Views Bangladesh

Views Bangladesh Logo

শিশুশ্রম নিরসনের প্রতিশ্রুতি পূরণ হচ্ছে না

Munaseeb Hossain

মুনাসিব হোসেন

মঙ্গলবার, ১ অক্টোবর ২০২৪

শঙ্কাজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে বাংলাদেশের শিশুশ্রম পরিস্থিতি। নিজ নিজ পরিবারকে আর্থিক সহায়তা দিতে কায়িকশ্রমে বাধ্য হচ্ছে এদেশের কর্মক্ষম শিশুদের এক তৃতীয়াংশই, যার মূল কারণ দারিদ্র্য। এদের বেশিরভাগই আবার ঝুঁকিপূর্ণ নানা কাজে নিয়োজিত থাকায় মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতি। পাশাপাশি শিশুরা হারাচ্ছে তাদের আনন্দময় শৈশব এবং শারীরিক-মানসিক অসুস্থতার শিকার হয়ে বেড়ে উঠছে দেশগড়ার কাজে অক্ষম জনগোষ্ঠী হিসেবে।

আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) কনভেনশন মেনে শিশুশ্রম নির্মূলে বাংলাদেশের লড়াইও ব্যর্থ হচ্ছে নানা প্রতিকূল পরিস্থিতিতে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সমস্যার সমাধানে আইনিসহ নানা ধরনের পদক্ষেপ ও চেষ্টা চললেও সাফল্যের হার খুবই সামান্য। এক্ষেত্রে সমাজসেবামূলক জনশক্তি সম্প্রসারণে বিনিয়োগ এবং তৃণমূল পর্যায়ের উদ্যোগে সহায়তার তাগিদ বিশেষজ্ঞদের।

আইএলও কনভেনশন অনুসারে, ৫ থেকে ১৭ বছর বয়সী শিশুদের কর্মক্ষম বলে ধরা হয়। বাংলাদেশে রয়েছে এ বয়সীমার মোট চার কোটি ২৪ লাখ শিশু। যাদের ৩৩ দশমিক ৫ শতাংশ বা এক কোটি ৪২ লাখই শিশুশ্রমিক, যা খুবই উদ্বেগজনক। শিশুশ্রমিকদের ৭৪ শতাংশ ছেলে এবং বাকি ২৬ শতাংশ মেয়ে। সবচেয়ে আশঙ্কার বিষয় এটাই যে, শিশুশ্রমিকদের ৭৪ লাখ (৫৪ শতাংশ ছেলে ও ৪৬ শতাংশ মেয়ে) সার্বক্ষণিক, ৩১ লাখ ৮০ হাজার (৭৭ শতাংশ ছেলে ও ২৩ শতাংশ মেয়ে) ঝুঁকিপূর্ণ এবং ১৩ লাখ শিশু সবচেয়ে খারাপ শ্রমে নিয়োজিত।

আইএলওর সাম্প্রতিক এক জরিপে বলা হয়েছে, শহরের শিশুরা ৩০১ ধরনের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত। এমনকি প্রাপ্তবয়স্কদের প্রায় সব ধরনের অর্থনৈতিক কার্যক্রমেও তাদেরকে নিয়োজিত থাকতে দেখা গেছে।

‘বাংলাদেশের শিশুরা বাণিজ্যিক যৌন শোষণসহ নিকৃষ্টতম ধরনের শিশুশ্রমের শিকার হয়। কখনো মানবপাচারের ফলে এবং কখনো মাছ শুকানো ও পোশাক উৎপাদনে জোরপূর্বক শ্রমে নিয়োজিত করার ফলে’ বলেও হতাশা ও উদ্বেগ প্রকাশ করছে বৈশ্বিক সংস্থাটি।

সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণায় দেখা গেছে, দারিদ্র্যই শিশুশ্রমের এক নম্বর কারণ। বেশির`ভাগ শিশু তাদের পরিবারকে সমর্থন করতেই এই বয়সে কাজে নামতে বাধ্য হচ্ছে। সরকারি পরিসংখ্যান অনুসারে, দেশের সব শিশু স্কুলে যায় না, যার ফলে সস্তা ও শোষণযোগ্য শ্রম সহজেই পাওয়া যায়।
গবেষকরা বলছেন, অধিকাংশ শিশুশ্রমিকই অনানুষ্ঠানিক খাতে কাজ করে। উপকূলীয় এলাকার শিশুরা সাধারণত মাছ ধরাসহ শুকানো ও বিক্রিতে নিয়োজিত। সংখ্যালঘু বিহারি সম্প্রদায়ের শিশুরা অল্প বয়সেই কম পছন্দসই বলে বিবেচিত চাকরিতে যুক্ত হতে বাধ্য হয়। গৃহহীন শিশুরা ভিক্ষা, পকেটমারি এবং মাদক বিক্রি করে। সীমান্ত এলাকায় শিশুদের মাদক উৎপাদন ও পরিবহনে বাধ্য করে পাচারকারীরা। আর মানবপাচার এবং জোরপূর্বক বাণিজ্যিক যৌনশোষণের উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে প্রাকৃতিক দুর্যোগে বাস্তুচ্যুত শিশুরা।

এমনকি কঠোর কায়িকশ্রমের কৃষিশিল্পও শিশুশ্রমের উপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল, যে খাতে নিয়োজিত ১০ লাখ ৮ হাজার শিশু। কৃষিকাজ যেহেতু গ্রামাঞ্চলেই বেশি হয়, সাংসারিক প্রয়োজনে খুব সহজেই অপ্রাপ্তবয়স্ক সন্তানদের শিশুশ্রমে ঠেলে দিচ্ছেন সেখানকার অসচেতন অভিভাবকরা।
অতি ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রমের দ্বিতীয় খাত হলো চামড়াশিল্প। এটি একটি অনিয়ন্ত্রিত শিল্প, যার কর্মক্ষেত্রগুলো ছোট এবং প্রায়ই গোপন জায়গায় থকে। চামড়া উৎপাদনের ৯৬ শতাংশ প্রক্রিয়ায়ই শিশুশ্রমিকরা জড়িত।

শিশুশ্রম বন্ধে বছরের পর বছর ধরে সরকারি-বেসরকারি নানা প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। ২০২৫ সালের মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রমকে গ্রহণযোগ্য মাত্রায় নামিয়ে আনতে সবচেয়ে বড় প্রচেষ্টা হিসেবে ন্যূনতম বয়স কনভেনশনের অনুমোদন দিয়েছে সরকার, যেখানে একজন শিশু যে বয়সে কাজ শুরু করতে পারে, তার সীমা বেড়েছে। সরকারের পাশাপাশি আরও অনেক কার্যক্রম বাস্তবায়ন করছে এনজিওগুলোও।

তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শিশুশ্রম সম্পূর্ণরূপে নির্মূলে আরও অনেক কাজ করতে হবে বাংলাদেশকে। শিশুশ্রম কনভেনশনের সবচেয়ে খারাপ ধাপ (সি ১৮২) এবং আইএলওর ন্যূনতম বয়স কনভেনশন (সি ১৩৮) সহ বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক চুক্তির মাধ্যমে এই অগ্রগতি সহজতর হতে পারে। সমাজসেবামূলক জনশক্তি সম্প্রসারণে বিনিয়োগ এবং তৃণমূল পর্যায়ের উদ্যোগে সহায়তার মাধ্যমে শিশুদের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের পথ প্রশস্ত করতে পারে রাষ্ট্র ও সরকার, যার বৈশিষ্ট্য হবে সুরক্ষা, নিরাপত্তা এবং সুযোগ।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ