নারীর প্রতি সহিংসতা রোধে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করুন
একজন নারী কতটা সম্মান ও নিরাপত্তার সঙ্গে একটি সমাজে বাস করতে পারে, তার ওপর নির্ভর করে একটি সুস্থ সমাজের পরিমাপ। সে দিক থেকে আমাদের সমাজ যে অনেক পিছিয়ে আছে, তা বোঝার জন্য জরিপেরও প্রয়োজন নেই, একটু চোখ-কান খোলা রেখে আমাদের চারপাশে তাকালেই বোঝা যায়।
এখনো আমাদের সমাজ নারীর প্রতি প্রচণ্ড আগ্রাসী ও সহিংস। নারীর স্বাধীনভাবে চলাফেরার অধিকার নেই, কথা বলার অধিকার নেই। এখনো পোশাক নিয়ে নারীকে প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়। এখনো নারী বাল্যবিবাহের শিকার, যৌতুক-প্রথার শিকার, পারিবারিক নির্যাতনের শিকার, যৌন-নির্যাতনের শিকার।
নারীর প্রতি সহিংসতা রোধের আহ্বান জানিয়ে ২৫ নভেম্বর থেকে ১০ ডিসেম্বর পর্যন্ত আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ পক্ষ ও বিশ্ব মানবাধিকার দিবস পালন করা হবে। এবারের প্রতিপাদ্য ‘নারী-কন্যার সুরক্ষা করি, সহিংসতামুক্ত বিশ্ব গড়ি’। দিবসটি উপলক্ষে পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও বিভিন্ন স্থানে মানববন্ধন ও আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হচ্ছে।
গতকাল সোমবার (২৫ নভেম্বর) সকালে খাগড়াছড়ি প্রেস ক্লাবের সামনে আয়োজিত মানববন্ধনে ১৩টি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা অংশ নেয়। মানবন্ধনে অংশ নিয়ে বক্তারা বলেন, ‘পাহাড় ও সমতলে নারীর প্রতি সব ধরনের সহিংসতা প্রতিরোধ করতে হবে। এ জন্য সবার আগে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে।’
রাজধানী ঢাকায়ও নানা আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। বিভিন্ন সভায় বক্তারা একটা কথাই জোর দিয়ে বলেছেন, বাংলাদেশে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন আছে; কিন্তু আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগ নেই। গতকাল সোমবার (২৫ নভেম্বর) পত্রিকায় প্রকাশিত খবরে জানা যায়, নারী নির্যাতনের ৬৮ ভাগ আসামি গ্রেপ্তারই হয়নি ২০২৪ সালে।
দেশের বিভিন্ন থানার মামলার তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, একক ধর্ষণের ঘটনা ছাড়া বেশির ভাগ ক্ষেত্রে নির্যাতনের ঘটনায় আসামি থাকেন একাধিক ব্যক্তি। যৌতুকের মতো পারিবারিক নির্যাতনের ঘটনায় স্বামীর সঙ্গে পরিবারের অনেক সদস্যকেও আসামি করা হয়। তবে মামলার পর আসামিদের বড় একটি অংশ পুলিশের নাগালের বাইরে থেকে যায়।
পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য অনুসারে, জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৯ মাসে সারা দেশের থানা ও আদালতে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০-এর যৌতুক, ধর্ষণ, ধর্ষণচেষ্টা, দাহ্য পদার্থ নিক্ষেপ ও অপহরণ ধারায় মোট ১২ হাজার ৭৬৯টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে শুধু নারী নির্যাতনের অভিযোগে মামলা হয়েছে ১০ হাজার ৬৮৬টি। বাকিগুলো শিশু নির্যাতনের অভিযোগে। নারী নির্যাতনের মামলায় মোট আসামি করা হয়েছে ২৪ হাজার ৩৩৯ জনকে। এর মধ্যে গ্রেপ্তার হয়েছে মাত্র ৭ হাজার ৮৩৫ জন। অর্থাৎ ওই ৯ মাসে প্রায় ৬৮ শতাংশ বা দুই-তৃতীয়াংশের বেশি আসামি গ্রেপ্তার হয়নি।
আসামি গ্রেপ্তার না হওয়ার কারণ পুলিশের গাফিলতি। আসামিরা আত্মগোপনে চলে যায়, এই কারণ দেখিয়ে পুলিশ পার পেতে পারে না। নারী নির্যাতনের মামলাকে অবশ্যই আরও গুরুত্বের সঙ্গে নিতে হবে। একটি আসামি ছাড় পাওয়া মানে আরেকজন নারীকে নির্যাতনের মুখে ফেলা। তা ছাড়া আসামি গ্রেপ্তার না হলে মামলার প্রক্রিয়া দীর্ঘায়িত হয়।
বিচার না হলে ভুক্তভোগী যেমন ভোগান্তিতে পড়ে, তেমনি সমাজে অপরাধও বাড়তে থাকে। ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার জন্য প্রকৃত আসামিদের শনাক্ত করে গ্রেপ্তার করতে হবে। ধর্ষণ, দাহ্য পদার্থ নিক্ষেপ, পাচার, পর্নোগ্রাফির মতো সংবেদনশীল মামলার জন্য পুলিশের পৃথক তদন্তকারী সেল গঠন করা জরুরি।
নারী নির্যাতনের ঘটনা যে কেবল বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তানেই প্রবল-প্রকট তা-ই নয়, সারা বিশ্বেই নারী পদে পদে হেনস্তার শিকার হন। ঘরে-বাইরে, কর্মক্ষেত্রে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নারী এমন অনেক মনস্তাত্ত্বিক নির্যাতনের শিকার হন যার জন্য তিনি কোনো বিচারও দাবি করতে পারেন না।
তাই আইনশৃঙ্খলার সুষ্ঠু প্রয়োগের সঙ্গে সঙ্গে সামাজিক সুরক্ষা ও সচেতনতাও জরুরি। সেটা একটা দেশের আমূল সাংস্কৃতিক পরিবর্তন ছাড়া সম্ভব নয়। আমাদের সমাজ-রাষ্ট্র নারীবান্ধব হয়ে উঠুক, এ সমাজ নারীর জন্য ভয়মুক্ত হোক, এই রাষ্ট্র নারীর সমঅধিকার প্রতিষ্ঠা করুক- তাই আমরা চাই।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে