্যুৎ পাবেন আর কেউ পাবেন না, আমরা এ প্রথা ভেঙে সব মানুষের ঘরে বিদ্যুৎ সুবিধা নিশ্চিত করেছি। এখন সব মানুষ সমঅধিকার ভোগ করছে। মানুষ বিদ্যুৎ দিয়ে শুধু ঘরের আলো জ্বালায় কিংবা পাখা ঘুরায় না। বিদ্যুৎ মানুষের জীবনমানের সব সূচক বদলে দিয়েছে। কর্মসংস্থানে সহায়ক হয়েছে। দেশে এখন এমন কোনো এলাকা নেই, যেখানে কৃষিভিত্তিক শিল্প স্থাপন সম্ভব নয়। এই পরিবর্তনকে খাটো করে দেখার কোনো অবকাশ নেই।

ভিউজ বাংলাদেশ: সারা দেশে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেয়া হয়েছে; কিন্তু এই বিদ্যুৎ কতক্ষণ থাকে, তা নিয়ে নানা ধরনের সমালোচনা রয়েছে।
প্রকৌশলী মোহাম্মদ হোসাইন:
একটা সময় মানুষের মুখে মুখে একটি কথা ছিল, ‘বিদ্যুৎ কখন আসবে?’ আর এখন বিদ্যুৎ যাওয়াটাই মানুষ সহজভাবে নিতে পারে না! তখন প্রতিদিন ৮-১০ ঘণ্টা লোডশেডিংয়ের কবলে পড়ে জনজীবন ছিল পর্যুদস্ত। বর্তমানে গোটা পৃথিবী একটি অস্থির সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। রাশিয়া-ইউক্রেন সংকটের কারণে বিশ্বের জ্বালানি সরবরাহ পরিস্থিতি টালমাটাল পরিস্থিতি অতিক্রম করছে। সরকার প্রতিদিন ব্যবহারের জ্বালানির মধ্যে একটি বড় অংশ আমদানি করে থাকে, এজন্য বিদ্যুৎকেন্দ্রের জ্বালানি আমদানিতে গ্রীষ্মে কিছুটা সংকট ছিল; কিন্তু সেটি কখনো সহ্যসীমার বাইরে যায়নি বরং বিশ্ব জ্বালানি পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে সরকার জনগণকে জানিয়েছে কেন এই সমস্যা। এই পরিস্থিতি সাময়িক।

ভিউজ বাংলাদেশ: সমালোচনা রয়েছে বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধি করতে গিয়ে আমরা অপ্রয়োজনীয় অনেক কেন্দ্র নির্মাণ করেছি। বিষয়টিকে আপনি কীভাবে দেখেন?
প্রকৌশলী মোহাম্মদ হোসাইন:
বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ একটি কারিগরি সমীক্ষার বিষয়। কোথায় কেন কেন্দ্র নির্মাণ করা হচ্ছে, তার একটি কারিগরি সমীক্ষা করা হয়। বিদ্যুতের সর্বোচ্চ চাহিদাকে এবং কেন্দ্রগুলোর নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণকে মাথায় রেখে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ রিজার্ভ মার্জিন রেখে বিদ্যুতের উৎপাদন পরিকল্পনা করা হয়। অন্যদিকে জ্বালানির সীমাবদ্ধতার কথা মাথায় রেখে আমাদের চাহিদার থেকে কিছুটা বেশি বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করতে হয়। উদাহরণস্বরূপ উত্তরবঙ্গের কথাই ধরা যাক- সেখানে জ্বালানি পরিবহন জটিলতার কারণে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ সীমিত ছিল। ফলে অনেক দূর থেকে উত্তরবঙ্গে বিদ্যুৎ পৌঁছে দিতে হতো। এতে ভোল্টেজ লেভেল নেমে যেত। এখন সেখানে জ্বালানির সরবরাহ সহজ হওয়ার ফলে যদি একটি কেন্দ্র নির্মাণ করা হয়, তাহলে আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে এত ক্যাপাসিটি থাকার পরেও কেন্দ্রটি নির্মাণ যৌক্তিক নয়; কিন্তু কারিগরি দিক বিবেচনা করলে কেন্দ্র নির্মাণের কোনো বিকল্প থাকছে না। আমাদের গ্রীষ্মের সর্বোচ্চ চাহিদা বিবেচনা করে কেন্দ্র নির্মাণ করতে হয়েছে। অন্যদিকে আমাদের সেচ মৌসুম এবং গ্রীষ্মকাল একই সময়ে। ফেব্রুয়ারির শেষ থেকে এপ্রিল পর্যন্ত গ্রীষ্মেও সেচের কাজে অতিরিক্ত বিদ্যুতের চাহিদা থাকে। ফলে আমরা সেচে নিবরচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ ও গ্রাহকের বিদ্যুৎ চাহিদা পূরণে লোডশেডিং করতে পারি না। যখন এসব বিষয়ে কথা বলা হয়, তখন এসব দিক বিবেচনায় থাকে না বলে আমি মনে করি।

ভিউজ বাংলাদেশ: এখন দিনে এবং রাতে বিদ্যুতের চাহিদার খুব বেশি পরিবর্তন হয় না কেন?
প্রকৌশলী মোহাম্মদ হোসাইন:
বিদ্যুৎ সুবিধা পাওয়ার ফলে মানুষ এখন দিন-রাত কর্মমুখর থাকে। রাতে লাইট-ফ্যান ছাড়াও অন্যান্য অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের জন্য বিদ্যুতের ব্যবহার বৃদ্ধি পেয়েছে। এটি বিদ্যুৎ ব্যবহারের একটি নতুন দিক। অন্যদিকে গ্রামে এবং শহরে প্রচুর পরিমাণ ইজিবাইক এবং ব্যাটারিচালিত রিকশা ব্যবহার হচ্ছে। এই বাস্তবতাকে আমরা অস্বীকার করতে পারি না। এতে মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে। এসব ইজিবাইক মধ্যরাতেই চার্জ দেয়া হয়। এজন্য সারা রাতই বিদ্যুতের চাহিদা থাকে। ফলে এখন আমরা কি চাইলেই এগুলো বন্ধ করতে পারব। যেহেতু ব্যাপক মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হয়েছে, তাই এগুলো বন্ধ করাও উচিত নয়। এগুলোকে কীভাবে আরও উন্নত করা যায়, কীভাবে ইলেকট্রিক ভেহিক্যালকে আরও উন্নত করা যায় সে চেষ্টা করা উচিত। ইতোমধ্যে টেকসই নবায়নযোগ্য জ্বালানি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (স্রেডা) একটি নীতিমালা করেছে। এক কিলোমিটার গাড়ি পেট্রোল বা অকটেনে চলতে ১০ থেকে ১২ টাকা খরচ হয়। সেখানে বৈদ্যুতিক গাড়ি চলতে খরচ হয় মাত্র ৫০ পয়সা থেকে এক টাকা। শুধু সাধারণ মানুষের সাশ্রয় হবে তাই নয়; সরকারকে যদি ডিজেল এবং পেট্রোল আমদানি কম করতে হয়, তাহলে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রাও বেঁচে যাবে, যা আমাদের অর্থনীতির জন্য ভালো বিষয় হতে পারে।

ভিউজ বাংলাদেশ: বিদ্যুৎকেন্দ্রের ক্যাপাসিটি পেমেন্ট দেয়া নিয়ে নানারকম সমালোচনা রয়েছে। বিষয়টিকে কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন?
প্রকৌশলী মোহাম্মদ হোসাইন:
সমালোচনা করার আগে ক্যাপাসিটি পেমেন্ট কি সেটা বুঝতে হবে। বিদ্যুৎ বিলের দুটি অংশ থাকে, যার মধ্যে একটি অংশ হচ্ছে ক্যাপাসিটি পেমেন্ট অন্যটি হলো জ্বালানি ব্যয়ের অংশ। একজন উদ্যোক্তা কেন্দ্র নির্মাণ করার সময় যে অর্থ বিনিয়োগ করেন, সেই বিনিয়োগকৃত অর্থ ফেরত দেয়া হয় ক্যাপাসিটি চার্জের মাধ্যমে। এখন উদ্যোক্তা যদি কেন্দ্র নির্মাণ করে তার বিনিয়োগ ফেরতের জন্য নিশ্চয়তা না পায়, তাহলে কেউ কি বিনিয়োগ করবেন? এটি যে শুধু বেসরকারি কেন্দ্রগুলোকেই দেয়া হয় তা নয়, এটি সরকারি কেন্দ্রগুলোর জন্যও প্রযোজ্য। সরকারি কোম্পানিগুলোতে আই আর আর (IRR) হিসেবে দেখানো হয়। যারা সমালোচনা করেন, তারা কি দেখাতে পারবেন পৃথিবীর কোথাও ক্যাপাসিটি পেমেন্ট বা আই আর আর (IRR) ছাড়া কোনো বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ হয়েছে? কাজ করতে গেলে সমালোচনা হওয়াটা স্বাভাবিক, হবেই। তবে জেনে, বুঝে সমালোচনা করা উচিত, না জেনে, না বুঝে নয়।

ভিউজ বাংলাদেশ: বিদ্যুৎ জ্বালানি দ্রুত সরবরাহ আইনটি রেখে দেয়াটা কি এখনো খুব বেশি যৌক্তিক?
প্রকৌশলী মোহাম্মদ হোসাইন:
কোনো বিশেষ কারণে বিদ্যুৎ বা জ্বালানির যে কোনো স্থাপনা নির্মাণের প্রয়োজন দেখা দিলে এই আইনটির মাধ্যমে যাতে দ্রুত প্রক্রিয়াগুলো শেষ করা যায়, সে জন্য এটি রাখা হয়েছে। যেমন আগে একটি কেন্দ্র নির্মাণ শুরু করতে অন্তত তিন বছর সময় লেগে যেত। কেন্দ্রের জন্য দরপত্র, ডিজাইন, অর্থায়নে এই সময় লেগে যেত, এখন এর অর্ধেক সময়ে কেন্দ্র উৎপাদনে চলে আসে। বিদ্যুৎকেন্দ্রের ট্যারিফ বা দর নির্ধারণের জন্য সরকারের শীর্ষ ব্যক্তিদের নিয়ে একটি কমিটি রয়েছে। কমিটি এর আগের টেন্ডারের দর বিবেচনায় নিয়ে আরও কীভাবে কমানো যায়, তা নেগোশিয়েশনের মাধ্যমে নির্ধারণ করে। ফলে এককভাবে কেউ প্রভাব খাটিয়ে সিদ্ধান্ত দেয়ার কোনো সুযোগ নেই। এই আইনটি না থাকলে এত দ্রুত বিদ্যুৎ পরিস্থিতি বদলাতো না বলে আমি মনে করি।

ভিউজ বাংলাদেশ: বিদ্যুৎ খাতের বেসরকারি অংশগ্রহণের ২৫ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। আপনারা বিদ্যুৎ সঞ্চালনেও বেসরকারি অংশগ্রহণের কথা বলে আসছিলেন। সঞ্চালন এবং বিতরণে যদি বেসরকারি অংশগ্রহণ থাকে, তাহলে ভালো সেবা পাওয়া যায়? এ বিষয়ে আপনার বক্তব্য জানতে চাই।
প্রকৌশলী মোহাম্মদ হোসাইন:
বাংলাদেশের বিদ্যুৎ খাতে বেসরকারি কোম্পানিগুলো ভালো করছে। উৎপাদনের প্রায় অর্ধেকই আসে বেসরকারি খাত থেকে। আমরা সঞ্চালনের ক্ষেত্রে বেসরকারি অংশগ্রহণের জন্য একটি নীতিমালার খসড়া তৈরি করেছি। বিষয়টি এখন সরকারের বিবেচনায় রয়েছে। তবে বিতরণে এখনো কোনো বেসরকারীকরণের চিন্তা সরকার করছে না। যদিও বিশ্বের বিভিন্ন দেখে বেসরকারি বিতরণ ব্যবস্থা রয়েছে। অনেক প্রতিষ্ঠান একই কাজ করলে মানুষ যার কাছ থেকে ভালো সেবা পায়, তার কাছ থেকেই সেবা নিয়ে থাকে। তবে আমাদের অর্থনীতির জন্য বিষয়টি কতটা ভালো তাও বিবেচনা করতে হবে। এখনো আমাদের বিদ্যুৎ উৎপাদনের একটি বড় অংশ সরকার ভর্তুকি হিসেবে দিয়ে থাকে। ফলে বেসরকারি খাতে ছেড়ে দিলে নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য এটি কতটা সম্ভব, তা বিবেচনা করেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। হুট করেও এ বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়া ঠিক হবে না।

ভিউজ বাংলাদেশ: এখন সৌর বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য উদ্যোক্তারা ব্যাপকভাবে আগ্রহ প্রকাশ করছে। এটি কি ঠিক হচ্ছে।
প্রকৌশলী মোহাম্মদ হোসাইন:
আমাদের নীতিমালায় রয়েছে মোট বিদ্যুৎ উৎপাদনের অন্তত ১০ শতাংশ ভাগ নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে আসবে। তাছাড়া মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কপ২৬-এ (COP26) বিশ্ববাসীর কাছে তার যে অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছেন, সে মোতাবেক আমরা ২০৪১ সালে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত বিদ্যুৎ পরিচ্ছন্ন জ্বালানি থেকে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছি। এ ক্ষেত্রে সব চেয়ে বড় সুবিধা হচ্ছে, এ ধরনের বিদ্যুৎ উৎপাদনে জ্বালানি আমদানি করতে হয় না। প্রকৃতি থেকেই জ্বালানি সংস্থান করা যায়। ফলে জ্বালানি খরচ শূন্য। আবার এখন সৌর বিদ্যুতের নিচের জমিও কেউ ফেলে রাখছে না। আমরা সম্প্রতি একটি গবেষণা করেছি। সেখানে দেখিয়েছি কীভাবে সৌর বিদ্যুৎকেন্দ্রের নিচের জমি চাষাবাদ করে লাভবান হওয়া যায়। অর্থাৎ জিরোল্যান্ডে সৌর বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা সম্ভব। দিন দিন সৌর বিদ্যুতের উৎপাদন খরচও কমে আসছে। গোটা বিশ্বই এখন নবায়নযোগ্য জ্বালানির দিকে ঝুঁকছে। আমরা এই যাত্রায় যোগ না দিলে পিছিয়ে পড়তে পারি।

ভিউজ বাংলাদেশ: আপনাকে ধন্যবাদ।
প্রকৌশলী মোহাম্মদ হোসাইন:
আপনাকেও ধন্যবাদ।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ