নারী নির্যাতন রোধে সামাজিক শিক্ষা জরুরি
একটা সমাজ যখন অসহিষ্ণু হয়ে ওঠে তখন সবার আগে অনাচার-অত্যাচার-নির্যাতন চালায় সেই সমাজের নারীদের ওপর। এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীদের নানাভাবে দুর্বল করে রাখা হয়েছে। শারীরিকভাবে নারীরা হয়তো পুরুষের তুলনায় ভিন্নরকম, প্রকৃতির সঙ্গে তারা বেশি সম্পৃক্ত; কিন্তু নারীদের অর্থনৈতিকভাবে, সামাজিকভাবে পিছিয়ে রাখা হয়েছে পুরুষতন্ত্রের প্রভাবেই। বিশেষ করে আমাদের দেশে নারীদের এখনো পেছনেই ঠেলে রাখা হয়েছে।
আর সম্প্রতি আমরা দেখছি আমাদের সমাজের নারীরা নানাভাবে নিপীড়ন-নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। ধর্ষণ থেকে পারিবারিক নির্যাতন চলছেই নারীদের ওপর। অনেক নারী বাল্যবিবাহের শিকার হচ্ছেন। স্বামীর সংসার ত্যাগ করে আসলে তার কোথাও ঠাঁই হচ্ছে না। ফলে শত নিপীড়ন সয়ে সন্তানের কারণে হোক, সামাজিক ভয়ে হোক অনেক নারী সংসার করতে বাধ্য হচ্ছেন। এর সব খবরই পত্রিকায় আসে না। ধর্ষণ-নিপীড়নের বিচার সম্ভব; কিন্তু ধুঁকে ধুঁকে যেসব নারী মরছেন তাদের বিচার কোনো আদালতে হয় না; কারণ তারা শত অত্যাচার মুখ বুজে সয়ে যান; সংবাদমাধ্যমে তো দূরের কথা, অনেক সময় এসব খবর আপন লোকজনই জানেন না।
তাই নারী নির্যাতন রোধে কেবল আইন নয়, সামাজিক শিক্ষাও জরুরি। এই শিক্ষা শুরু হতে হবে প্রতিটি পরিবার থেকে। প্রাতিষ্ঠানিকভাবেও এই শিক্ষা দিতে হবে যে কোনোভাবেই যেন কোনো নারী নির্যাতনের শিকার না হয়। নারী-পুরুষের অর্থনৈতিক সমতা এই সমাজে প্রতিষ্ঠিত না হলেও মানবিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করা জরুরি। সেই মানবিক প্রতিষ্ঠার জন্য সবার আগে প্রয়োজন সবারই মানুষ হওয়া। এটাই জীবনের সবচেয়ে বড় শিক্ষা। অর্থের জোরে, শারীরিক ক্ষমতায় কারও ওপর অত্যাচার চালানো অত্যন্ত গর্হিত কাজ।
এক সময় আমাদের যখন সামাজিক সংস্কৃতি আরও সংঘবদ্ধ ছিল তখন নারী নির্যাতনের ঘটনা অনেক কম ঘটেছে; কিন্তু এখন সামাজিক বন্ধন শিথিল হয়ে যাওয়ার কারণে নারী নির্যাতন বাড়ছে। সামাজিক বন্ধন শিথিল হয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের আদর্শ-মূল্যবোধও কমছে। বাংলাদেশ এখন এমন একটা সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, যেখানে একদিকে ব্যক্তির বিকাশ হয়নি; কিন্তু অন্যদিকে ব্যক্তি সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন। তার সঙ্গে আছে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতা। এসবের প্রভাবও পড়ছে সমাজে-পরিবারে। যার শিকার হচ্ছেন নারীরা।
নারীদের প্রতি শ্রদ্ধা-সম্মানের পরিবেশ গড়ে তুলতে হলে ছোটবেলা থেকেই ছেলে সন্তানদের নারীর প্রতি মানবিক মনোভাব নিয়ে মানসিকতা গড়ে তোলার শিক্ষা দিতে হবে। মানুষ পরিবার থেকেই প্রথম শিক্ষা পায়। আজকে আমাদের সমাজে যত সব উচ্ছৃঙ্খলতা, বিশেষ করে নারী নির্যাতনের মতো ঘটনা সবই পারিবারিক-সামাজিক শিক্ষার ব্যর্থতাকেই স্পষ্ট করে। এই পারিবারিক-সামাজিক শিক্ষার সংস্কৃতি গড়ে তুলতে না পারলে শুধু আইন দিয়ে নারী নির্যাতন বন্ধ করা যাবে না। তাই আসুন, প্রতিটি পারিবারেই আমরা নারী নির্যাতন-বিরোধী আন্দোলন গড়ে তুলি। সামাজিকভাবে নারীরা যেদিন সম্মানের আসনে থাকবেন তখনই দেশজুড়ে এই নারী নিপীড়ন বন্ধ হবে।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে