স্বাস্থ্য খাতে সরকারি গবেষণার নাজুক অবস্থা দূর করুন
আধুনিক পৃথিবীতে জ্ঞানই সম্পদ এবং যে কোনো বিষয়ে জ্ঞানার্জন ও উন্নতির জন্য সে বিষয়ে প্রভূত গবেষণা প্রয়োজন। গবেষণা ছাড়া জ্ঞান উৎপাদন হয় না। জ্ঞান ছাড়া কোনো সমস্যার প্রকৃত সমাধান করা যায় না; কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে প্রায় সব খাতেই গবেষণা অপ্রতুল। শিক্ষা-স্বাস্থ্য-বিজ্ঞান-সমাজের কোনো বিষয় নিয়েই এখানে তেমন গবেষণা নেই। জাতি হিসেবে পিছিয়ে পড়ার এটা আমাদের একটা বড় কারণ।
এর মধ্যে যাও কিছু টুকটাক গবেষণা হয় নানা খাতে, তা নিয়েও প্রচুর অনিয়মের অভিযোগ ওঠে। গতকাল সোমবার (২১ এপ্রিল) সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে জানা যায়, স্বাস্থ্য খাতে সরকারি গবেষণা নিয়ে নানা ধরনের প্রশ্ন উঠেছে। গবেষণা কাজের অনেকগুলোই দেওয়া হয়েছে পছন্দের ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে। বেশ কিছু কাজ ঠিকঠাক সম্পন্নও হয়নি। ফলে সরকারের টাকা নষ্ট হয়েছে; কিন্তু এসব গবেষণার কোনো সুফল মানুষ পায়নি। অন্তত স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অসংক্রামক রোগনিয়ন্ত্রণ শাখা (এনসিডিসি) ও রোগনিয়ন্ত্রণ শাখার (সিডিসি) গত আট বছরের করা বেশ কয়েকটি গবেষণা ও জরিপের ক্ষেত্রে এমন চিত্র দেখা গেছে।
প্রশ্ন হচ্ছে, স্বাস্থ্য বিষয়ে গবেষণা কাজ কি ঠিকাদারি কাজ যে তা পছন্দের ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে দেয়া হবে? যোগ্য ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান ছাড়া কি স্বাস্থ্য নিয়ে গবেষণা করতে পারে? এটা কি রাস্তা বা অবকাঠামো নির্মাণের মতো কাজ, যে কোনোরকম একটা কিছু দাঁড় করিয়ে দিলেই হলো! এরকম অনিয়ম শুধু বাংলাদেশের ক্ষেত্রেই সম্ভব।
বাংলাদেশে ঘনবসতি বেশি বলে এখানে রোগের প্রাদুর্ভাবও বেশি। এ ছাড়া বেশিরভাগ মানুষই স্বল্প আয়ের, স্বল্প শিক্ষিত। স্বাস্থ্য নিয়ে তারা তেমন সচেতনও নয়। পাশাপাশি আমাদের বাতাস, পানি, খাদ্য সবকিছুই প্রায় দূষিত। ৬২ প্রকার সংক্রামক ও ১৩০ প্রকার অসংক্রামক রোগের কারণে বাংলাদেশে বছরে প্রায় ৮ লাখ মানুষ মারা যায়। রোগেভোগে মৃত্যুর সংখ্যার দিক দিয়ে বাংলাদেশ পৃথিবীর শীর্ষ তালিকায় রয়েছে। অথচ স্বাস্থ্য খাতে এখানে বাজেট এখনো প্রয়োজনের তুলনায় খুব কম, স্বাস্থ্য গবেষণায় আরও কম। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে স্বাস্থ্য গবেষণা খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে মাত্র ১০০ কোটি টাকা। ১০০ কোটি টাকা এখন কোনো ছোটখাটো কারখানা করতেই লাগে। এই ১০০ কোটি টাকাও সঠিক জায়গায় ব্যবহার করা হয় না, গবেষণা কাজ দেওয়া হয় পরিচিতজনদের। তাহলে এই দেশের স্বাস্থ্য গবেষণা উন্নতি হবে কী করে? অনুসন্ধানে দেখা গেছে, অধিদপ্তরের গুরুত্বপূর্ণ এসব গবেষণা ও জরিপের অনেকগুলোর ক্ষেত্রেই স্বজনপ্রীতি, আর্থিক অনিয়ম, গবেষণা প্রতিবেদন জমা না দেওয়া, গবেষণাপত্র যথাযথভাবে সংরক্ষণ না করাসহ নানা অসংগতি রয়েছে।
বাংলাদেশের মানুষ চিহ্নিত ২২৬টি রোগে ভোগে, প্রতিটি রোগ নিয়েই তো আলাদা গবেষণা প্রয়োজন। সেখানে মাত্র ১০০ কোটি টাকাতে কী হয়? আর রোগ বিষয়টি এমন নয় যে আগের বছর সে যেরকম ছিল পরের বছরও সেরকমই থাকবে। আবহাওয়া, খাদ্যাভ্যাস ইত্যাদির সঙ্গে রোগের ধরন ও আচরণ পাল্টায়। আধুনিক পৃথিবীতে সমস্ত রোগ নিয়েই প্রযুক্তিগত গবেষণা হচ্ছে। বেরিয়ে আসছে নতুন নতুন তথ্য-উপাত্ত। বিশেষ করে যেসব অসংক্রামক রোগের প্রাদুর্ভাব বাড়ছে বাংলাদেশে- ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, ক্যান্সার, শ্বাসতন্ত্রের প্রদাহ, আর্সেনিকজনিত রোগ, থ্যালাসেমিয়া, মানসিক স্বাস্থ্য, প্রশমনসেবা, বায়ু ও শব্দদূষণ, কিডনির রোগ- এসব নিয়ে তো প্রচুর গবেষণা হওয়া প্রয়োজন। কেন বাড়ছে এসব রোগে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা, এর থেকে প্রতিকার পাওয়ার উপায় কী- এসব তো আমাদের জানতে হবে। এসব রোগের চিকিৎসা নিয়ে আমরা এখনো বিদেশি গবেষণা ও ওষুধপত্রের ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু এসব রোগ বাড়ার পেছনে পরিবেশজনিত কারণও দায়ী, আমরা যদি এসব নিয়ে গবেষণা না করি তা হবে আত্মঘাতী।
বেসরকারি কিছু প্রতিষ্ঠান স্বাস্থ্য খাতে উন্নত গবেষণা করে; কিন্তু তাদের সরকারি গবেষণা কাজ দেওয়া হয় না বলে অভিযোগ রয়েছে। তাদের অভিযোগ, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে একটি গোষ্ঠী গবেষণা কাজ ও অর্থ নিয়ন্ত্রণ করে। আমরা চাই বাংলাদেশে এই দুষ্টুচক্র ভাঙুক। স্বজনপ্রীতি না দেখিয়ে যোগ্য ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেওয়া হোক। পাশাপাশি স্বাস্থ্য গবেষণা খাতে বরাদ্দ বাড়ানো হোক। শুধু বরাদ্দ বাড়ালেই হবে না, তার উপযুক্ত ব্যবহার হতে হবে। তা না হলে যোগ্য ও প্রতিভাবান গবেষকরা গবেষণা কাজে আত্মনিয়োগ করবেন না।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে