চাল উৎপাদন বাড়লেও দাম কমবে না কেন?
ভাত বাঙালির প্রধান খাদ্য। মাছে-ভাতে বাঙালি প্রবাদবাক্যটি এখনো মুষ্টিমেয়ে বাঙালির ক্ষেত্রে সত্য। বিশেষ করে দরিদ্র মানুষদের তিনবেলা ভাত খাওয়া ছাড়া উপায় নেই। সে জন্য গরিব মানুষদের প্রধান চিন্তা- ভাতের। চালের দাম বেড়ে গেলে চারদিকে হাহাকার শুরু হয়- এবার তাহলে তারা কী খেয়ে বাঁচবে? এক গবেষণায় দেখা গেছে, দরিদ্র মানুষ আয়ের ২৯-৩২ শতাংশ ব্যয় করেন চাল কিনতে। তার মানে আয়ের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ চলে যায় চালের পেছনে। ফলে পেট বাঁচাতে অন্যান্য খরচ তাকে কমাতে হয় নির্মমভাবে।
এদিকে রোজার মধ্যেই বেড়েছিল চালের দাম। মার্চের মাঝামাঝি সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত বাজারদর থেকে জানা যায়, মোটা চাল (স্বর্ণা ও চায়না ইরি) কেজিপ্রতি মূল্য ৫২-৫৩ টাকা, মাঝারি মানের চাল (পাইজাম ও বিআর) কেজি ৫৭-৫৮ টাকা। আর মিনিকেট ও নাজিরশাইলের মতো সরু চাল কেজিপ্রতি দাম ৬৪-৮০ টাকা। অন্যদিকে শ্রমজীবী অসংখ্য মানুষের দৈনিক আয় ৫শ টাকারও কম। তার মানে প্রতিদিন খেয়ে বাঁচতে একটি দরিদ্র পরিবারকে কী পরিমাণ সংগ্রাম করতে হয়, তা সহজেই অনুমেয়।
এর মধ্যে সুখবর হলো দেশে চাল উৎপাদন বাড়ছে। গতকাল রোববার (২১ এপ্রিল) সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি বিভাগ (ইউএসডিএ) ৯ এপ্রিল বাংলাদেশের দানাদার খাদ্যবিষয়ক এক প্রতিবেদনে বলেছে, এবারের বোরো মৌসুমে বাংলাদেশে চাষের আওতা ৫০ হাজার হেক্টর বেড়ে ৪৯ লাখ হেক্টর হয়েছে বলে তাদের ধারণা। আর চাল উৎপাদন ৫ লাখ টন বেড়ে ২ কোটি ৫ লাখ টনে উন্নীত হতে পারে।
চাল উৎপাদন বাড়লেও দুঃসংবাদ হচ্ছে দাম কমার আশা নেই। দাম উল্লেখযোগ্য হারে না কমার কারণ হিসেবে তিনটি বিষয় সামনে আনা হচ্ছে- এক. চালের উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়া। দুই. বিশ্ববাজারে চালের দাম বেশি এবং বাংলাদেশের জন্য সাশ্রয়ী উৎস ভারতের চাল রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা। তিন. বাংলাদেশে মার্কিন ডলারের সংকট ও ডলারের মূল্যবৃদ্ধি, যা চাল আমদানিকে ব্যয়বহুল করেছে।
ইউএসডিএর প্রতিবেদনেও উল্লেখ করা হয়, চালের দাম এখনকার পর্যায় থেকে কমার সম্ভাবনা নেই। খাদ্য মন্ত্রণালয় ও কৃষি মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে, চালের দাম কমে গিয়ে উৎপাদনে কৃষকের আগ্রহ কমে যাক, সেটা সরকারও চায় না। এ কারণে চালের দাম বর্তমান অবস্থার কাছাকাছি থাকুক বলে তারা চায়।
যৌক্তিক পরিসংখ্যান আমরা মেনে নিতে বাধ্য; কিন্তু তাতে নিম্নআয়ের মানুষের কী অবস্থা হবে, সেটা বুঝতে অপারগ। অন্যান্য বছরের মতো এবার আগাম বন্যায় ভেসে যায়নি হাওর অঞ্চলের ধান। দেশে বোরো মৌসুমে সবচেয়ে বেশি চাল উৎপাদিত হয়। এবার বোরো মৌসুম তেমন কোনো দুর্যোগের মুখে পড়েনি। ইতিমধ্যে হাওরে ধান কাটা শুরু হয়েছে। উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চলেও ধান পাকতে শুরু করেছে। কোথাও কোথাও কাটা হচ্ছে। এমন ভরা মৌসুমেও যদি চালের দাম না কমে, তা সত্যিই দুঃখজনক।
চালের দাম বেড়ে যাওয়ার পেছনে যেসব যুক্তি দেয়া হচ্ছে, উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়া, বিশ্ববাজারে চালের দাম বৃদ্ধি, ভারত থেকে চাল আমদানি কমে যাওয়া, ডলারের মূল্যবৃদ্ধি ইত্যাদি কারণগুলো সত্যি হলেও এসব দিক আরও সুনজর দিয়ে বিবেচনা করতে হবে। চাল উৎপাদনে বাংলাদেশকে যে করেই স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে হবে। কৃষিজমি বাড়াতে হবে। আধুনিক কৃষির প্রচলন করতে হবে। অন্যথায় বিপুল জনগোষ্ঠীর এ দেশ খাদ্য সংকটে পড়বে। চাল কেনার পেছনে যদি নিম্ন আয়ের মানুষ আয়ের এক-তৃতীয়াংশ শেষ করে ফেলেন তাহলে তা তাদের জীবনমান রক্ষায়ও মারাত্মক প্রভাব পড়বে। সার্বিক দিক বিবেচনা করে চালের দাম কীভাবে কমানো যায়, এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট বিভাগকে অবশ্যই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে