পরিবহন খাতে চাঁদাবাজি বন্ধ করুন
বাংলাদেশের পরিবহন খাত যেন স্বতন্ত্র এক লুটেরা সাম্রাজ্য। সরকার বদলায় কিন্তু এর অনিয়ম-দুর্নীতি-বিশৃঙ্খলা থেকে যায় একইরকম। ক্ষমতার হাত বদল হয়; কিন্তু এর লুটপাটের কাঠামোর কোনো বদল ঘটে না। চাঁদাবাজি আর ফিটনেসবিহীন লক্কড়ঝক্কড় গাড়িগুলো চলতে থাকে একইভাবে। তাই দেখা যায় ক্ষমতার রদবদলের সঙ্গে সঙ্গে ভিন্ন পক্ষের পরিবহন খাত দখলের উৎসব শুরু হয়ে যায়। গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পরও এমনটাই হয়েছে। বিরোধী দলগুলো পরিবহন খাতগুলো দখল করেছে।
গত মার্চে প্রকাশিত এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ব্যক্তি মালিকানার বাস পরিবহন ব্যবসা খাতে বছরে ১ হাজার ৫৯ কোটি টাকার চাঁদাবাজি ও দুর্নীতি হয়। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) এক প্রতিবেদন উল্লেখ করেছে, এর মধ্যে দুর্নীতির শীর্ষে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)। গত শনিবার (২৪ আগস্ট) সাংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য বলছে, প্রায় সাড়ে ১৫ বছর ধরে আওয়ামী লীগের নেতারা বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন ও ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির নিয়ন্ত্রণ করতেন। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ ছাড়লে মালিক সমিতির নিয়ন্ত্রণ নেন বিএনপিপন্থিরা।
ব্যক্তি মালিকানার বাস পরিবহন মূলত রাজনৈতিক ছত্রছায়াতেই চলাচল করে। টার্মিনাল থেকে সড়ক চলাচলের অনুমোদন তাদেরই নিয়ন্ত্রণে থাকে। পাশাপাশি তারা থানা-পুলিশও নিয়ন্ত্রণ করে। ফিটনেসবিহীন গাড়ি চালালেও তাদের কারও কাছে জবাবদিহি করতে হয় না। বিশাল এক সিন্ডিকেট এর সঙ্গে যুক্ত। যাত্রীরা মূলত তাদের হাতে জিম্মি। চাঁদাবাজির কারণে তাদের অতিরিক্ত ভাড়া গুনতে হয়। মালিকপক্ষের হাতে জিম্মি পরিবহন শ্রমিকরাও। মালিকপক্ষ, নেতারা বছরে বছরে কোটি কোটি টাকা কামান পরিবহন খাত থেকে; কিন্তু পরিবহন শ্রমিকদের কখনো ভাগ্যের বদল হয় না।
আশার কথা, চাঁদাবাজি বন্ধ ও যাত্রীবান্ধব পরিবহন ব্যবস্থা চালুর আশ্বাস দিয়েছেন ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির নেতারা। তারা দাবি করেছেন, ঢাকার লক্কড়ঝক্কড় বাসের বদলে আধুনিক গণপরিবহন নামাতে তৎপর হবেন। গত শনিবার এক সম্মেলনে ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতি সড়কে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার বিষয়ে কিছু প্রস্তাবনা প্রকাশ করে। প্রস্তাবনাগুলোর মধ্যে ছিল, সব বাস টার্মিনাল, শহরতলি ও আঞ্চলিক কমিটিকে চাঁদামুক্ত রাখা; যাত্রীদের নিরাপত্তা ও নিরাপদ সড়ক গড়ার লক্ষ্যে কাজ করা; সড়ক দুর্ঘটনা কমিয়ে আনার জন্য চেষ্টা অব্যাহত রাখা।
মালিক-শ্রমিক প্রশাসন সর্বোপরি ছাত্র-জনতাকে সম্পৃক্ত করে যাত্রী জনকল্যাণমুখী নিরাপদ সড়ক গড়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করে সব টার্মিনালে শ্রমিকদের কাউন্সেলিং ও মোটিভেশন সভা করার ব্যবস্থা করা; চাঁদামুক্ত ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ গড়ে তোলা এবং সুন্দর ও সুষ্ঠুভাবে গাড়ি পরিচালনার জন্য টার্মিনাল ও অঞ্চলভিত্তিক প্রকৃত মালিকদের নিয়ে কমিটি গঠন করা। নিঃসন্দেহে প্রস্তাবনাগুলো প্রশংসনীয়; কিন্তু অতীতেও এরকম প্রতিশ্রুতির কথা অনেক শোনা গেছে; কিন্তু তার বাস্তবায়ন হয়নি তেমন।
আমরা চাই, শুধু আশ্বাস দিয়েই ঢাকা পরিবহন সড়ক পরিবহন মালিক সমিতি খ্যান্ত হবে না, তারা যথার্থ কাজ করে দেখাবে। বর্তমান সরকারও যেন এই ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট সবাইকে চাপে রাখে। একটি রাষ্ট্রের প্রধান শৃঙ্খলা ও বিশৃঙ্খলা দৃশ্যমান হয় সড়কে। সড়কে শৃঙ্খলা ফিরে আসলে রাষ্ট্রের অন্যান্য জায়গাতেও শৃঙ্খলা ফিরে আসবে। পরিবহন খাত ঘিরে যে বিশাল দুর্নীতির চক্র সেটা সরকার বন্ধ করবে।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে