বিবাহ বিচ্ছেদের কারণ ছোট হলেও অগুরুত্বপূর্ণ নয়
চলতি বছরের একটি ঘটনা দিয়ে শুরু করা যাক। গেল এপ্রিলে খবরটি বেশ চাউর হয়েছে। কমবেশি সবারই চোখে পড়েছে তা। সেটি হচ্ছে- ব্রাজিলিয়ান ফুটবল তারকা কাকার সঙ্গে বিবাহ বিচ্ছেদের কারণ জানিয়েছেন তার সাবেক স্ত্রী ক্যারোলিন। কারণ হিসেবে ক্যারোলিন উল্লেখ করেছিলেন- কাকা মানুষ হিসেবে এতটাই পারফেক্ট (নিখুঁত) যে তাকে সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে বিচ্ছেদের। এমন মন্তব্যের পর স্বাভাবিকভাবেই অনেকেই নড়েচড়ে বসেছেন। কেউবা হয়তো ক্ষণিকের জন্য ভেবেছিলেন- ভুল পড়ছি না তো! সত্যিই তো, কেউ যদি পুরোপুরি নিখুঁতই হয়, তাহলে বিচ্ছেদইবা হবে কেন! এ তারকার বিচ্ছেদের বহু বছর পর এমন মন্তব্য করেছেন ক্যারোলিন যখন সাবেক এ দম্পতির দুজনই নতুন আরেকটি সম্পর্কে রয়েছেন।
একসঙ্গে থাকার প্রতিশ্রুতি দিয়ে যে সম্পর্কের শুরু সে সম্পর্কে তাহলে বিচ্ছেদইবা ঘটে কেন? এমন প্রশ্ন তৈরি হওয়াই স্বাভাবিক। মূলত নারী ও পুরুষের একসঙ্গে থাকার প্রতিশ্রুতিকে বৈধতা দেয়া শব্দের নামই বিয়ে। সামাজিক ও ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী পারিবারিক জীবনযাপনের শুরুটাও হয় বিবাহবন্ধনের মাধ্যমেই। এ বন্ধন কেবল দুজন ব্যক্তির মধ্যে ঘটে বিষয়টি এমন নয়। বরং পুরো প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে দুটি পরিবারও মিলিত হয় এতে। একটি বিবাহ দুটি পরিবারের সঙ্গে জড়িত। একসঙ্গে থাকার প্রতিজ্ঞা দুটি মানুষ করলেও এর পেছনে থাকেন আরও অনেকেই। ফলে বিবাহ-পরবর্তী সম্পর্ক কেমন হবে, তার অনেকটা বর্তায় পরিবারের মানুষজনের ওপরও। বিবাহিত যুগলের একে অপরের ওপর আবেগ, অনুভূতির পাশাপাশি শ্রদ্ধাবোধ, বোঝাপড়া, দায়িত্ববোধ, বিশ্বাস স্থাপন করা জরুরি।
তবে এসব কিছুই নিক্তির পাল্লা মেপে ঠিকঠাক থাকলেও যে সম্পর্কের পারদ ওঠানামা করবে না এমন নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারে না। এক সময় পুরো বিশ্বে এশিয়ানদের (তন্মধ্যে বাংলাদেশিদের) সুনাম ছিল বিবাহ-পরবর্তী সম্পর্ক আজীবন টিকিয়ে রাখার ক্ষেত্রে। যেন কোনোভাবে এখানে বিবাহিত সম্পর্ক স্থাপন করতে পারলেই জীবনের হ্যাপি এন্ডিং টানা যাবে নিশ্চিন্তে; কিন্তু বর্তমান প্রেক্ষাপট বলছে ভিন্ন কথা। কেননা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাব অনুযায়ী, ২০০৬ থেকে ২০২১ সাল সময়কালীন স্থূলবিচ্ছেদের (মোট জনসংখ্যার অনুপাতে বিবাহবিচ্ছেদের হার) হার শূন্য দশমিক ৬ থেকে ১ দশমিক ১-এর মধ্যে ওঠানামা করেছে। ২০২২ সালে তা বেড়ে ১ দশমিক ৪-এ দাঁড়ায়। এ পরিসংখ্যানের পরবর্তী দুই বছরে বিচ্ছেদের সংখ্যা বেড়েছে বৈ-কমেনি।
বিবাহ বিচ্ছেদের পেছনে গড়পড়তা কিছু কারণ বিবেচনা করা হয়। যার মধ্যে রয়েছে- বনিবনা না হওয়া, পরকীয়া বা বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক, ভরণপোষণের ব্যয় বহন করতে অসামর্থ্য অথবা অস্বীকৃতি, পারিবারিক চাপ, শারীরিক নির্যাতন, যৌন অক্ষমতা বা অনীহা, মাদকাসক্তি ইত্যাদি। ২০২২ সালে করা পরিসংখ্যান ব্যুরোর জরিপে উঠে আসে-বিবাহবিচ্ছেদের পেছনে সবচেয়ে বড় কারণ বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক। এ জরিপে উত্তরদাতাদের প্রায় ২৩ শতাংশ এ কারণ সামনে এনেছেন। এরপর রয়েছে ২২ শতাংশ উত্তর দিয়েছেন দাম্পত্যজীবন পালনে অক্ষমতার বিষয়টিকে সামনে রেখে। তবে এসবের বাইরেও যে আর কোনো কারণ নেই, এমনটা ভাবা অবান্তর। বরং পাশাপাশি অলিখিত নানা কারণেও গ্রামে, এমনকি শহরেও বিবাহ বিচ্ছেদ বেড়েই চলছে।
বিচ্ছেদের ঘোষণা উভয় পক্ষ থেকেই আসতে পারে। এককালে নারীদের থেকে এমন ঘোষণা কম এলেও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তা পাল্টেছে। বর্তমান সময়ে নারীরা তালাক দিচ্ছেন বেশি, বিচ্ছেদের আবেদনও তাদের পক্ষ থেকেই বেশি এসেছে বলে নানা পরিসংখ্যানে স্পষ্ট হয়েছে কখনোবা। গণমাধ্যমে সেসব ফলাও করে ছাপা হয়েছে সময়ে সময়ে। নারীর পক্ষ থেকে বিচ্ছেদের আবেদন বাড়ার পেছনে খুব সহজ কারণ হিসেবে ধরা হয় উচ্চ শিক্ষা, নারী ক্ষমতায়ন, নিজের অধিকার সম্পর্কে সচেষ্ট হওয়ার বিষয়গুলো। এসব কারণের কোনোটিই ছোট করে দেখার উপায় নেই। শিক্ষিত, স্বাবলম্বী নারীমাত্রই নিজের সঙ্গে হওয়া অন্যায় মুখ বুজে সহ্য করে নেবে না। অশিক্ষিত কিংবা স্বল্প শিক্ষিত নারী নিজের অবস্থান নিয়ে খানিকটা দুর্বল মানসিকতা পোষণ করেন যেখানে পড়াশোনা জানা, স্বাবলম্বী নারীমাত্রই এর বিপরীত ধারণা পোষণ করেন।
ফলে তারা কোনোরূপ অন্যায়, নির্যাতন সেটা হোক শারীরিক কিংবা মানসিক কোনোটাকেই প্রশ্রয় দেয়ার পক্ষপাতী নন। আর বিপত্তি বাঁধে তখনই। পুরুষের পৌরুষ এতে আঘাতপ্রাপ্ত হয়। কেবল পুরুষই নন, পুরুষতান্ত্রিক চিন্তায় আটকে থাকা পরিবারের অন্যান্য নারী সদস্যও তখন জোট বাঁধেন ভুক্তভোগী নারীর বিপক্ষে। ফলে সে নারীকে বাধ্য হয়েই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হয়। নারী শিক্ষার অগ্রগতি, সমাজে নারী-পুরুষের সমান অবস্থান, স্বাবলম্বী হওয়ার কারণে নারী নিজেই নিজের দায়িত্ব গ্রহণের সাহস বা মানসিকতা ধারণ করা পুরুষতান্ত্রিক মনোভাবের বিপরীতে ভীষণ রকম হুমকির মতোই। বিশ্বায়নের এ সময়ে এসে অনেকেই নারীকে সমকক্ষ ভাবতে সক্ষম নন। বরং তারা এখনো ভেবে বসেন জ্ঞানে, মননে কিংবা কর্মক্ষেত্রে নারী হবেন অধীনস্ত।
খুব ছোট একটা সামাজিক উদাহরণ টানা যায় এক্ষেত্রে, বর্তমান সময়ে এসে বহু সম্পর্ক ভেঙে যায় কেবল স্ত্রী স্বামীর চেয়ে যোগ্যতায়, পারিশ্রমিকে এগিয়ে থাকার কারণে। সমাজের সম্মানজনক স্তরে অবস্থান করা পুরুষরাই কখনো মেনে নিতে চান না কিংবা পারেন না স্ত্রী পদমর্যাদায় এগিয়ে গেলে। স্নায়ুযুদ্ধ, ছোট ছোট বিষয়ে অনবরত ঝগড়া হওয়া, কলহ তৈরি হওয়া, এক পর্যায়ে নারীকে বাধ্য করা হয় কাজ থেকে অব্যাহতি নেয়ার ব্যাপারে, অন্যথায় সে সংসার যাপন আর সুখের হয়ে উঠে না। যার পরিণতি ঠেকে বিচ্ছেদে। কেবলমাত্র পুরুষ নারীর অবস্থানকে, যোগ্যতাকে সম্মান জানাতে পারলেই হয়তো বিচ্ছেদ শব্দটিও আওড়াতো না কোনো নারী। এক্ষেত্রে একে অপরকে সহযাত্রী ভাবার মানসিকতা তৈরি হতে হবে। কেউ কারও চেয়ে উত্তম এমনটা ভাবার সুযোগ নেই।
কথাসাহিত্যিক হুমায়ুন আজাদের একটা কবিতার কিছু পঙক্তি দিয়ে এ অনুচ্ছেদ শুরু করা যায়। পঙক্তিগুলো হলো:
‘আমাদের মাকে আমরা বলতাম তুমি, বাবাকে আপনি।
আমাদের মা গরিব প্রজার মত দাঁড়াতো বাবার সামনে,
কথা বলতে গিয়ে কখনোই কথা শেষ করে উঠতে পারতোনা
আমাদের মাকে বাবার সামনে এমন তুচ্ছ দেখাতো যে,
মাকে আপনি বলার কথা আমাদের কোনোদিন মনেই হয়নি
আমাদের মা আমাদের থেকে বড় ছিলো, কিন্তু ছিলো আমাদের সমান।’
পুরুষকে নারীর সহযোগী মনোভাবের তৈরি হতে হলে প্রথমেই ভূমিকা রাখে পরিবার। বলা হয়ে থাকে পরিবারই প্রথম সামাজিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। যে পরিবারে মাকে ভীষণ সম্মানে, আদরে-কদরে রাখা হয় সে পরিবারের সন্তানরা প্রথমেই যেটা শেখে তা হচ্ছে বাবার মতো মা-ও ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় যা সচরাচর কম পরিবারেই ঘটে। ফলে সন্তানরা বড় হতে হতে পরিবার থেকেই শিক্ষা লাভ করে মায়ের মতামতের কিংবা মায়ের অবস্থান যেহেতু কম গুরুত্বপূর্ণ তাই তিনি ততটা সম্মান পাওয়ার যোগ্য নন। এমন পরিবারে মেয়েশিশু বড় হতে থাকে নিজেকে অগুরুত্বপূর্ণ ভেবে এবং ছেলেশিশুরা অজান্তেই মনের গহিনে পোষণ করতে থাকেন তারা প্রভুর সমতুল্য এবং নারী ঠিক ততটা সম্মান পাওয়ার যোগ্য না।
নারী পরিবার তথা পুরো সমাজের কাছেই অবহেলিত থাকবে, এটাই স্বাভাবিক ঘটনা হিসেবে ধরে নেয় এমন পরিবারে বেড়ে ওঠা ছেলেশিশু। পরিণত বয়সে সে নারীকে নিজের সমকক্ষ ভাবতে পারে না। ফলে কোনো নারীর এগিয়ে যাওয়া কিংবা পুরুষের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার বিষয়টিতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে না। আবার সে ছেলে শিশুটিই এক সময় পরিপূর্ণ মানুষ না হয়ে পুরুষ হয়ে ওঠে। পরিণত বয়সে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন এবং তার নারী সঙ্গীকে ঠিক সেভাবেই দেখতে চান যা তিনি নিজ পরিবারে দেখে এসেছেন; কিন্তু সেই পুরুষের নারী সঙ্গীটি যদি হন শিক্ষিত, আধুনিক মানসিকতার কিংবা আত্মসম্মানবোধ সম্পন্ন তিনি হয়তো তার অর্ধাঙ্গের এমন মানসিকতার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে চাইলে পেরে ওঠেন না। ফলে এক পর্যায়ে বিচ্ছেদের পথই বেছে নেন।
তবে বিবাহ বিচ্ছেদের পেছনের কারণ হিসেবে কেবল নারীই ভুক্তভোগী এমনটা ভাবাও সমীচীন নয়। বিপরীত গল্পেরও শেষ নেই সমাজে। তবে পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারী কিছুটা হলেও বেশি বিড়ম্বনার শিকার। বর্তমান সময়ে বিবাহ বিচ্ছেদের পেছনে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমও বেশ ভূমিকা রাখে। শুনতে অবাক ঠেকলেও এটাই সত্যি যে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিখুঁত যুগলকে দেখে অনেকেই হতাশায় ডোবেন। ভাবতে বসে যান, আমার জীবনসঙ্গী এমন নয় কেন! এটা ভাবা যদিও যুক্তিসঙ্গত নয় তবে ফেসবুক, ইন্সটাগ্রামে ছবি দেখে অনেকেই বিষাদগ্রস্ত হন এই ভেবে যে, এমনটা তার জীবনে ঘটছে না কেন? প্রতিযোগিতামূলক আচরণ, তুলনা করা, হীনম্মন্যতায় ভোগা এমনকি ছোট ছোট অপ্রাপ্তিকে বড় করে দেখার প্রবণতা বৃদ্ধি পায়। কখনোবা ছোট অপ্রাপ্তি থেকে বিবাহ বিচ্ছেদ পর্যন্ত হয়; কিন্তু সত্যি কথা হচ্ছে বাস্তব জীবনে কেউই নিখুঁত নন। সবাই যার যার স্থান থেকে সাধ্যমতই হয়তোবা জীবনসঙ্গীর জন্য করে যাচ্ছেন।
আত্মতৃপ্তি ততক্ষণ থাকে যতক্ষণ দুজনের মাঝে তুলনা করার প্রবণতা থাকে না। ছোট একটা বিষয় খেয়াল রাখলেই সমাধান টানা অনেক সহজ, রেস্তোরাঁয় একটা ছবি তোলার আগে আমরা যেমন গুছিয়ে নিই সামনের অংশ খাবার খাওয়ার সময় কি ঠিক অতটুকুই গোছানো থাকে? নিশ্চয়ই না! নিখুঁত যুগলেরা ঠিক এমনই, ক্যামেরার সামনে নিখুঁত অংশটুকুই প্রকাশ করেন, বাকিটা ব্যক্তিগত বলেই অপ্রকাশিত থাকে। তবে কারণ হিসেবে যাই থাকুক না কেন, যে কোনো যুগলের মন সায় না দিলে সম্পর্ক টিকিয়ে রাখাই যে কঠিন সেটি বলার অপেক্ষা রাখে না। ফিরে যাই প্রথম অনুচ্ছেদে, কাকা ও ক্যারোলিনের বিবাহ বিচ্ছেদের ঘটনায়। একদম নিখুঁত হয়েও কিন্তু বিচ্ছেদের পথেই হাঁটতে হয়েছে এ তারকা জুটিকে। তাই বলাই বাহুল্য, বিচ্ছেদের পেছনে খুব ছোট কারণও কখনোবা গুরুত্বপূর্ণ।
ফাহমিদা তাপসী: সাংবাদিক
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে