হাসপাতালে মাতৃমৃত্যু
প্রসব-উত্তর মায়ের জীবন নিশ্চিত করুন
কয়েক বছর আগেও গর্ভবতী নারীদের স্বাভাবিক সন্তান প্রসব ছিল খুবই সাধারণ ঘটনা; কিন্তু সময়ের বিবর্তন ও অস্ত্রোপচারে শিশু জন্মদানের প্রবণতায় তা অনেকটাই হারিয়ে যেতে বসেছে। সমাজের বড় একটা শ্রেণির মানুষেরও প্রসববেদনা-ভীতির কারণে আগ্রহ অস্ত্রোপচারের প্রতি। আর এমন প্রবণতাকে পুঁজি করে দেশের বেসরকারি হাসপাতালগুলো অপ্রয়োজনীয় ক্ষেত্রেও ঝুঁকছে অস্ত্রোপচারের দিকে, যা দেশের জন্য অশনিসংকেত।
অতি সম্প্রতি ‘বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর বরাতে দেশের সংবাদ মাধ্যমগুলো খবর প্রকাশ করে, সন্তান প্রসবের ক্ষেত্রে বাংলাদেশে ৩৫ শতাংশ অস্ত্রোপচারই অপ্রয়োজনীয়। এতে করে শিশু মৃত্যুর হার বাড়ছে। এটা দেশের গড় আয়ু কমে যাওয়ার ক্ষেত্রে মারাত্মক প্রভাব ফেলছে। খবরে আরও জানানো হয়েছিল, বাংলাদেশে প্রসবে অস্ত্রোপচার ৫০ শতাংশের বেশি।
আজ শনিবার (৩০ মার্চ) সংবাদমাধ্যমে আরও একটি উদ্বেগজনক খবর প্রকাশ হয়েছে। সেই সংবাদে বলা হয়েছে, কিছু হাসপাতালে অস্ত্রোপচারে সন্তান জন্মদানের পর অনেক মাতৃমৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। স্ত্রীরোগ ও মাতৃস্বাস্থ্যবিশেষজ্ঞদের সংগঠনও পরিস্থিতি পর্যালোচনা করছে। প্রাথমিকভাবে ধারণা হয়েছে, অস্ত্রোপচারের আগে ত্রুটিযুক্ত ওষুধ ব্যবহারে মৃত্যুর কারণ হতে পারে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের মতে, অধিকাংশ মৃত্যুর ক্ষেত্রে অস্ত্রোপচারের কয়েক ঘণ্টা পর প্রসূতির প্রস্রাব কমে যেতে থাকে, একপর্যায়ে প্রস্রাব বন্ধ হয়ে যায়, রক্তচাপ কমতে থাকে, কিডনি অকেজো হয়ে পড়ে, শ্বাসকষ্ট দেখা দেয়, হার্ট ফেল করে। প্রাথমিক পর্যবেক্ষণে মোটামুটি এসব কারণেই মাতৃমৃত্যু হয় বলে জানা গেছে।
আমরা বলতে চাই, এমন ঘটনা সত্যিই ভয়াবহ। তাই স্বাস্থ্য বিভাগকে দ্রুত নজর দিতে হবে। কার্যকর তদন্ত করতে হবে। খবরে জানা গেছে, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ২৮ মার্চ শুধু চট্টগ্রামের হাসপাতালগুলোর মাতৃমৃত্যুর ঘটনা তদন্তে ১০ সদস্যের কমিটি গঠন করেছে; কিন্তু অন্য বিভাগগুলোতে তদন্ত কমিটি গঠনের কথা এখনো জানা যায়নি; কিন্তু বাংলাদেশে অনেক বিষয়ে তদন্ত কমিটি গঠনের পরও হেলাফেলা লক্ষ্য করা যায়। এ বিষয়ে অবহেলা করা হবে আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। একজন মায়ের স্বাস্থ্যসেবার সঙ্গে একটি জাতির ভাগ্য, ভবিষ্যৎ নির্ধারিত থাকে। প্রসবের পর পর যদি মায়ের জীবন অনিশ্চিত হয়ে পড়ে, তাহলে অনিবার্যভাবে সন্তানের জীবনও অনিশ্চিত হয়ে পড়বে।
শিশু জন্মদানের সবচেয়ে সাধারণ ও প্রাকৃতিক পন্থা হচ্ছে যোনিপথে প্রসব। এখানে প্রসব বেদনার তিনটি পর্যায় থাকে: পানি ভাঙা ও গর্ভাশয় খুলে যাওয়া, নিম্নগমন ও শিশুর জন্ম এবং গর্ভফুল বের হয়ে আসা, এটা মা ও শিশুর জন্য স্বাস্থ্যসম্মত। উন্নত বিশ্বে বেশির ভাগ প্রসব ঘটে হাসপাতালে। যেখানে বাংলাদেশে আগের কালে বেশির ভাগ শিশু জন্মদানের ঘটনা ঘটত বাড়িতে প্রথাগত ধাত্রীদের সহযোগিতায়; কিন্তু সময় বদলে গেছে, এখন উন্নত বিশ্বের মতো আমাদের দেশেও বেশির ভাগ প্রসব ঘটে হাসপাতালে; কিন্তু উন্নত বিশ্বে অধিকাংশ নারীর প্রসব করানো হয় সাধারণ বা প্রাকৃতিক পন্থায়, আর বাংলাদেশে অপ্রয়োজনীয়ভাবে অস্ত্রোপচার করে।
প্রশ্ন হচ্ছে, সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে বাংলাদেশে অপ্রয়োজনীয় অস্ত্রোপচারের সংখ্যা এত বাড়ছে কেন? এদিকেও সংশ্লিষ্ট বিভাগকে নজর দিতে হবে। কারও জানতে বাকি নেই যে, বেশির ভাগ অস্ত্রোপচারই হয় নিযুক্ত ডাক্তারের ভুল ব্যবসায়িক মানসিকতার প্ররোচনায়। এর সঙ্গে বিপুলসংখ্যক ওষুধবিক্রির ব্যবসা জড়িত। অযথা ওষুধ প্রয়োগ মা ও সন্তান উভয়ের জন্যই বিপজ্জনক। এখন সেই ওষুধও যদি হয় ত্রুটিযুক্ত, তাহলে জাতির কপালে দুর্ভোগের ঘটনা ছাড়া আর কিছু থাকে না!
তাই বিষয়টিতে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে মায়ের জীবন নিশ্চিত করার দিকে আমাদের নজর দিতে হবে। মনে রাখতে হবে, প্রসব কোনো অসুখ নয়। এটা জীবনের অত্যন্ত স্বাভাবিক একটা বিষয়। কাজেই ইচ্ছামতো অস্ত্রোপচার নয়। প্রয়োজনেই অস্ত্রোপচার করতে হবে। তাই আত্মশুদ্ধির পথে না গেলে অপ্রয়োজনীয় অস্ত্রোপচার পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যাবে।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে