শিক্ষার্থীদের দুঃশ্চিন্তামুক্ত জীবন নিশ্চিত করুন
বিশ্বজুড়ে মনের দরজা খুলে দেয়ার স্বপ্ন নিয়ে শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। এ বিশ্ব শুধু এ পৃথিবী নয়, পুরো মহাজগতই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের চোখের সামনে হাজির হয় অসীম এক সম্ভাবনা নিয়ে; কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা দিন দিন আবদ্ধ হচ্ছেন বদ্ধ কুয়োয়। তাদের সামনে কেনো স্বপ্ন নেই বরং প্রতি মুহূর্তে দুঃশিন্তায় নিমগ্ন তারা। লেখাপড়া শেষে কি মনের মতো একটা চাকরি পাবেন? হতাশায় অনেকে আত্মহত্যার কথাও ভাবেন।
বেসরকারি সংস্থা ‘আঁচল ফাউন্ডেশন’-এর এক জরিপে উঠে এসেছে এমন আতঙ্কজনক তথ্য। গতকাল শনিবার (৮ মার্চ) সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায় ‘বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতির কারণ’। শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যবিষয়ক তথ্য জানতে গত শুক্রবার (৭ মার্চ) অনলাইনে এক জরিপ চালিয়েছে সংস্থাটি। জরিপে উঠে এসেছে, উচ্চ শিক্ষার স্বপ্ন নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর নতুন পরিবেশে খাপ খাওয়াতে পারেন না অনেকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনার মান, হলের পরিবেশ নিয়ে অসন্তুষ্টি, সিনিয়র সহপাঠী ও শিক্ষকদের বুলিং, যৌন হয়রানি, ভবিষ্যৎ পেশা নিয়ে দুশ্চিন্তা, মন খুলে কথা বলতে না পারার কারণে হতাশা এবং বিষণ্নতায় ভুগতে থাকেন অনেক শিক্ষার্থী। প্রচণ্ড মানসিক অস্থিরতা ও প্রতিকূল পরিবেশে খাপ খাওয়াতে না পারার কারণে ৩৯ শতাংশ শিক্ষার্থীর মনে আত্মহত্যার চিন্তা এসেছে। ৫৫ শতাংশ শিক্ষার্থী জানিয়েছেন, তারা ভবিষ্যৎ পেশাজীবন নিয়ে দুশ্চিন্তায় ভুগছেন।
এসব পরিস্থিতি নিয়ে আমরা সবাই কম-বেশি অবগত। গত মে মাসের বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) ত্রৈমাসিক জরিপ থেকে জানা গিয়েছিল, বর্তমানে দেশে বেকারের সংখ্যা ২৫ লাখ ৯০ হাজার। এ বেকারত্বের অন্যতম কারণ দেশের শ্রমবাজার ছোট। দ্বিতীয়ত, এমন অনেক বিষয় নিয়ে শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েন শ্রমবাজারে এলেই সেগুলোর তেমন চাহিদা নেই। ব্যবসা ও প্রযুক্তিনির্ভর বিশ্বে কলা অনুষদের অনেক বিষয় আজ প্রায় অকার্যকর হয়ে উঠেছে। ভালো বিষয়ে পড়ার সুযোগ না পেয়ে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে এসব বিষয়ে প্রয়োজনের তুলনায় প্রচুরসংখ্যক শিক্ষার্থী অধ্যায়ন করেন। এর একটা কারণ, চাকরি পাক আর না পাক, আমাদের দেশের শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষার প্রতি এখনো খুব আগ্রহ। অথচ উচ্চতর গবেষণার মানসিকতা না থাকলে সেসব বিষয়ে পড়ে তেমন লাভ নেই আজকের বিশ্বে।
এর চেয়ে বরং কারিগরি কোনো শিক্ষা গ্রহণ করা ভালো। কারিগরি শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে সরকার দীর্ঘদিন ধরে প্রচার চালালেও জনমনে যে এ নিয়ে খুব বেশি সচেতনতা সৃষ্টি হয়েছে বলা যাবে না। সরকারেরও কিছু গাফিলতি আছে। এমন অনেক বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালগুলোতে সরকার অধিকসংখ্যক শিক্ষার্থীর ভর্তির সুযোগ সৃষ্টি করে রেখেছে। যা দেখে মনে হয় বেকারত্ব সৃষ্টির জন্যই বোধহয় ওগুলো করা। শিক্ষার্থীরা পড়বে, বেকার থাকবে; কিন্তু তার জন্য সরকারকেও দোষ দিতে পারবে না।
বিষয়টি আসলে জটিল ও বিশাল। একটি সম্পাদকীয়তে এর সব দিক আনা সম্ভব নয়। এ নিয়ে দীর্ঘ গবেষণা হওয়া প্রয়োজন; কিন্তু আমাদের দেশে কোনো বিষয় নিয়ে জরিপ যে হারে হয়, গবেষণা সে হারে হয়- বলা যাবে না। গবেষণা না হলেও সাদা চোখেই দেখা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আজ সাংস্কৃতিক পরিবেশ নেই, আড্ডা নেই, বিতর্ক নেই, পাঠচক্র নেই, ফিল্মক্লাব নেই; মন ও মননের বিকাশের জন্য ভালো কিছুই নেই; আছে কেবল মারামারি, দলাদলি, উচ্ছৃঙ্খল রাজনীতি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা কেন বুলিং ও যৌন হয়রানির শিকার হবেন? কেন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন শিক্ষার্থীদের নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করতে পারছে না? বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে পরিবেশ কেন ঠিক থাকবে না? এর প্রত্যেকটি বিষয় নিয়ে আলাদা করে অনেক কথা বলা যায়; কিন্তু শেষ কথা যা, শিক্ষা ক্ষেত্রে ব্যাপক বৈপ্লিক পরিবর্তন আনা ছাড়া এ থেকে উত্তরণের পথ নেই। এর জন্য শিক্ষার্থী, অভিভাবক, বিশ্ববিদ্যালয়-প্রশাসনসহ সরকারকেও সচেতন হতে হবে। শিক্ষার্থীরাই দেশের ভবিষ্যৎ। তাদের দুঃশ্চিন্তামুক্ত জীবন নিশ্চিত করতে না পারলে দেশ ডুবে যাবে অন্ধকারে।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে