মাংসের উৎপাদন বাড়িয়ে প্রতি ইউনিট খরচ হ্রাস করা জরুরি
সামনে ঈদুল আজহা (কোরবানির ঈদ)। এর প্রধান আনুষ্ঠানিকতা পশু জবাই। বাংলাদেশে সারা বছর যতগুলো পশু জবাই হয়, তার প্রায় অর্ধেক হয় কোরবানির ঈদে। গত বছর কোরবানির ঈদে জবাই করা হয়েছিল ১ কোটি ৪১ হাজার ৮১২টি পশু। এর মধ্যে ছিল ৪৫ লাখ ৮১ হাজার ৬০টি গরু, ১ লাখ ৭ হাজার ৮৭৫টি মহিষ, ৫৩ লাখ ৫২ হাজার ছাগল ও ভেড়া এবং বাকি ৮৭৭টি অন্যান্য পশু (উট, হরিণ ইত্যাদি)। এবার কোরবানির জন্য প্রস্তুত রয়েছে প্রায় ১ কোটি ৩০ লাখ পশু। প্রতি বছর ১০ শতাংশ হারে চাহিদা বৃদ্ধির সম্ভাবনা ধরে নিয়ে এবার পশুর চাহিদা হতে পারে ১ কোটি ১০ লাখ। তাতে উদ্বৃত্ত থাকবে প্রায় ২০ লাখ পশু। করোনা মহামারি ও আর্থিক স্থবিরতার কারণে গত ৩ বছর কোরবানির পশুর চাহিদা ছিল কম। ফলে অবিক্রিত থেকে গেছে অনেক পশু। এবার কিছুটা বৃদ্ধি পেতে পারে চাহিদা। তবে সাম্প্রতিক মূল্যস্ফীতি ও উৎপাদন খরচ বৃদ্ধির কারণে পশুর মূল্য বেশি হতে পারে। সে কারণে পশু বিক্রি কম হলে ক্ষতিগ্রস্ত হবে খামারিরা। এমন পরিস্থিতিতে আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক পশু আমদানি পুরোপুরি বন্ধ রাখা উচিত।
সাম্প্রতিক তীব্র খরা ও প্রচণ্ড রোদ কৃষি খাতকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে পশুসম্পদ খাতে । হিট স্ট্রোকে শত শত গরু-মহিষ ও ছাগল-ভেড়া মারা গেছে। এদের রোগ বেড়েছে। ওজন কমেছে শতকরা ৯৯ ভাগ পশুর। অনেক স্থানে গর্ভপাত হয়েছে গাভীর। তাপপ্রবাহের কারণে দুধের উৎপাদন কমেছে দুগ্ধবতি প্রাণীর। তাতে বিপর্যয়ের মুখে দাঁড়িয়েছে খামারিরা। তাছাড়া খাদ্য ও দুধের মূল্য বৃদ্ধির কারণে তাদের অবস্থা নাকাল। সাম্প্রতিক তাপ প্রবাহের কারণে তাদের উৎপাদন খরচ বেড়েছে নূন্যপক্ষে ২০ শতাংশ। বার বার গোছল করানো, টিনের চালে পাটের ভিজা বস্তা রাখা, স্যালাইন ও গ্লোকোজ খাওয়ানো এবং পাখা চালিয়েও সামাল দেয়া যায়নি পরিস্থিতির। কোরবানির ঈদের আগে প্রাণিসম্পদ খাতের এই বিপর্যয়ে চিন্তার ভাঁজ পড়েছে অনেক খামারির কপালে। সামনে তারা ক্ষতির সম্ভাবনা দেখছে।
বাংলাদেশে বর্তমানে গবাদিপশুর সংখ্যা ৫ কোটি ৬৯ লাখ ২৬ হাজার। এর মধ্যে গরু ২ কোটি ৪৩ লাখ ৯১ হাজার, মহিষ ১৪ লাখ ৯৩ হাজার, ছাগল ২ কোটি ৬৪ লাখ ৩৫ হাজার এবং ভেড়া ৩৬ লাখ ৭ হাজার। মোট মাংসের উৎপাদন ৯২ লাখ ৬৫ হাজার মেট্রিক টন। এর প্রায় ৬৩ শতাংশ জোগান আসে গবাদিপশু থেকে। ৩৭ ভাগ আসে হাঁস-মুরগি থেকে। মোট মাংস সরবরাহে গরুর অংশীদারিত্বই বেশি। কিন্তু এর বার্ষিক প্রবৃদ্ধির হার কম। ছাগল-ভেড়ার প্রবৃদ্ধির হার বেশি। কোরবানিতে গরুই মানুষের বেশি পছন্দ। ৭ নামে ভাগ করা যায়। আবার একাও একটি গরু কোরবানি করা যায়। এবার মূল্যস্ফীতি ও আর্থিক সংকটের কারণে শরিকে কোরবানির সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে। যিনি ১টি গরু কোরবানির কথা ভাবছিলেন তিনি হয়ত শরিকে, যিনি একাধিক শরিকে কোরবানির কথা ভাবছিলেন তিনি ১ শরিকে কোরবানি দেবেন এবং যিনি ১ শরিকের কথা ভাবছিলেন তিনি হয়ত কোরবানি দেয়া থেকে সরে দাঁড়াবেন।
ছাগল ও ভেড়া কোরবানি বৃদ্ধি পেতে পারে। আগে প্রতিটি কৃষক পরিবারে গরু পালন করা হতো। তখন চাষাবাদ হতো লাঙ্ল দিয়ে। এখন এসেছে কলের লাঙ্ল। গরু দিয়ে হালচাষ ও শস্য মাড়াই প্রায় উঠেই গেছে বলা চলে। আগে যেখানে শতকরা ৯০ ভাগ হালচাষ করা হতো লাঙ্গল দিয়ে, এখন সে পরিমাণের বেশি হয় ট্রাক্টর ও টিলার দিয়ে। বাকি অল্প চাষাবাদ হয় পশু ও মানবশক্তির মাধ্যমে। হালচাষে গরুর ব্যবহার হ্রাস পাওয়ার সঙ্গে গ্রামের কৃষকদের অনেকেই চিরায়ত পদ্ধতিতে গরু পালন প্রায় বন্ধ করে দিয়েছেন। যারা এখনও গরু পালেন তারা তা করেন মূলত দুধের অথবা মাংসের জন্য। দুগ্ধ খামার গড়ার জন্য বর্তমানে পশু ক্রয়ে স্বল্প সুদে প্রাতিষ্ঠানিক ঋণ দেয়া হচ্ছে। মাত্র ৫ শতাংশ সুদে ঋণ পাচ্ছেন দুগ্ধ খামারের মালিকরা। ফলে দুগ্ধ খামার গড়ার জন্য এগিয়ে এসেছেন অনেক শিক্ষিত তরুণ উদ্যোক্তা। তাতে বেড়েছে দুধের উৎপাদন। ইতোপূর্বে করোনাকালে দুধের বিক্রি অনেক কমে গেছে। সাম্প্রতিক খরার কারণেও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন দুগ্ধ খামারিরা।
মাংসের জন্য যারা গরু পালেন তাদের ক্ষতিও কম নয়। দেশে করোনা সংক্রমণের পর গরু কেনাবেচা অনেক কমে গেছে। অবিক্রীত থেকে গেছে অনেক পশু। সম্প্রতি পশুর জোগান বৃদ্ধি পেলেও দাম চড়া। বিক্রি হচ্ছে কম। বেকার থাকা অনেক শিক্ষিত যুবক, আধুনিক কৃষক ও বিদেশ ফেরত বেকার যুবকগণ গবাদিপশু হৃষ্টপুষ্টকরণ বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিয়ে যারা পশু খামার গড়ে তুলেছেন। তাদের মাথায় হাত। একজন খামারি গড়ে ৬০ থেকে ৮০ হাজার টাকা খরচ করে উন্নত জাতের একটি বাছুর ক্রয় করে। তারপর প্রায় ১ বছর পর্যন্ত ওই গরুটির পেছনে প্রতি মাসে প্রায় ৯ হাজার টাকা খরচ করে। এটি মোটাতাজাকরণের পর বিক্রি হয় ১.৫ লাখ থেকে ৩ লাখ টাকায়। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি অর্থনীতি অনুষদে পরিচালিত একজন ছাত্রের পিএইচডি থিসিসের বর্ণনায় দেখা যায়, মোটাতাজার জন্য বাছাইকৃত গরুর অধিকাংশের বয়স ২ থেকে ৪ বছর। এগুলো উন্নত জাতের ষাঁড়। এগুলো প্রতিপালন করা হয় নিবিড় পরিচর্যায়। প্রথমে এগুলোকে কৃমিমুক্ত করা হয়। এরপর নিয়মিত খাওয়ানো হয় ইউরিয়া-চিটাগুড় সংমিশ্রণে খড়, কিছু দানাদার মিশ্রণ ও কাঁচা ঘাস।
এভাবে গরুগুলোকে পরিচর্যা করা হয় ২ থেকে ৬ মাস পর্যন্ত। বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা প্রতিষ্ঠান থেকে গরু হৃষ্টপুষ্টকরণের যে প্যাকেজ প্রযুক্তি কৃষকদের জন্য উদ্ভাবন ও সম্প্রসারণ করা হয়েছে, তা ৩ থেকে ৪ মাসের। মাঠ পর্যায়ের সমীক্ষা থেকে প্রতীয়মান হয় যে, মোটাতাজাকরণের মাধ্যমে প্রতিদিন একটি উন্নত জাতের গরুর ওজন ৭০০ থেকে ১০০০ গ্রাম পর্যন্ত এবং দেশি গরুর ওজন ১০০ থেকে ৪৫০ গ্রাম পর্যন্ত বৃদ্ধি পায়। গরু মোটাতাজাকরণের প্রধান খরচ হলো খাদ্যমূল্য, ওষুধের দাম ও শ্রমিকের মজুরি। এসব খরচ বাদ দিয়ে একজন কৃষক প্রতিটি গরুতে গড়ে নিট লাভ করেন ১৩ হাজার ৩৫০ টাকা। কৃষকের জন্য এটা আয়ের বড় উৎস। এবার কৃষকদের নিট আয় কম হতে পারে। তবে খামারিদের উচিত হবে অল্প লাভে গরু বিক্রি করে দেয়া। তাতে মোট বিক্রি বৃদ্ধি পাবে। ভোক্তারা খুশি থাকবেন। ব্যবসাও চাঙ্গা হবে।
অনেকের ধারণা, মোটাতাজাকরণে স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর স্টেরয়েড, এ্যান্টিবায়োটিক ও রাসায়নিক ব্যবহার করা হয়। কয়েক বছর আগে হয়ত তা দেখা যেত কোন কোন ক্ষেত্রে। সম্প্রতি তা আর চোখে পড়ে না। গো-খাদ্যে এসব ক্ষতিকর উপকরণ মেশানো প্রতিরোধে এখন ভেটেরিনারি মেডিক্যাল টিম পরিবীক্ষণ করছে। এসব নিষিদ্ধ উপকরণ গো-খাদ্যে মেশানোর প্রমাণ পেলে আইন ও বিধি অনুযায়ী মামলা করা যায়। এক্ষেত্রে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি গ্রহণ করেছে সরকার। ফলে গরু মোটাতাজাকরণে ক্ষতিকর রাসায়নিকের ব্যবহার এখন আর তেমন দৃষ্টিগোচর হয় না।
বাংলাদেশে মাংসের দাম দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০১৫ সালে গরুর মাংসের দাম ছিল প্রতি কেজি ২৮০ থেকে ৩০০ টাকা। এখন তা বৃদ্ধি পেয়েছে ৫৫০ থেকে ৬০০ টাকায়। সেই সঙ্গে ভেড়া ও খাসির মাংসের দামও বেড়েছে। ভারত থেকে গরু রপ্তানিতে বাধা দিয়েছিল সনাতন হিন্দু ধর্মে বিশ্বাসী একশ্রেণির লোক। তা আমলে নিয়েছে বর্তমান বিজেপি সরকার। তাতে বাংলাদেশে ভারতীয় গরুর আমদানি হ্রাস পেয়েছে। ফলে এদেশে বেড়ে গিয়েছিল মাংসের দাম। এ সুযোগে দেশে উৎপাদিত গরু মোটাতাজাকরণে কৃষকরা উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন। দ্রুত গড়ে উঠেছিল খামার। এখন মাংসের উৎপাদনে বাংলাদেশ প্রায় স্বয়ম্ভর। কিন্তু দাম বেশ চড়া। তাতে খামারিরা লাভবান হবেন। কিন্তু তাতে নিরুৎসাহিত হবেন নিম্ন আয়ের অসংখ্য ভোক্তা। চাহিদা হ্রাস পাবে।
এমতাবস্থায় পশুপ্রতি মাংসের উৎপাদন বাড়িয়ে প্রতি ইউনিট খরচ হ্রাস করা জরুরি। কোরবানির পশুর চামড়া বিক্রি করা এবং তার উপযুক্ত দাম পাওয়া একটি বড় সমস্যা। গত কয়েক বছর ধরে চামড়ার মূল্যে বড় ধরনের ধস আমরা লক্ষ্য করছি। এরও প্রতিকার দরকার। আন্তর্জাতিক দামের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে দেশের অভ্যন্তরে চামড়ার মূল্য নির্ধারণ করা এবং তা বাস্তবায়ন উচিত। নির্ধারিত মূল্যে যাতে কৃষকদের কাছ থেকে চামড়া ক্রয় করা হয়, তাও নিশ্চিত করতে হবে। কোরবানির চামড়ার বিক্রয়লব্ধ অর্থের মালিক দরিদ্রজন। এতিম ও মিসকিন। ফলে চামড়া ভালভাবে সংরক্ষণ ও এর ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করা সবারই দায়িত্ব।
লেখক: কৃষি অর্থনীতিবিদ; পরিচালক, ঢাকা স্কুল অব ইকোনমিকস এবং প্রাক্তন উপাচার্য, ইউনিভার্সিটি অব গ্লোবাল ভিলেজ।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে