Views Bangladesh

Views Bangladesh Logo

হাইকোর্টের রায় উপেক্ষিত: পর্ব ১

নিষিদ্ধ পলিথিনে সয়লাব সারা দেশ

Hira  Talukder

হিরা তালুকদার

বুধবার, ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪

রাজধানীর হাতিরপুল বাজারের সবজি দোকানি মহসিন। একটি পলিথিনের ব্যাগেই কয়েক ধরনের সবজি ভরে দিচ্ছিলেন ক্রেতাকে। নিষিদ্ধ হওয়ার পরেও কেন পলিথিন ব্যবহার করছেন, জানতে চাইলে মহসিন বললেন, ‘পলিথিন ছাড়া কিসে দেব? আর তো কোনো ব্যাগ নেই। যারা কিনতে আসেন, তারাও তো কোনো ব্যাগ নিয়ে আসেন না।’

মোহাম্মদপুরের টাউনহল মার্কেট থেকে বাজার করে পলিথিনের ব্যাগে বাসায় নিয়ে যাচ্ছিলেন রাবেয়া খাতুন। পলিথিন যে নিষিদ্ধ, সেই তথ্যটাই জানা নেই তার। ভিউজ বাংলাদেশকে রাবেয়া বলেন, ‘এই ব্যাগ নিষিদ্ধ নাকি? সবাইতো এতে করেই সব জিনিস (পণ্য) নেয়।’

ক্রেতা-বিক্রেতাসহ জনগণের মাঝে এ ধরনের সচেতনতার অভাবেই গ্রামের ছোট মুদি দোকান থেকে শহরের বড় বড় শপিংমল পর্যন্ত নিষিদ্ধঘোষিত পলিথিনে সয়লাব এখন সারা দেশ। পলিথিনের ব্যবহার রোধে রয়েছে আইন, রয়েছে হাইকোর্টের সুনির্দিষ্ট রায়ও; কিন্তু এসব আইন বা রায়ের কঠোর বাস্তবায়ন তো দূরের কথা, নেই ন্যূনতম প্রয়োগও। ফলে পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর এই পণ্যটির অবৈধ ব্যবহার কোনোভাবেই বন্ধ করা যাচ্ছে না। বরং বেড়েই চলেছে উদ্বেগজনক হারে।

বিশেষজ্ঞরা জানান, পলিথিন থেকে মারাত্মক বিষ ‘বিষফেনোল’ নির্গত হয়ে মিশে যায় খাদ্যদ্রব্যে। পলিথিন মাটির সঙ্গে মেশে না, বরং নষ্ট করে দেয় উর্বরাশক্তিকে। রাস্তাঘাট, ডাস্টবিন বা যেখানে সেখানে ফেলা পলিথিন বৃষ্টির পানির সঙ্গে ড্রেনে ঢুকে তৈরি করে জলাবদ্ধতার। তলদেশে জমা হয়ে ভরাট করে ফেলে নদনদীকে। পলিথিন পোড়ালে ঘটে বায়ুদূষণও।

বাংলাদেশে ১৯৮২ সাল থেকে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে পলিথিনের উৎপাদন চলছে, যা এখন ছড়িয়ে পড়েছে মহামারির মতো। গবেষণায় দেখা গেছে, শুধু ঢাকাতেই দিনে জমা হচ্ছে এক কোটি ৪০ লাখ পলিথিন ব্যাগ। ব্যবহৃত পলিথিন গলিয়ে আবারও ব্যবহারে রয়ে যাচ্ছে বিষাক্ত কেমিক্যাল, যা থেকে মানুষের শরীরে দেখা দিচ্ছে ক্যান্সার, চর্মরোগ, লিভার, কিডনি ড্যামেজের মতো জটিল রোগও।

বিশ্বব্যাংকের তথ্যমতে, ঢাকায় বার্ষিক মাথাপিছু প্লাস্টিকের ব্যবহার শহরাঞ্চলের জাতীয় গড় থেকে তিনগুণেরও বেশি, যা বর্তমানে ২২.২৫ কেজিতে দাঁড়িয়েছে। ঢাকায় দিনে প্রায় ৬৪৬ টন প্লাস্টিক বর্জ্য সংগ্রহ করা হয়, যা পুরো দেশে উৎপন্ন বর্জ্যের ১০ শতাংশ।

ঢাকা ওয়াসার মতে, শুধু ঢাকায়ই ১০০ কোটি পলিথিন ব্যাগ মাটির নিচে পরিত্যক্ত অবস্থায় রয়েছে। ফলে সেখানে তৈরি হচ্ছে নতুন নতুন স্তর, যা ভূপৃষ্ঠে স্বাভাবিক পানি ও অক্সিজেন প্রবাহকে বাধাগ্রস্ত এবং জমির শস্য উৎপাদনক্ষমতা ধ্বংস করছে। রাসায়নিক বিক্রিয়ায় ভূপৃষ্ঠকে ক্রমাগত উত্তপ্ত করে তোলার নেপথ্যেও রয়েছে পলিথিনের নেতিবাচক প্রভাব, যা থেকে ঘটছে ভূমিকম্প, বজ্রপাত, আল্ট্রা ভায়োলেট রেডিয়েশনের মতো ঘটনাও।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সাধারণ সম্পাদক ও বুড়িগঙ্গা রিভারকিপার শরীফ জামিল ভিউজ বাংলাদেশকে বলেন, ‘নিষিদ্ধ পলিথিনে মারাত্মক বিপর্যয় ঘটছে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশের পরিবেশের। পলিথিনের ব্যবহার বন্ধ বা নিয়ন্ত্রণ না করতে পারার পেছনে দায়ী বেশকিছু কারণ। এর রয়েছে অনেক তথাকথিত সুবিধাও। যেমন, পলিথিনের উৎপাদন খুব সহজ হওয়ায় চাহিদাও বেশি। এটি সবার কাছে অত্যন্ত সহজলভ্য অর্থাৎ চাহিবামাত্রই পাওয়া যায়। সুলভে পাওয়ায় দোকানদাররাও নিজেদের সাশ্রয়ে বিপুল পরিমাণে ব্যবহার করে থাকেন। বিনামূল্যে ক্রেতাকে দেয়া সম্ভব বলে সব ধরনের দোকানে শুধু পলিথিনের ব্যাগই রাখেন বিক্রেতারা। সহজে বহন করা যায় বলে ক্রেতাসহ সবাই পছন্দও করেন। এটির সংরক্ষণও খুব সহজ হওয়ায় অনেক দিন পর্যন্ত ও বার বার ব্যবহার করা যায়।’

শরীফ জামিল আরও বলেন, ‘পলিথিনের বিকল্প হিসেবে আমরা এখনো কোনো সহজলভ্য এবং সাশ্রয়ী পণ্য মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে পারিনি। ভুলে গেলে চলবে না যে, প্লাস্টিকের পণ্য নিজেই বছরের পর বছর ধরে কাচের পণ্যের বিকল্প হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে।’

যা আছে আইনে:
২০০২ সালে ‘বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, ১৯৯৫’ সংশোধন করে পলিথিনের উৎপাদন, আমদানি, বাজারজাত, বিক্রি, বিক্রির জন্য প্রদর্শন, মজুদ, বিতরণ এবং বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার বা পরিবহন সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এই আইনে দেয়া নির্দেশ লঙ্ঘনজনিত অপরাধের ক্ষেত্রে কারাদণ্ড বা জরিমানা বা উভয় দণ্ডের বিধান রয়েছে। ২০০২ সালে ‘বাংলাদেশ পরিবেশ আদালত আইন, ২০০০’ সংশোধন করে পলিথিন শপিং ব্যাগ-সংক্রান্ত অপরাধগুলোর বিষয়ে অনুসন্ধান, কোনো স্থানে প্রবেশ, কোনো কিছু আটক, আনুষ্ঠানিক তদন্ত ও অন্য কার্যক্রম গ্রহণ এবং প্রয়োজনবোধে পরিবেশ আদালত বা স্পেশাল ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে পরিবেশ আদালত আইন অনুসারে মামলার উদ্দেশ্যে মেট্রোপলিটন এলাকায় পুলিশের এসআই/সমপর্যায় থেকে সহকারী কমিশনার পর্যন্ত এবং মেট্রোপলিটন বহির্ভূত এলাকায় এসআই/সমপর্যায় থেকে সহকারী পুলিশ সুপার পর্যন্ত কর্মকর্তাদের ওই আইনে সংজ্ঞায়িত ‘পরিদর্শক’-এর ক্ষমতা দেয়া হয়েছে।

পলিথিন বন্ধে হাইকোর্টের আদেশ:
বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী ও বর্তমান পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান পলিথিন বা প্লাস্টিক ব্যাগ ও একবার ব্যবহার্য (ওয়ান টাইম) প্লাস্টিক পণ্যের যত্রতত্র ব্যবহার, উৎপাদন ও বিক্রির বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ২০১৯ সালের ১৭ ডিসেম্বর হাইকোর্টে রিট করেন। ওই রিটের শুনানি নিয়ে ২০২০ সালের ১১ জানুয়ারি রুলসহ বেশ কয়েকটি আদেশ দেন বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী ও বিচারপতি খোন্দকার দিলীরুজ্জামানের হাইকোর্ট বেঞ্চ। আদেশে পলিথিন ও একবার ব্যবহার্য প্লাস্টিক পণ্যের ব্যবহার বন্ধে ব্যবস্থা নিতে এক বছর সময় বেঁধে দেয়া হয়।

ওই এক বছরের মধ্যে দেশের উপকূলীয় এলাকা পলিথিন বা প্লাস্টিক ব্যাগ এবং একবার ব্যবহার্য প্লাস্টিক পণ্যের ব্যবহার, বহন, বিক্রি ও বাজারজাত বন্ধের নির্দেশ দেয়া হয়। একই সঙ্গে আইন অনুসারে নিষিদ্ধ পলিথিন বা প্লাস্টিক ব্যাগের ব্যবহার বন্ধের বিষয়টি কঠোরভাবে কার্যকর করতে বাজার তদারকি, উৎপাদন, কারখানা বন্ধ ও যন্ত্রপাতি জব্দের পাশাপাশি হোটেল, মোটেল ও রেস্তোরাঁয় একবার ব্যবহার্য প্লাস্টিক পণ্য ব্যবহার বন্ধের নির্দেশ দেয়া হয়। নির্দেশনা বাস্তবায়নের অগ্রগতি জানিয়ে হলফনামা আকারে বিবাদীদের আদালতে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়।

আদেশের পাশাপাশি আইন অনুসারে নিষিদ্ধ পলিথিন বা প্লাস্টিক ব্যাগ ও একবার ব্যবহার্য প্লাস্টিকসামগ্রীর ব্যবহার বন্ধে বিবাদীদের নিষ্ক্রিয়তা কেন আইনগত কর্তৃত্ব বহির্ভূত হবে না, পলিথিন বা প্লাস্টিক ব্যাগ এবং একবার ব্যবহার্য প্লাস্টিক পণ্যের নিরাপদ বিকল্প নিরূপণে ২০২২ সালের ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে কেন একটি কর্মপরিকল্পনা নেয়া হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেন হাইকোর্ট।

পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান ভিউজ বাংলাদেশকে জানান, নিষিদ্ধঘোষিত পলিথিন ও পলিপ্রোপাইলিন শপিং ব্যাগ উৎপাদন, মজুদ, পরিবহন, বিপণন ও ব্যবহার বন্ধের কার্যক্রম কঠোরভাবে বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এ লক্ষ্যে ১ অক্টোবর থেকে শুধু সুপারশপগুলোতে এবং ১ নভেম্বর থেকে দেশজুড়ে অভিযান চালানো হবে। কাঁচাবাজারসহ দেশের সব ধরনের বাজার কর্তৃপক্ষকে ১ অক্টোবর থেকেই নিজ উদ্যোগে অবৈধ পলিথিন শপিং ব্যাগ বর্জন করতে হবে।

পুরো সময়টাতেই গণসচেতনতামূলক কর্মসূচি বাস্তবায়ন করবে পরিবেশ অধিদপ্তর। ১ নভেম্বর থেকে দেশজুড়ে আইনের কঠোর প্রয়োগও চলবে। পরিবেশের সুরক্ষা ও টেকসই উন্নয়নে প্লাস্টিকেরও নতুন নতুন বিকল্প খুঁজে বের করার আহ্বান জানিয়ে উপদেষ্টা জানান, এ লক্ষ্যে আগামী ২৯ সেপ্টেম্বর ‘প্লাস্টিকের বিকল্প মেলা’ করবে পরিবেশ অধিদপ্তর।

চলবে...

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ