নারী ফুটবলারদের প্রাপ্য বুঝিয়ে দিন
টানা দ্বিতীয়বার সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ মুকুট জয় করেছে আমাদের নারী ফুটবল দল। ছাদখোলা বাসে চড়ে বিমানবন্দর থেকে যখন তারা রাজধানীর বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে মতিঝিল বাফুফের অফিস পর্যন্ত যায়, তখন সারা শহরের মানুষ তাদের অভিনন্দন জানিয়েছেন। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে ক্রীড়ায় এত বড় সাফল্য আর বাংলাদেশের জন্য আসেনি। এর আগে ২০২২ সালে প্রথমবার সাফ জেতে বাংলাদেশ। সেবারও একইভাবে ছাদখোলা বাসে চড়েন মেয়েরা।
খবরটি নিঃসন্দেহে আনন্দের। সারা দেশের মানুষের জন্য গর্বের; কিন্তু একটা খবর পড়লে আপনার হয়তো মন খারাপ হয়ে যাবে। গত বৃহস্পতিবার সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে জানা যায়, দুই মাস ধরে বেতন পান না সাফজয়ী মেয়েরা। নেপালের কাঠমান্ডুর দশরথ রঙ্গশালা ফুটবল স্টেডিয়ামে স্বাগতিকদের ২-১ গোলে হারিয়ে টানা দ্বিতীয়বার জিতেছে সাফের শিরোপা। দেশের ফুটবলে ছেলেদের পেছনে ফেলেছেন সাবিনা খাতুনরা। গত কয়েক বছরে বাফুফে যে সাফল্যের বড়াই করে, তা শুধুই মেয়েদের কারণেই। অথচ এই সোনার মেয়েদের ভাগ্যে জোটে না মূল্যায়ন। দুই মাস ধরে বকেয়া রয়েছে প্রাপ্য বেতনও।
নভেম্বর শুরু হয়েছে, অথচ তারা গত তিন মাসের বেতনই পাননি সাবিনা খাতুনরা। শুধু তা-ই নয়, মে ও জুলাই মাসে অনুষ্ঠিত চারটি ম্যাচের ম্যাচ ফিও এখনো বুঝে পাননি নারী দলের ফুটবলাররা। আগের চুক্তি অনুযায়ী গত বছরের ১ সেপ্টেম্বর থেকে জাতীয় দলের অধিনায়ক সাবিনা খাতুনসহ ১৫ ফুটবলার মাসে পেয়েছেন ৫০ হাজার টাকা করে। ১০ জন পেতেন ৩০ হাজার টাকা, চারজন ২০ হাজার ও দুজনের বেতন ছিল ১৮ হাজার টাকা করে। সব মিলিয়ে ৩১ ফুটবলারের জন্য বেতনের অঙ্ক ছিল মাসে ১১ লাখ টাকার কিছু বেশি।
তবে চলতি বছরের মে মাস থেকে সেটা বেড়েছে। বাফুফের তৎকালীন সভাপতি কাজী সালাউদ্দিনের আমলে সেটা বাড়ানো হয়েছিল। তারপর থেকেই শুরু হয় জটিলতা। শুরুতে বেতন দেয়া হতো একটু দেরিতে। কখনো সেটা মাসের শেষ দিকে গিয়ে হয়েছে; কিন্তু গত দুই মাস ধরে বেতনই পাচ্ছেন না ফুটবলাররা। এই নারী ফুটবল দলের সবাই মফস্বল ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠী থেকে এসেছেন। তারা সবাই কঠোর লড়াই-সংগ্রাম করে নিজেদের অবস্থান তৈরি করছেন।
ফুটবল মাঠে তারা শুধু খেলোয়াড়ই নন, সবাই একেকজন যোদ্ধার চরিত্রে মাঠে নেমেছিলেন। তাদের কেউ বাবাকে হারিয়েছেন। কেউ মায়ের শেষ সম্বলটুকু নিয়ে মাঠে এসেছেন। কেউ বোনের গয়না বিক্রি করে মাঠের খরচ জুগিয়েছেন; কিন্তু তাদের এ সাফল্যের পেছনের রাষ্ট্রের অবদান নিতান্তই নগণ্য। রাষ্ট্র থেকে নাগরিক হিসেবে প্রাপ্যটুকুও তারা পাননি। আজ আমাদের কর্তাব্যক্তিরা এসব মেয়ের সাফল্যে গর্ববোধ করছেন। সংবাদ সম্মেলন করছেন; কিন্তু মনে রাখতে হবে, এ সাফল্য অর্জনে তাদের অবদান খুবই কম। বরং আছে না দিতে পারার দায়।
এদিকে চ্যাম্পিয়ন দলকে সংবর্ধনা দিতে ছাদখোলা বাসের আয়োজন করলেও সেই বাসে চড়েননি দায়িত্ব ছাড়ার ঘোষণা দেয়া কোচ পিটার বাটলার। তিন মাসের বেতন বাকি থাকার কথা জানিয়েছিলেন এই কোচ। তবে ছাদখোলা বাসে না ওঠার পেছনের কারণ হিসেবে বলেছেন, ‘মেয়েরা উপভোগ করুক। এটাই সময়। ঢাকায় গিয়ে ইংল্যান্ডের টিকিটের ব্যবস্থা করতে হবে। আমার কাজ আছে অনেক।’
দলকে চ্যাম্পিয়ন করে তিন মাস সময় বাকি থাকতেই কোন অভিমানে কোচ বাটলার হঠাৎ দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নিলেন তার কারণটা রয়ে গেছে অজানাই। তবে, দল গঠনে বাইরে থেকে তাকে কেউ হস্তক্ষেপ করেছিল বলে ধারণা করা যাচ্ছে। তা ছাড়া দায়িত্ব নেয়ার পর থেকেই তাকে বহু বাধার সম্মুখীন হতে হয়েছে।
নারী ফুটবল দল বাংলাদেশের জন্য সাফল্য ও সম্মান বয়ে আনলেও তাদের প্রতি সমাজ-রাষ্ট্রের রয়েছে অনেক অবহেলা। আমরা চাই এসব অবহেলা দূর করে নারী ফুটবলারদের যথার্থ সম্মান দেয়া হোক। তাদের যথোপযুক্ত আর্থিক সংস্থানের ব্যবস্থা করা হোক। খাবারের অভাবে কোনো নারী ফুটবলারকে আর যেন বাল্যবিয়ের শিকার হতে না হয়, একটি বাড়ি তৈরির জন্য যেন কারও কাছে হাত পাততে না হয়, যা তাদের অধিকার- তা যেন ভিক্ষার মতো না দেয়া হয়।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে