সংস্কার সংকটে জনমনের প্রশ্ন দূর করুন
দিন যত যাচ্ছে সংস্কার নিয়ে জনমনের প্রশ্ন ততই ঘোলাটে হচ্ছে। কতদিন ধরে কী কী সংস্কার হবে তা নিয়ে অনেকেরই পরিষ্কার ধারণা নেই। যদিও এর মধ্যে চার সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন প্রধান উপদেষ্টার কাছে জমা দেয়া হয়েছে, তাতে নেই স্পষ্ট রূপরেখা এবং তার কিছু সুপারিশ ইতোমধ্যেই সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। সংস্কার কমিশনগুলোর প্রতিবেদনে কিছু ভালো দিক পেলেও কিছু বিষয় সমস্যাপূর্ণ মনে করছেন দেশের নাগরিক সমাজ। ১১টি সংস্কার কমিশনের মধ্যে আরও ৭টি কমিশনের প্রতিবেদন জমা দেয়া বাকি এবং সেগুলো কবে প্রধান উপদেষ্টার হাতে জমা পড়বে তাও অনিশ্চিত।
আর কমিশন কী প্রতিবেদন দিল তার চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হবে সরকার কী নেবে, কতটুকু নিতে পারবে তা। অতীতেও এ রকম বহু কমিশন হয়েছে এবং এ রকম বহু কমিশনের রিপোর্ট সরকার বাস্তবায়ন করেনি। বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সংস্কার বাস্তবায়নের ক্ষমতা কতটুকু আছে, তাও দেখার বিষয়। কিছু বিষয় হয়তো বর্তমান সরকার পরবর্তী রাজনৈতিক সরকারের হাতেই ছেড়ে দেবার জন্য রেখে দেবে। আবার নির্বাচিত সরকারও কতটুকু কী বাস্তবায়ন করবে তাও কে ক্ষমতায় আসে তারপর বোঝা যাবে। নির্বাচিত সরকার ছাড়া সংবিধান তৈরি, পরিবর্তন বা সংশোধন করা সম্ভব নয়। ফলে নির্বাচিত সরকার আসলে সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন হতেও পারে, নাও পারে। তার মানে সব মিলিয়ে বিষয়টি অত্যন্ত জটিলতার দিকেই মোড় নিচ্ছে।
এর মধ্যে সংস্কার ঘিরে বিলম্ব ঘটায় রাজনৈতিক দলগুলোও যেমন প্রশ্ন তুলছে, জনমনেও নানা প্রশ্ন দেখা দিচ্ছে। বলা ভালো, এক ধরনের অনিশ্চয়তা ও আতঙ্কই দেখা দিচ্ছে। কারণ দেশে বিনিয়োগ বন্ধ। অর্থনীতির স্বাভাবিক কার্যক্রমে গতি কম। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিও নাজুক। এক ধরনের মব জাস্টিসের ওপর অনেক কিছু চলছে। নির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় আসার আগ পর্যন্ত এসব ঠিক হবে না। গত রোববার এক বিবৃতিতে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান এমনই ইঙ্গিত দিলেন, ‘সংস্কারের আলাপ যত দীর্ঘ হবে, দেশ তত সংকটে পড়বে।’
সংস্কার নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রথম দিকে এক প্রকার সমঝোতা থাকলেও দিন দিন তাতে দূরত্ব বাড়ছে। জনগণও এখন রাজনৈতিক দলগুলোরই মুখাপেক্ষী। কারণ দেশের অনিশ্চিত পরিস্থিতি। জনগণের বড় প্রশ্ন: সংস্কার কি শেষ পর্যন্ত সংকটে রূপ নিবে? ঘরপোড়া গরু যেমন সিঁদুরে মেঘ দেখলে ভয় পায়, বাংলাদেশের জনগণের অবস্থাও যেন এখন অনেকটা সেরকম। ‘খারাপ আছি, এর চাইতে খারাপ যেন আর না হই’, সেই ভয় সব সময় মনে। আবার এ কথাও তো সত্য, উল্লেখযোগ্য সংস্কারই যদি না হয় তাহলে আবার সেই পুরোনো ব্যবস্থাতেই ফিরে যেতে হবে। তাহলে তো এত বড় গণঅভ্যুত্থান ব্যর্থ হবে।
রাজনৈতিক দলগুলোর ওপরও একশ্রেণির মানুষের এখনো অবিশ্বাস আছে। ক্ষমতায় গেলেই হয়তো তারা সব ভুলে যাবে। আবার অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ওপরও এক শ্রেণির মানুষের অবিশ্বাস গড়ে উঠছে। সব মিলিয়ে জনগণ সেই পুরোনো দোলাচলে, দোটানায়। এর হাত থেকে জনগণকে মুক্ত করতে পারে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এবং রাজনৈতিক দলগুলো। আমরা চাই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রয়োজনীয় সংস্কার করুক, তবে তা যতটা দ্রুত পারা যায় এবং রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সমঝোতার ভিত্তিতে। সংস্কারে যত দেরি হবে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গেও বর্তমান সরকারের দূরত্ব বাড়বে, সমঝোতা তত নষ্ট হবে। সংস্কার বাস্তবায়নের একটা স্পষ্ট রূপরেখা অন্তর্বর্তী সরকারের কাছ থেকে এখন আশা করে জনগণ।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে এটা মনে রাখতে হবে, দেশের চলমান সংকট যদি বাড়তে থাকে তার দায়ভার যেমন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাঁধে পড়বে, পরবর্তী সরকার যদি কোনো কারণে ব্যর্থ হয় তার দায়ভারও অনেকটা বর্তমান সরকারকেই নিতে হবে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্বটা বিশাল, তাদের ওপর চাপও বিশাল। তারপরও আমরা চাই সংস্কার নিয়ে জনমনের প্রশ্ন দূর করতে তাদের আরও তৎপর হতে হবে।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে