স্বাধীনতা দিবস সংখ্যা
বৈষম্য নিরোধ না হলে স্বাধীনতার মূল্যবোধের জাগরণ ঘটবে না
বাংলাদেশের যে লক্ষ্য নিয়ে স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছিল, স্বাধীনতার ৫৩ বছর পর আমরা কি তা থেকে আরও দূরে সরে গেছি? আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতির বিকাশ কি ইতিবাচক দিকে হয়েছে? দুর্বলতা কোথায়, ভবিষ্যৎই-বা কী।
মনে রাখতে হবে, স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে আমরা চারটি মূলনীতি ঠিক করেছিলাম আমাদের জাতীয় মর্যাদার প্রতীক রূপে। ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ এবং সমাজতন্ত্র- এই চারটি মূলনীতি আমাদের সংবিধানে লিপিবদ্ধ করেছিলাম। আজকের দিনে বলা হয়ে থাকে সংবিধানের চার মূলনীতি আছে কিন্তু একই সঙ্গে দেখা যাচ্ছে যে, একটা বিশেষ ধর্মকে রাষ্ট্রধর্ম করা হয়েছে। এই যে গোঁজামিল, এই গোঁজামিলের অবসান করার দায়িত্ব কিন্তু যারা ক্ষমতায় আছেন তাদের ওপরই বর্তে। কিন্তু সেই কাজটি তারা করছেন না। এই কাজটি যে করা উচিত, সে বিষয়ে সামান্যতম সন্দেহও আমাদের মনে নেই। আমাদের রাষ্ট্রের যে বিজাতীয়করণ ঘটে গিয়েছে, এ বিষয়েও যারা ক্ষমতায় আছেন তাদের সক্রিয় সচেতনতা কামনা করছি।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর আঁস্তাকুড় থেকে উঠে এসে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অংশীদার হয়েছিল যে ইবলিশের চ্যালাচামুণ্ডারা; তাদের অতিরঞ্জিত উত্থান, যার মাধ্যমে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধের পতন ঘটেছে, আমাদের আশা-আকাঙ্ক্ষাকে গুঁড়িয়ে দেওয়ার অসৎ উদ্দেশ্য নিয়েই যে তারা ক্ষমতা দখল করেছিল এবং বেশ কিছু দিন ধরে তারা ক্ষমতার মসনদে আসীন হয়েছিল। ক্ষমতায় বসেই তারা জনগণের দলিল রাষ্ট্রীয় সংবিধান এমন বিকৃতি ঘটিয়েছিল, যার মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতার মর্মবস্তু অনেক কিছুই নষ্ট হয়ে যায়। পাকিস্তানের মতো জঙ্গি হুকুমত কায়েম করে দু'জন বাংলাদেশি জংবাহাদুর ধর্মের বিকৃত ব্যাখ্যার আশ্রয় নিয়ে আমাদের ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশের গলায় সাম্প্রদায়িক কলঙ্কতিলক এঁকে দেয়। উদার গণতান্ত্রিকতার জায়গা দখলে নেয় সংকীর্ণ সাম্প্রদায়িকতা। এদের সহযোগী ও সহমর্মীদের সঙ্গে মৈত্রী সম্পর্ক স্থাপন করে জাতীয় সংহতি প্রতিষ্ঠিত হবে না, আমরা শান্তি ফিরে পাব না, এ বিষয়টি খুব পরিস্কারভাবে আমাদের বোঝা উচিত। কাজেই জাতিকে সংহত করার জন্য আমাদের মালিকানার মূল দলিল, অর্থাৎ ৭২-এর সংবিধানকে ভেজালমুক্ত করে গ্রহণ এবং তার ঘনিষ্ঠ অনুসরণকে এই মুহূর্তের প্রধান কাজ বলে আমি মনে করি। সেই কাজটি করতে কেন বিলম্ব হচ্ছে, কেন করছে না আমাদের ক্ষমতাসীনরা, তা আমার বোধগম্য নয়।
বাংলাদেশের সংবিধান প্রবর্তনকালে ১২ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছিল যে, ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি বাস্তবায়নের জন্য সকল প্রকার সাম্প্রদায়িকতা নিষিদ্ধ করা, রাষ্ট্র কর্তৃক কোনো ধর্মকে রাজনৈতিক মর্যাদা দান না করা, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মকে ব্যবহার বন্ধ করা, কোনো বিশেষ ধর্ম পালনকারীর প্রতি বৈষম্য বা তার ওপর নিপীড়ন বিলোপ করা হবে। ১৯৭৮ সালের দ্বিতীয় ঘোষণাপত্র আদেশ দ্বারা উক্ত অনুচ্ছেদ বিলুপ্ত করা হয়। প্রয়াত বিচারপতি চিন্তক মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান প্রণীত 'যার যার ধর্ম' কোষ গ্রন্থে রাষ্ট্রধর্ম সম্পর্কে যে আলোকপাত তিনি করেছেন সেখান থেকে উদ্ৃব্দত করছি। সংবিধান প্রবর্তনকালে ৩৮ অনুচ্ছেদে যে সাংগঠনিক স্বাধীনতার কথা বলা হয়, সেখানে একটি শর্ত ছিল, রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সংবলিত বা লক্ষ্য হিসেবে ধর্মীয় নাম যুক্ত বা ধর্মভিত্তিক কোনো সমিতি বা সংঘ গঠন করার বা তার সদস্য হওয়ার বা অন্য কোনো প্রকারে তার তৎপরতার অধিকার কোনো ব্যক্তির থাকবে না।
এই শর্ত ১৯৭৮ সালের দ্বিতীয় ঘোষণাপত্র আদেশ দ্বারা বিলুপ্ত হয় এবং সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী দ্বারা সমর্থিত। সেই পঞ্চম সংশোধনী বেআইনি ঘোষিত হলো, যখন এমত অবস্থায় রাষ্ট্রধর্ম সংবলিত বিধানটি বিলুপ্ত করা এবং ধর্মতন্ত্রী রাজনীতি ও রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করার পথে আর কোনো প্রতিবন্ধকতা রইল না। তবে বাস্তবে কোনো প্রতিবন্ধকতা না থাকলেও রাষ্ট্র আক্রান্ত ধর্ম সম্পর্কে নানান মানুষ প্রতিবন্ধীদের দ্বারা। এসব মানুষ থেকে মুক্ত হলে এবং অবিলম্বে সংবিধানের ১২ ও ৩৮ অনুচ্ছেদ পুনঃস্থাপন করলে গণশত্রু ধর্মতন্ত্রী মৌলবাদীদের সংগঠন নিষিদ্ধ হবে। বর্তমানে আমরা যে পাকিস্তানায়নের মধ্যে পড়ে গিয়েছি এবং পাকিস্তানের ভূত যে আমাদের ঘাড়ে এখনও ভর করে রয়েছে তা স্পষ্ট। কাজেই এই গণশত্রুদের রহিত না করলে সেই ভূতের হাত থেকে আমরা কোনোভাবেই নিস্কৃতি পাব না। এ বিষয়ে ক্ষমতাসীনদের অবশ্যই চিন্তা করা উচিত। শুধু চিন্তা নয়, সক্রিয়ভাবে ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন বলে মনে করি।
স্বাধীনতার ৫৩ বছর পরে আমরা আর তলাহীন ঝুড়ি নই। আমাদের উৎপাদন বেড়েছে, মাথাপিছু আয় বেড়েছে। তবে এক্ষেত্রে লক্ষণীয়, মাথাপিছু আয় বাড়ার মধ্য দিয়ে কার কার মাথা এখানে যুক্ত হয়েছে, কত শতাংশ মানুষ কত শতাংশ সম্পদ ভোগ করছে, এ নিয়ে চিন্তা করতে হবে। এগুলো নিয়ে কথাও হচ্ছে অনেক। এই যে বৈষম্য, এই বৈষম্য নিরোধ না করা পর্যন্ত প্রকৃত প্রস্তাবে আমাদের স্বাধীনতার আসল মূল্যবোধের প্রতিষ্ঠা হবে না। কাজেই সেই বৈষম্য বিলোপ চাই; বৈষম্য বিলোপের জন্য সমাজতন্ত্রকে লক্ষবিন্দুতে রেখে, সমবায়কে বিশেষ মর্যাদা দিয়ে আমাদের নতুনভাবে এগিয়ে যেতে হবে এবং পাকিস্তানের ভূতরা যে আমাদের পেছনে টেনে নিয়ে যেতে চাইছে, সেখান থেকে আমরা সামনের দিকে এগিয়ে যেতে পারব।
এই অবস্থা থেকে আমরা পরিত্রাণ চাই। পরিত্রাণ কে করবে? আমার মনে হয়, এ ব্যাপারে আমাদের অনেক দায়িত্ব আছে। আমাদের তরুণ সমাজকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। তরুণদের একটি অংশ যদিও সেক্যুলার চিন্তাভাবনা থেকে অনেক দূরে সরে গিয়ে ধর্মীয় মৌলবাদে আক্রান্ত হয়ে পড়েছে। কিন্তু আমি একে বাধা মনে করি না। আমাদের স্বাধীন রাষ্ট্রে উত্তরণপর্বেও তরুণদের একটি অংশে স্বাধীনতার বিরুদ্ধশক্তি বিদ্যমান ছিল। পথের তরুণদের আন্দোলনের মধ্য দিয়ে যদি আবার স্বাধীনতার মূলমন্ত্র গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ফিরিয়ে আনতে পারি, তাহলে দেশ কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাবে।
৫৩ বছরে হতাশা যেমন আছে, তেমনি আশাও কম নয়। আশা এবং হাতাশা- দু'দিকেই আলোকপাত করেছি। কাজেই সকল হতাশা দূর করে আশা প্রতিষ্ঠা করার জন্য যা যা করা দরকার, তা এই মুহূর্তে করা হবে বলে আমি কায়মনে কামনা করি।
লেখক: প্রাবন্ধিক ও শিক্ষাবিদ
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে