শুধু আইনি সংস্কার নয়, পুলিশের নৈতিকতা বৃদ্ধি করাও জরুরি
জনগণের জান-মাল নিরাপত্তার স্বার্থে, একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের শান্তিশৃঙ্খলা আইন রক্ষা করতে, রাষ্ট্রের দুর্নীতি দমন করতে পুলিশ বাহিনী ব্যবহৃত হয়। প্রাচীনকাল থেকেই বিভিন্ন দেশে নানারকম আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বর্তমান। আধুনিক রাষ্ট্রে পুলিশ জনগণের সর্বোচ্চ বন্ধু হিসেবে কাজ করেন। এমন একটি কথা প্রচলিত আছে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর ব্যক্তি বা কোনো গোষ্ঠীও যদি কোনো ব্যক্তির জন্য হুমকিস্বরূপ হন, সেই ব্যক্তির শেষ আশ্রয়দাতা পুলিশ।
পুলিশ মূলত রাষ্ট্র ও বিশেষ গোষ্ঠীর মাঝখানে জনগণ বা অসহায় ব্যক্তির নিরাপত্তা ঢাল হিসেবে কাজ করেন; কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত, আমাদের দেশে দেখা গেছে পুলিশ বিশেষ গোষ্ঠী ও রাষ্ট্রের পক্ষ হয়ে কাজ করেন এবং ক্ষেত্রবিশেষে জনগণের শত্রু হয়ে দাঁড়ান। গত গণঅভ্যুত্থানের সময় এমনটিই দেখা গেছে এবং পুলিশের পক্ষপাতদুষ্ট আচরণের কারণে পুলিশ বাহিনীতে সংস্কার নিয়ে কথা উঠছে। পুলিশ সংস্কারের জন্য সংস্কার কমিশনও গঠিত হয়েছে। পুলিশ সংস্কার কমিশনের করা ‘কেমন পুলিশ চাই’ এক জরিপে উঠে এসেছে নানা জনমত।
গতকাল বুধবার (৪ ডিসেম্বর) সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে জানা যায়, সংস্কারের মাধ্যমে কেমন পুলিশ চান- এমন প্রশ্নের জবাবে সর্বাধিক মতামত পড়েছে দুটি ক্ষেত্রে। প্রথম অবস্থানে রয়েছে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত পুলিশ চাই (৮৮ দশমিক ৭ শতাংশ)। দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে আইনের প্রতি অনুগত বা নিরপেক্ষ পুলিশ (৮৬ দশমিক ২ শতাংশ)। এ ছাড়া দুর্নীতিমুক্ত পুলিশের পক্ষে মত দিয়েছেন ৮৪ শতাংশ উত্তরদাতা।
কোন কোন ক্ষেত্রে সংস্কার জরুরি- এমন প্রশ্নে ৮৯ দশমিক ৫ শতাংশ উত্তরদাতা পুলিশকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার বন্ধের পক্ষে মত দিয়েছেন। ক্ষমতার অপব্যবহার ও দুর্নীতি বন্ধের পক্ষে মত দেন ৭৭ দশমিক ৯ শতাংশ। গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের জবাবদিহি ও শাস্তির আওতায় আনার পক্ষে মত দেন ৭৪ দশমিক ৯ শতাংশ উত্তরদাতা। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত পুলিশ সংস্কার কমিশন এই জনমত জরিপ করার সিদ্ধান্ত নেয় গত ৩১ অক্টোবর। জরিপে অংশ নেন ২৪ হাজার ৪৪২ জন। তাদের মধ্যে ১৮ থেকে ৪৪ বছর বয়সী মানুষ প্রায় ৮৭ শতাংশ। এর মধ্যে পুরুষ ছিলেন ২৩ হাজার ১৯১ জন, অর্থাৎ ৯৫ শতাংশ। নারী ছিলেন ১ হাজার ২৫১ জন বা ৫ শতাংশ।
৫৪ ধারা বিলোপের পক্ষে মতামত দেন অনেকে। এই ধারার কারণে অনেকে হয়রানির শিকার হন বলে অভিযোগ রয়েছে। বিদ্যমান আইনে সাদা পোশাকে কাউকে গ্রেপ্তার করার এখতিয়ার না থাকলেও এ ঘটনা হরহামেশাই ঘটছে। গুম হওয়া ব্যক্তিদের সাদা পোশাকে উঠিয়ে নেয়ার অভিযোগই বেশি। এ কারণে সাদা পোশাকের অভিযান কীভাবে বন্ধ করা যায়, পুলিশ সংস্কার কমিশনে সে বিষয়েও আলোচনা চলছে বলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন।
সংস্কারের কথা হচ্ছে, সংস্কার হবে; কিন্তু আমরা জানি কেবল আইন দিয়েই কোনো দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি করা যায় না। অনেক আইনই দেশে আছে; কিন্তু সেই আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগ নেই। আসলে সবচেয়ে বেশি দরকার পুলিশ তথা সব আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নৈতিকতা উন্নীত করা। প্রশ্ন হচ্ছে, সেটা কীভাবে সম্ভব? তাদের বেতন বাড়িয়ে? নীতিকথা শুনিয়ে? দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করে? এই তিনটিই যে জরুরি, তা বটে; কিন্তু তার সঙ্গে দরকার দেশের সামগ্রিক রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক পরিবর্তন।
একটি দেশের রাজনীতি যখন নষ্ট হয়ে যায়, তখন সবই নষ্টদের অধিকারে যায়। লুট-তরাজের যে অপসংস্কৃতি আমাদের দেশে দীর্ঘকাল ধরে চলছে এর থেকে তো কারও মুক্তি নেই। আমাদের দেশে বিভিন্ন পেশাজীবী মানুষই কলুষিত হয়ে গেছে। তাই পুলিশ সংস্কার তো দরকারই, তার সঙ্গে দরকার সমগ্র রাষ্ট্রের সংস্কার। তা নিয়ে কথা হচ্ছে; কিন্তু যা নিয়ে কথা হচ্ছে না তা হলো আমাদের আত্মার সংস্কার নিয়ে। প্রত্যেক জাতির স্বতন্ত্র এক সত্তা থাকে, আলাদা এক আত্মা থাকে- সর্বস্তরে শুভবুদ্ধি জাগ্রত হওয়ার মধ্য দিয়ে আমাদের জাতির আত্মা শুদ্ধ হোক- এটাই আমরা চাই।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে