বেসরকারি শিক্ষকদের দৈন্যদশা দূর করুন
বাংলাদেশে শিক্ষকদের বেতন এমনিতেই কম। সেখানে বেসরকারি স্কুলের শিক্ষকদের অবস্থা তথৈবচ। মাসিক বেতন দিয়ে শিক্ষকরা কোনোরকমে দিন এনে দিন খান। বেতনের টাকায় পোষাতে পারেন না বলে অনেকে প্রাইভেট পড়ান, ছোটখাটো ব্যবসা করেন। গ্রামাঞ্চলে অনেক শিক্ষক কৃষিকাজও করেন। বাংলাদেশের শিক্ষকদের এই অবস্থা মোটামুটি আবহমান কাল ধরেই। এর মধ্যে দেশ অনেক উন্নত হয়েছে; কিন্তু শিক্ষকদের অবস্থার উন্নতি হয়নি।
শিক্ষকদের বেতন লাট সাহেবের কুকুরের এক ঠ্যাংয়ের খরচের সমান। অনেক শিক্ষক তাই সারাজীবন পথ চেয়ে থাকেন, তার পেনশনের টাকাটির দিকে। ভাবেন একমুঠে কিছু টাকা পেলে অনেক জরুরি কাজ করবেন। হয়তো বাড়িটা ঠিক করবেন, মেয়ের বিয়ে দেবেন, নিজের বা স্ত্রীর বড় কোনো চিকিৎসার প্রয়োজন হলে খরচ করবেন। কিন্তু অবসরের পরও যখন তার পেনশনটি যথা সময়ে না পাওয়া যায়, তা অত্যন্ত দুঃখজনক।
গতকাল মঙ্গলবার (২৬ নভেম্বর) পত্রিকায় প্রকাশিত খবরে জানা যায়, সারা দেশে ৭২ হাজারের বেশি বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারী তিন মাস ধরে অবসর ও কল্যাণ ভাতার টাকা পাচ্ছেন না। জীবন সায়াহ্নে এসে চরম দৈন্যদশায় পড়েছেন তারা। প্রাপ্ত তথ্যমতে, সারা দেশে এমপিওভুক্ত বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারী আছেন পাঁচ লাখের মতো। তাদের কল্যাণ ও অবসর ভাতা হয় যথাক্রমে- বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শিক্ষক ও কর্মচারী কল্যাণ ট্রাস্ট এবং বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শিক্ষক ও কর্মচারী অবসর সুবিধা বোর্ডের মাধ্যমে।
কল্যাণ ট্রাস্ট ও অবসর সুবিধা বোর্ডের কার্যালয় রাজধানীর পলাশীর বাংলাদেশ শিক্ষাতথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরো (ব্যানবেইস) ভবনে। সূত্র জানায়, ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর থেকে গত ৩১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৩৭ হাজার শিক্ষক-কর্মচারী অবসর ভাতার আবেদন করেছেন। ২০২১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত জমা আবেদনের নিরীক্ষা (অডিট) নিষ্পত্তি হয়। এর পর ২০২০ সালের আগস্ট পর্যন্ত আবেদনের বিপরীতে অবসর সুবিধার অর্থ দেয়া হয়; কিন্তু নানা জটিলতায় আটকে আছে অন্যদের অর্থ।
অন্যদিকে, কল্যাণ ভাতার জন্য এ পর্যন্ত আবেদন পড়েছে প্রায় ৩৫ হাজার। এর মধ্যে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত পড়েছে ১০ হাজার ২৪২টি। নিয়ম অনুযায়ী, অবসরের পরপরই অবসর ও কল্যাণভাতা পাওয়ার কথা থাকলেও নানা কারণে চার বছর পর্যন্ত লেগে যায় বলে ভুক্তভোগীরা জানিয়েছেন। অনুসন্ধানে জানা যায়, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন কল্যাণ ট্রাস্ট ও অবসর সুবিধা বোর্ড পরিচালিত হয় দুটি কমিটির মাধ্যমে।
পদাধিকারবলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের সচিব এই কমিটির চেয়ারম্যান এবং ভাইস চেয়ারম্যান মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) মহাপরিচালক। কমিটির সচিব ও অন্যান্য সদস্য হন বেসরকারি স্কুল-কলেজ ও মাদ্রাসার শিক্ষকরা। গত সাড়ে ১৫ বছরে আওয়ামী লীগপন্থি শিক্ষক নেতারা কল্যাণ ট্রাস্ট ও অবসর সুবিধা বোর্ডের কমিটিতে স্থান পেয়েছেন। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকে বেশির ভাগ শিক্ষক নেতা পলাতক। এতে থমকে গেছে কল্যাণ ট্রাস্ট ও অবসর বোর্ডের কার্যক্রম।
ভাতা বন্ধের পেছনে এটিকে অন্যতম কারণ বলা হলেও সাংবাদিকদের অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে চাঞ্চল্যকর তথ্য। সংশ্লিষ্টরা জানান, আওয়ামী লীগ আমলে অবসর সুবিধা বোর্ড ও কল্যাণ ট্রাস্টের প্রায় ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা সরকারি ব্যাংক থেকে সরিয়ে শিক্ষক নেতারা ব্যক্তিগত লাভের আশায় বেসরকারি ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক ও সিটিজেনস ব্যাংকে রাখেন। কর্মকর্তারা জানান, লুটপাটের কারণে দুটি ব্যাংকই তারল্য সংকটে ভুগছে। বেশির ভাগ গ্রাহক তাদের আমানত তুলে নিয়েছেন।
ব্যাংক দুটি চাহিদামতো অর্থ দিতে না পারায় শিক্ষক-কর্মচারীর টাকা পরিশোধ করতে পারছে না কমিটি। এমন পরিস্থিতিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয় সম্প্রতি ব্যাংক দুটির পরিবর্তে সরকারি ব্যাংকে তহবিল রেখে লেনদেনের নির্দেশনা দিয়েছে; কিন্তু অবসর বোর্ড ও কল্যাণ ট্রাস্টের পূর্ণাঙ্গ কমিটি সভা করতে না পারায় আটকে গেছে তহবিল স্থানান্তরের নির্দেশনা। এ কারণে গত তিন মাস শিক্ষক-কর্মচারীরা টাকা পাচ্ছেন না। অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে একটি গ্রামীণ প্রবাদ মনে পড়ে, ‘শেয়ালের হাতে মুরগি জমা’। মুরগি তো শেয়াল খেয়ে ফেলেছে।
ভুক্তভোগীদের অবস্থা এখন তাহলে কী হবে? শিক্ষকদের বাঁচাতে এখন সরকারকেই এগিয়ে আসতে হবে। অমারা চাই, যত দ্রুত সম্ভব অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষকদের পেনশন শোধ করা হোক। বেতন-ভাতা ও অন্যান্য প্রাপ্তি নিয়ে যেন কোনো শিক্ষককেই মাথা ঘামাতে না হয়। সারা জীবন ধরে শিক্ষকরা মাথা ঘামান জাতির মেরুদণ্ড গড়ার কাজে, যখন তাদের একটু আরামের সময়, তখন পেনশন নিয়ে কেন তাদের মাথাব্যথায় ভুগতে হবে!
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে