নাগরিক অধিকার নিশ্চিত করতে জাতীয় সনদ প্রণয়ন করুন
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন শুধু একটা অধিকার বঞ্চনার কথা নয়, চাকরিতে এ অধিকার বঞ্চনা ছাড়াও এসব ছাত্রছাত্রী আরও অনেক অধিকার থেকে বঞ্চিত ছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ক্ষমতাসীন দলের আনুকূল্যে থাকা ছাত্রদের দ্বারা গণরুম কালচারের মাধ্যমে তারা চরমভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার হয়েছেন। আর সবচেয়ে বড় মানবাধিকার লঙ্ঘন হয়েছে নরীদের প্রতি বোডি শেমিং, নিগ্রহ, লাঞ্ছনা, নির্যাতন, ধর্ষণের দ্বারা। এভাবে পুঞ্জীভূত ক্ষোভ, নাগরিক অধিকার হরণ ও বাকস্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত হওয়ার কারণে বহিঃপ্রকাশ ঘটে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের। ফলে ছাত্রদের শান্তিপূর্ণ কোটা সংস্কার আন্দোলন থেকে একসময় দেশব্যাপী সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে। পরবর্তীকালে দেশের ছাত্রসমাজ ও সাধারণ মানুষ সরকার পতনের এক দফা দাবিতে গণঅভ্যুত্থান শুরু হয়। গণঅভ্যুত্থানের একপর্যায়ে গণভবন ঘেরাওয়ের কর্মসূচি থেকে কর্তৃত্ববাদী শেখ হাসিনা সরকারের পতন ঘটে। পরবর্তীতে সেনাবাহিনী দায়িত্ব নেওয়ার ফলে কার্যত দেশে কোনো সরকার ছিল না। এমতাবস্থায় অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টাদের শপথের মাধ্যমে সেই অচলাবস্থার অবসান ঘটেছে।
ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে ১১ দিন আগে গঠিত হয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। নতুন সরকার গঠনের শুরু থেকেই আন্দোলনরত শিক্ষার্থীসহ সমাজের বিভিন্ন পর্যায়ে নাগরিকদের আলোচনায় উঠে এসেছে রাষ্ট্র কাঠামোর সংস্কারের কথা। এই সংস্কারের বিষয় হিসেবে রাষ্ট্রীয় কিংবা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের ভেতরে দীর্ঘবছরের অনিয়ম, ঘুষ, দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনার তথ্য সামনে এসেছে। ইতোমধ্যে এসব প্রতিষ্ঠানে শীর্ষ পদে আসীনদের পদত্যাগ দাবিতে বিক্ষোভ হচ্ছে, আবার অনেক প্রতিষ্ঠানের প্রধানেরা স্বউদ্যোগে দায়িত্বভার ছেড়ে পদত্যাগও করছেন। ফলে রাষ্ট্র ও প্রশাসন সংস্কার ও নতুন ব্যবস্থাপনায় অন্তর্বর্তী সরকারকে অনেক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে। সে ক্ষেত্রে সুশাসন, জবাবদিহিতা, ন্যায়বিচার, মানবিক মর্যাদা, মানবাধিকার নিশ্চিত করতে পারার মতো প্রত্যাশার বিষয় সবার আগে নজর দিতে হবে। আর সংবিধান এবং আইনের অনেক বিষয়ও এখানে সম্পৃক্ত। তাই রাষ্ট্র সংস্কার খুব চ্যালেঞ্জিং, তবে কঠিন নয়।
মনে রাখতে হবে, শেখ হাসিনা সরকারের আমলে সেই অর্থে দেশে কোনো আইনের শাসন ছিল না। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলো সব দলীয় বাহিনীতে পরিণত হয়েছিল। দেশের মানুষের জানমালের কোনো নিরাপত্তা ছিল না। এক কথায় বলা যায়, দেশব্যাপী এতদিন এক ব্যক্তির শাসনব্যবস্থা কায়েম ছিল। বিগত বছরগুলোতে সরকার তার নিজের লোকদের বিভিন্ন পদে বসিয়ে লেজুড়বৃত্তি করার একটি ধারা তৈরি করেছিল। ফলে পুরো প্রশাসনিক ব্যবস্থাই ভেঙে পড়েছিল। আজ তাদের কাউকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
আমি মনে করি, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রথম কাজ হবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নতুন করে ঢেলে সাজানো। যাতে দেশের নাগরিকদের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়, তাদের আস্থা ফিরে আসে এবং নাগরিক আধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়। সেই সঙ্গে দেশের প্রশাসনকে পুনর্গঠনের দিকে মনোযোগ দিতে হবে। গত সরকারের সময় প্রশাসন চরম দলীয়করণের শিকার ও ব্যাপকভাবে দুর্নীতিগ্রস্ত হয়েছে। যার কিছু কিছু নজির আমরা ইতোমধ্যে প্রত্যক্ষ করেছি।
গত বছরগুলোতে যারা সরকারের নিজস্ব পৃষ্ঠপোষকতায় ক্ষমতার অপব্যবহার করে দুর্নীতির মাধ্যমে সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছেন, দেশ থেকে প্রচুর অর্থকড়ি বাইরে পাচার করেছেন তাদের আগে আইনের মুখোমুখি করতে হবে। তারা যেখানে বাড়ি, গাড়ি, ফ্ল্যাট, প্লট, জমি, ব্যবসা, শেয়ার ব্যবসাসহ ব্যাংকে বিপুল অর্থের পাহাড় গড়েছেন সেগুলো অনুসন্ধান করতে হবে। অনুসন্ধান করলে প্রশাসনের সর্বত্র এখনো এদের দৌরাত্ম্য পাওয়া যাবে। কাজেই নতুন সরকারকে এদের খুঁজে বের করে আইনের আওতায় নিয়ে আসতে হবে।
প্রশাসনিক সংস্কারের কাজেও হাত দিতে হবে। যেভাবে দেশে প্রশাসন চরম দলীয়করণের শিকার ও দুর্নীতিগ্রস্ত হয়েছে; যার কিছু নজির আমরা দেখেছি। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কর্মকর্তা মতিউর রহমানের খবর সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ হয়েছে। তিনি ক্ষমতার অপব্যবহার করে দুর্নীতির মাধ্যমে সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছেন; বাড়ি, গাড়ি, ফ্ল্যাট, প্লট, জমি, ব্যবসা, শেয়ার ব্যবসা, ব্যাংকে বিপুল অর্থ– কোনো কিছুই বাদ নেই। অনুসন্ধান করলে প্রশাসনের সর্বত্র এমন মতিউরদের পাওয়া যাবে। তা ছাড়া প্রশাসন অনেক ক্ষেত্রে জনবিরোধীও হয়ে উঠেছিল। সে জন্য ঢেলে সাজিয়ে একটা কার্যকর প্রশাসন গড়ে তুলতে হবে।
দেশের অর্থনৈতিক সংকট কাটানোর বিষয়ও অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অগ্রাধিকারে থাকতে হবে। সেক্ষেত্রে কয়েক বছর ধরেদেশের ডলার সংকট। রিজার্ভের পরিমাণও ক্রমাগত কমে যাচ্ছে। বিশেষ করে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা পোষণ করে গত মাসে প্রবাসীরা রেমিট্যান্স পাঠানো কমিয়ে দিয়েছিলেন। এখন প্রবাসীদের আস্থায় এনে ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স পাঠানোর ক্ষেত্রে উৎসাহিত করলে ডলার ও রিজার্ভ সংকট কাটাতে ভূমিকা রাখবে।
আর সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে,, আমাদের সংবিধানকে প্রয়োজন অনুযায়ী পরিবর্তন করতে হবে। অনেক পরিবর্তন বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার শুরু করতে পারবে। এ সরকার হয়তো আইন প্রণয়ন করতে পারবে, কিন্তু প্রয়োগ করতে পারবে না। সংবিধান সংশোধন করতে পারবে না। কারণ সংবিধান সংশোধন করতে সংসদের অনুমোদন লাগবে। তবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যেটা করতে পারে সেটা হলো, এ দীর্ঘমেয়াদি ও সুদূরপ্রসারি সংস্কারের জন্য তারা রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বসে সংলাপ করে, আলাপ-আলোচনা করে দলগুলোর ঐকমত্যের ভিত্তিতে একটা চুক্তি করতে পারে। এসব চুক্তির মাধ্যমে একটা জাতীয় সনদ প্রণয়ন করতে পারে।
যে যে ক্ষেত্রে পরিবর্তন দরকার যেমন, নির্বাচনকালীন সরকার কেমন হবে, সংবিধানে কী কী পরিবর্তন আনা হবে, প্রশাসনে কী কী পরিবর্তন আনতে হবে ইত্যাদি। এগুলো তারা অধিকাংশই প্রয়োগ করতে পারবে না, কিন্তু তারা হয়তো আইডিয়াগুলো, আইনকানুনগুলো প্রণয়ন করে এগুলো প্রস্তুত করতে পারবে। এজন্য রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে যদি আলাপ-আলোচনা করে একটা চুক্তি করা যায়, যেটাকে আমরা বলছি জাতীয় সনদ, এ চুক্তিগুলো দলমত নির্বিশেষে স্বাক্ষরিত হতে হবে এবং একটি অবাধ, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে যারা নির্বাচিত হবে, তারা এগুলো বাস্তবায়ন করতে বাধ্য থাকবে। এর মাধ্যমেই আমাদের যে আকাশচুম্বী জনআকাঙ্ক্ষা, সেটা বাস্তবায়নের পথ সুগম হবে বলে আমার মনে হয়।
ড. মুহাম্মদ ইউনূস একজন সর্বমহলে সুপরিচিত সজ্জন ব্যক্তি। তার আন্তর্জাতিক বিশ্বে ইতিবাচক ভাবমূর্তি আছে। তাই আমরা প্রত্যাশা করবো, তিনি শেখ হাসিনার সরকারের গত ১৫ বছর শাসনের সব অনিয়ম, দুনীতি ও অব্যবস্থাপনা থেকে রাষ্ট্রকে একটি গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক, উন্নত ও বাসযোগ্য রাষ্ট্র নির্মাণের সুযোগ তৈরি করবেন।
ড. বদিউল আলম মজুমদার: সম্পাদক, সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে